কেবলমাত্র বঙ্গ রাজনীতি নয়,ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান মূহুর্তে দাঁড়িয়ে শ্যামাপ্রসাদকে অভিনন্দন জানাতে চাই।কিন্তু কেন?শ্যামাপ্রসাদের চির বিদায়ের পর বাংলায় যে দুটি প্রজন্মের মানুষ আজ এ দেশে রয়েছেন,তাঁরা জেনে রাখুন, শ্যামাপ্রসাদই ভারতীয় রাজনীতির প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক চাতুরি ও ধূর্তামি ধরতে পেরে তাঁকে জব্দ করেছিলেন।
ঘটনাটি ১৯৪৬ সালের অগস্ট মাসের একেবারে শেষের দিকের।১৯৪৬ – এর ১৬ অগস্টের কলকাতার দাঙ্গার পর বাংলা প্রদেশের ‘প্রিমিয়ার’ বা মুখ্যমন্ত্রী শহিদ সোহরাওয়ার্দী প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘শান্তি ও সম্প্রীতি’ ফিরিয়ে আনার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের দিয়ে এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন।তদনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী কংগ্রেসের কিরণশঙ্কর রায়,শরৎচন্দ্র বসু,হিন্দু মহাসভার ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুকে আমন্ত্রণ জানালেন বৈঠকে যোগ দিতে।খবরের কাগজে এই খবরটি প্রকাশিত হল।
খবরে এ কথাও বলা হল যে,ওই বৈঠকে মুসলিম লীগের পক্ষে সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিজে ও মৌলানা আক্রাম খান প্রতিনিধিত্ব করবেন।জ্যোতি বসুর ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদের তীব্র আপত্তি ছিল।কারণ ১৯৪৬- এর প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনে জ্যোতি বসুকে জিতিয়ে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে সেই কেন্দ্রের সবচেয়ে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরকে মুসলিম লীগের সমর্থকরা অপহরণ করে ১৫ দিন আটকে রেখেছিল।তাই শ্যামাপ্রসাদ সোহরাওয়ার্দীকে চিঠি লিখলেন ‘……kiran shankar Roy and sarat chandra Bose from the congress Party represent both Hindus and Muslims…. you as premier represent the Muslim and the Muslim League,I as a Hindub Mahasabha leader represent the Hindus. But whom does Jyoti Basu represent?….. ‘ সোহরাওয়ার্দীর ডাকা বৈঠকে জ্যোতি বসু ‘ কোন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন’ এটা খোলাখুলি না জানতে পারলে শ্যামাপ্রসাদবাবু ওই বৈঠকে যোগ দেবেন না,এ কথাও তিনি সোহরাওয়ার্দীকে জানিয়ে দিলেন।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব জ্যোতি বসুকে দেওয়া আমন্ত্রণপত্র ফিরিয়ে নিলেন।কারণ ওই সময় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জাতীয় গুরুত্ব এতটাই ছিল যে,সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে তা এড়িয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল।আর জ্যোতি বসু? মুসলিম লীগের পক্ষ নিয়ে কিছু ‘ আদায়’ করার ফন্দি তাঁর ছিল।শ্যামাপ্রসাদ সেটা ধরে ফেলেছিলেন।
সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ‘ জ্যোতি বসুকে চিনেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ ‘ গ্রন্থে লিখেছেন ‘ আমরা যারা তিরিশের (১৯৩০) যুগে জন্মেছি এবং আমাদের সদ্য কিশোর বয়সে দেশবিভাগ দেখেছি- দেখেছি ১৯৫০- এর পূর্ব বাংলার দাঙ্গা,তাদের কাছে শ্যামাপ্রসাদের অভাবিত মৃত্যু দেশবন্ধুর চেয়েও অনেক অনেক বড় জাতীয় বিপর্যয় বলে মনে হয়।’
জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালের ১৭ মে তারিখে তাঁর নয়াদিল্লির ইয়র্ক রোডের বাড়ি থেকে কলকাতায় কিরণশঙ্কর রায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন।দেশবিভাগের দামামা তখন বেজে উঠেছে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও মুসলিম লীগ যদি পুরো বাংলাকে পাকিস্তানের মধ্যে না পাওয়া যায় তা হলে কলকাতাকে অন্ততপক্ষে ‘ফ্রি সিটি’ হিসাবে পাকিস্তান ব্যবহার করতে পারে তার দাবি পেশ করেছে। জওহরলাল কিরণবাবুকে লেখা তাঁর চিঠিতে ওই ‘ফ্রি সিটি’র কথা উল্লেখ করে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।কারণ শ্যামাপ্রসাদ কংগ্রেসের আগেই মুসলিম লীগের ওই বিপজ্জনক দাবির বিরোধিতায় নেমেছিলেন।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও ওই সময় ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী মহাশয়কে একটি চিঠিতে ফ্রি সিটি-র প্রসঙ্গ তুলে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘…. এটা আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা শ্যামাপ্রসাদকে আমাদের সঙ্গে পেয়েছি…..।’ এটা অনেক প্রমাণের মধ্যে একটি প্রমাণ যে দেশের ওই জরুরী মুহূর্তে শ্যামাপ্রসাদের গুরুত্ব কতখানি ছিল।
