‘ঈশ্বরের আপন দেশ’। নিছক বিজ্ঞাপনী ভাষ্য নয় মোটেই। কেরলের উত্তরাংশে কাসারগড় জেলা। এখানেই রয়েছে রহস্যে মোড়া প্রাচীন এক মন্দির। বিষ্ণু দেবতার এক রূপ- অনন্তপদ্মনাভস্বামী, তাঁরই জল পরিবেষ্টিত অনুপম মন্দিরখানি।
এই মন্দিরটিই লোকবিশ্বাসমতে তিরুবনন্তপূরমের বিখ্যাত পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের মূলস্থান (প্রকৃত বাসভূমি)।
দুই একর এলাকা ব্যাপী একটি হ্রদ ঘিরে রয়েছে হ্রদেরই এক কোণে অবস্থানরত মন্দিরটিকে। মন্দিরটি আসলে একটি গুহামুখ। এই গুহার অপর মুখটি নাকি তিরুবনন্তপূরম পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে উন্মুক্ত।
জনশ্রুতি এমনই যে সাধু দিবাকর মুনি বিল্বমঙ্গলম, এইস্থানে নিয়মিত শ্রীবিষ্ণু দেবতার উপাসনা পূজাপাঠ করতেন। শ্রী নারায়ণ অবশেষে পরম ভক্তের ভক্তিতে দ্রব হয়ে স্থির করলেন শিশুরূপে দেখা দেবেন তাঁকে। দিব্য জ্যোতিযুক্ত উজ্জ্বল মুখশ্রীর শিশুটিকে দেখে সাধু যারপরনাই বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন পরিচয়। মৃদু মৃদু হাস্যরত শিশু বললেন,
“হে মুনিবর, আমার এই ধরাধামে কেউ নাই, কিছু নাই। না পিতা, না মাতা, না কোনও আত্মীয় স্বজন। আমি জন্ম অনাথ। আমাকে থাকতে দিন।”
সাধু সানন্দে সস্নেহে রাজি হলেন শিশুটিকে তাঁর সঙ্গে থাকতে দিতে। সেই দিব্যশিশু কিন্তু একটি শর্ত আরোপ করলেন।
“হে সাধু, কথা দিন আমাকে কখনও অসম্মান অমর্যাদা করবেন না। যদি আমি কখনও অসম্মানিত, উপেক্ষিত বোধ করি তবে তৎক্ষনাৎ এই স্থান পরিত্যাগ করে চলে যাবো।”
সাধু ভাবলেন, এ আর এমন কি কথা! কে আবার একটি শিশুর অমর্যাদা করবে এখানে! মুখে বললেন, “তথাস্তু। তাই হবে।”
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শিশুটির শিশুসুলভ দুষ্টুমি আর বাঁদরামিতে তিতিবিরক্ত হয়ে বকাঝকা করতে বাধ্য হলেন সাধু। আর যায় কোথায়! অভিমানে, ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে পূর্বশর্তের কথা স্মরণ করিয়ে গুহায় বিলীন হলেন সেই দিব্যশিশু।
মুনি বিল্বমঙ্গলম বুঝতে পারলেন, এই শিশু কোনও সাধারণ শিশু নন, ইনিই তাঁর পরম আরাধ্য স্বামী স্বয়ং শ্রী নারায়ণ! দৈবযোগে তিনি জানতে পারলেন, পুনরায় শিশুটির দর্শন পেতে হলে তাঁকে ঐ গুহাপথে যেতে হবে অনন্তকটিতে, সর্পরাজ শ্রী অনন্তনাগের ডেরায়। সাধু ঠিক করলেন সেই পথেই তিনি এগোবেন। গুহাপথ গিয়ে পৌঁছল সাগরে, তারপর আরও এগোতে দেখা মিলল এক গভীর বনভূমির। একটি সুবৃহৎ ইল্লিপ্প (মহুয়া) গাছের ডালে বসে রয়েছেন শিশুরূপে শ্রী নারায়ণ। মুহূর্তে সেই বৃক্ষ মাটিতে আছড়ে পড়ে রূপ নিল সহস্র ফণাধর এক বিশালকায় সর্পের। এই সেই বিষ্ণুবাহন মহাসর্প, শ্রী অনন্তনাগ! প্রণত হলেন মুনিবর।
কাসারগড় মন্দির ঘিরে থাকা হ্রদের জলে রয়েছে এক আশ্চর্য সরীসৃপ। একটি মহাকায় কুমীর। পবিত্র কুমীর। ইনি হ্রদের জল পাহারা দেন। বিশ্বের একমাত্র নিরামিষভোজী কুমীর ইনি। অনন্তপদ্মনাভস্বামীর প্রসাদ তণ্ডুল ও গুড় ভিন্ন আর কিছুই মুখে তোলেন না। নিয়মিত মন্দিরকক্ষে যাতায়াত এনার। গত সত্তর বছর ধরে একাই এই হ্রদে তাঁর অবস্থান।
সত্তর বছর আগে এক কালান্তক দিনে ইংরেজ এক সৈন্য হ্রদের কুমিরটিকে গুলি করে। হ্রদের জল মুহূর্তে লাল হয়ে যায়। সেইসময়ও এই চতুর্দিক উঁচু প্রাকার পরিবেষ্টিত হ্রদটিতে আর কোনও কুমির ছিল না। মৃত কুমিরটিকে উদ্ধার করারও কোনও উপায় ছিল না। এর পরদিনই হ্রদে ইনি দেখা দেন। আশ্চর্য সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন অনেকেই। সম্পূর্ণ সুস্থ পূর্ণবয়স্ক একটি কুমির কোথা থেকে কি উপায়ে হ্রদে এল – সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর আজও মেলে না। এই আশ্চর্য কুমিরকে নিয়মিত বন্দনা করা হয় শ্রী বিষ্ণুর সাথে সাথেই।
হ্যাঁ, এই ভূভারতে এমন অদ্ভুত কিছু ঘটনা আজও ঘটে চলেছে, যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। বলতে হয়, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।