এখনও রয়েছে স্বাধীনতার বইয়ের চাহিদা, দাবি লেখক-প্রকাশকের

এক দিন বাদেই স্বাধীনতা দিবস। চারদিকে চলছে বহু প্রস্তুতি, আলোচনা ও সমাবেশ। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় স্বাধীনতা দিবসের বইয়ের খোঁজও চলছে উত্‍সুখ বইপ্রেমীদের। আত্মকথা, বক্তৃতা ছাড়াও বিপ্লবীদের জীবন সম্পর্কে লোকের কৌতূহল এখনও আছে।

গত শতকের ছয়ের দশকে এই প্রতিবেদক অনেকের মত গোগ্রাসে পড়েছেন শৈলেশ দে-র ‘আমি সুভাষ বলছি’। বইবাজারে ভাল সাড়া ফেলেছিল ওই বই। ‘পত্রলেখা’-র গুণেন এই প্রতিবেদককে জানান, “স্বাধীনতার ৭৩ বছর বাদেও সংগ্রামের বইয়ের পাঠক আছেন। এখনকার স্বাধীনতার বইগুলোর বিষয় কী? গুণেনবাবুর বইয়ের মধ্যে আছে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত, তারিখ অভিধান’।

পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত সময়কালের প্রায় তিন হাজার ঘটনার সাল, তারিখ ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে পরিবর্ধিত মুদ্রণে।

উল্লেখযোগ্য অন্য বইয়ের মধ্যে আছে মানিক মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভগত্‍ সিং রচনাসংগ্রহ, দীপঙ্কর মুখোপাদ্যায়ের ‘ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দশক’। হীরেন চট্টোপাদ্যায়ের ‘শেষ সংলাপ’ , ‘শ্রীঅরবিন্দ- কারাকাহিনী’। রবীন্দ্রনাথ থেকে সারদামণি, বিবেকানন্দ কেউই বাদ যাননি ব্রিটিশ টিকটিকিদের নজরদারি থেকে। অগ্নিযুগের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের কথা লিখেছেন তুহিন শুভ্র ভট্টাচার্য তাঁর ‘ব্রিটিশ পুলিশের টিকটিকি ও অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের গুপ্তচর’-এ। তাঁর উল্লেখযোগ্য অপর একটি বই কলকাতায় ‘অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা’, ঐতিহাসিক দিক থেকে শ্রীঅরবিন্দের রাজনৈতিক জীবনের পর্যালোচনা করেছেন গৌতম নিয়োগী তাঁর ‘শ্রীঅরবিন্দ রাজনৈতিক জীবন’ বইতে।

এ ছাড়া চাহিদা আছে ‘পত্রলেখা’-র প্রিয়ব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘ব্রিটিশ কারাগারে সুভাষচন্দ্র’, ‘রাসবিহারী বসুর জীবনকথা ও রচনা সংগ্রহ’ প্রভৃতি। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের ওপর বিভিন্ন ভাষায় বই বা আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। বাজারে এই সব বইয়ের কাটতি কিরকম? প্রশ্নের উত্তরে আশাবাদের কথা জানালেন দে’জ-এর অন্যতম কর্ণধার অপু দে। এই প্রতিবেদককে তিনি শুক্রবার বলেন, “আমাদের এই বিষয়ের ওপর নিজেদেরই প্রায় ৪০টি বই আছে। এর মধ্যে প্রথমেই মনে আসছে নেতাজীর ওপর কিছু বই, যেমন ডঃ শিশির কুমার বসুর ‘অনির্বান জ্যোতি’, নারায়ণ সান্যালের ‘আমি নেতাজীকে দেখেছি’ এবং ‘নেতাজীর রহস্যসন্ধানে’, শ্রী অভিজিতের ‘তাইহোকু থেকে ভারত’। আছে চিন্ময় চৌধুরীর কিছু ভাল বই-স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী, বিপ্লবী নারী, সহিংস নারী, অহিংস নারী প্রভৃতি। ‘কমলিনী প্রকাশন’ নামে আমাদের শাখা একটা সিরিজ বার করছে এই বিষয়ের ওপর। এর নাম ‘বিপ্লবীদের ডায়েরি’। প্রতিটায় থাকছে ৫-৬টি লেখা। এখনও পর্যন্ত সিরিজের কিছু বই বার হয়েছে। আরও বার করার কথা। নবীন প্রজন্মের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ আছে বলেই আমার ধারণা।”

এতটা আশার কথা শোনাতে পারলেন না আর এক নামী প্রকাশক ‘দীপ প্রকাশন’-এর শংকর মন্ডল। তিনি বলেন, “সব রকম বই পড়ার লোকই কমে গিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবের বই আলাদা করে কে পড়বেন?”

চন্দননগর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ভূতপূর্ব অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদার (জন্ম : ১৯৫৬) স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীদের নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন । ২০১৭ সালে রেডিক্যাল ইম্প্রেশন থেকে প্রকাশিত তাঁর বই ‘অগ্নিযুগের ফাঁসি’ ও ২০১৮ সালে ‘অগ্নিযুগের চিঠি’ ইতিমধ্যেই পাঠকমহলে সমাদৃত। সম্প্রতি ‘অগ্নিযুগের ফাঁসি’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। যে ৪১ জন বাঙালি বিপ্লবী স্বাধীনতার জন্যে ফাঁসিমঞ্চে প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত ও বৈপ্লবিক পরিচিতি রয়েছে ‘অগ্নিযুগের ফাঁসি’ বইটিতে। অন্যদিকে, চল্লিশজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর মোট নব্বইটি চিঠি ও সেই চিঠিগুলির প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা ‘অগ্নিযুগের চিঠি’। অধ্যাপক মজুমদারের আরও একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘অগ্নিযুগের অভিধান’ প্রকাশের অপেক্ষায়। এই অভিধানে মোট সূচি বা এন্ট্রির সংখ্যা ৮৫০। এতে রয়েছে অগ্নিযুগের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামী, গুপ্ত সমিতি, আইন বা কালা কানুন, নানা ঐতিহাসিক ঘটনা, ঐতিহাসিক মামলা ও পত্র-পত্রিকার পরিচিতি। এছাড়া রয়েছে যে সব বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী অসহযোগ, আইন অমান্য, ভারত-ছাড়ো বা আই এন এ-তে বা বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের পরিচিতি, সেলুলার জেলের বন্দী বিপ্লবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা, কলকাতায় বিপ্লবীদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোপন ডেরার খোঁজখবর, স্মরণীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্ম ও মৃত্যুদিন ও অগ্নিযুগের দিনপঞ্জি। বর্তমানে লেখক অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নিয়ে একটা উপন্যাস রচনায় ব্যস্ত।

এত বই প্রকাশিত হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে সরকারের যে রকম উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। এই অভিযোগ শুভেন্দু মজুমদারের। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এক প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নামে তৈরি হয়েছে গবেষণাসংস্থা। সেখানে ওই প্রধানমন্ত্রী কখন, কোথায় গিয়েছেন, স্থানীয় নানা দৈনিকে কী খবর বা সম্পাদকীয় প্রকাশ হয়েছে তাঁকে নিয়ে, তার বিশদ সঙ্কলন হচ্ছে। অথচ, স্বাধীনতা সংগ্রামের কোন পর্যায়ে, কোন বিপ্লবী, কতদিনের জন্য অন্তরীণ ছিলেন, তার সরকারি সমীক্ষা হয়নি। ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠী নিজেদের উদ্যোগে এই সমীক্ষা করিয়েছিল। সেটা ১৯০৮ থেকে ১৯২১ সময়কালের। এর পরের পর্যায়ের প্রামান্য সমীক্ষা করে একটা সংকলন প্রকাশ করা যায় না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.