২ জুন( ১৯৪৭) তারিখে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণায় হিন্দু- মুসলমানের জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশবিভাগের সঙ্গে বাংলা বিভাগও চূড়ান্ত হয়ে গেল তখন চতুর সোহরাওয়ার্দী শরৎচন্দ্র বসুকে সঙ্গে নিয়ে Independent sovereign Bengal গঠনের জন্য আন্দোলন আরম্ভ করলেন।
শ্যামাপ্রসাদই প্রথম জাতীয় নেতা যিনি সোহরাওয়ার্দীর আর একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক চাতুরির বিরোধিতায় নেমেছিলেন। গান্ধিজি ১৯৪৭- এর ১২/১৩ অগস্ট বেলেঘাটায় ‘ হায়দারি মঞ্জিল’ বাড়িটিতে এসে ওঠার পর সোহরাওয়ার্দী শরৎচন্দ্র বসুকে নিয়ে Independent Sovereign Bengal এর জন্য গান্ধিজির আশীর্বাদ চাইতে এলেন,গান্ধিজি শ্যামাপ্রসাদকে ডেকে পাঠালেন। শ্যামাপ্রসাদ শান্তকন্ঠে গান্ধিজিকে বলেছিলেন -‘ সোহরাওয়ার্দীকে আপনি বলুন যে তিনি আপনার কাছে এই মর্মে লিখিত দলিল দিন-Independent sovereign Bengal Shall never acceed to pakistan ‘ গান্ধিজি সোহরাওয়ার্দীকে শ্যামাপ্রসাদের প্রস্তাবের জবাব দিতে বললে সোহরাওয়ার্দী ওই রকম দলিল দিতে অস্বীকার করলেন(মাই ডেইজ উইদ গান্ধি-নির্মলকুমার বসু,Gandhi the Last phase (vol-।।) – প্যারেলাল)।
অগস্ট আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা নিয়ে অনেক মিথ্যাচার আছে।বামপন্থীরা প্রায়শই বলে থাকেন যে শ্যামাপ্রসাদ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন।চলুন দেখা যাক এই অভিযোগ কতটা সত্য?
বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রসঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ লিনলিথগোকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন (১২.৮.৪২)” যে দাবী কংগ্রেসের বিগত প্রস্তাবে উত্থিত হয়েছে তা কার্যত সমগ্র ভারতবর্ষের জাতীয় দাবি।এই সংকটের সময় দমন কোনও প্রতিকার হতে পারে না।ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত হল মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে যোগাযোগ না করা, বিশেষ করে তিনি যখন পরিস্কারভাবে জানিয়েছিলেন যে সম্মানজনক মীমাংসার সব রকম চেষ্টা করার আগে তিনি আন্দোলন শুরু করবেন না।”
এই বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে ফজলুল হক সাহেবের Bengal Today গ্রন্থে।১৯৪২ সালের অগাস্ট আন্দোলনের সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের উপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছিলেন প্রকাশ্য জনসভায়।মেদিনীপুর থেকে ফেরার পথে শেষ রাতে কোলাঘাট স্টেশনে ট্রেনের মধ্যে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে গভর্নর sir john Herbert এর নির্দেশে।এই ইতিহাস এই প্রজন্মকে জানতে দেওয়া হয়নি।
নেহরু পূর্ব পাকিস্তান হতে আগত ছিন্নমূলদের পুনর্বাসনের প্রতি সম্পূর্ণভাবে উদাসীন ছিলেন।শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ সাহা,ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় নেহরুকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য জনবিনিময়ের কথা বলেন।কারণ বহু মুসলমান তখন পূর্ববঙ্গে ফিরে গিয়েছিলেন।কিন্তু এই ধরনের বেসরকারি জনবিনিময় দ্বারা নেহরু নিজের অলীক ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে রাজি ছিলেন না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অভিযোগ করেন যে,পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে জনবিনিময় ব্যবস্থা নেহরুই গ্রহণ করেছিলেন।কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে এখন কেন তিনি এই ব্যবস্থা বাতিল করলেন?আসলে নেহরু এই নীতির দ্বারা বিশ্বকে এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পূর্ণ নিরাপদ।শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন আসলে নেহরু পশ্চিমবঙ্গের অসহায় মানুষদের সমস্যা সমাধানের পথ বন্ধ করে কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পথ খোলা রাখতে চেয়েছিলেন।শ্যামাপ্রসাদ তীব্রভাবে নেহরুকে আক্রমণ করে বললেন, ” নেহরু পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের রক্ষা করলেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অসহায় ছিন্নমূল( হিন্দু) মানুষগুলোকে ঠেলে দিলেন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে”।
এরপর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ‘নেহরু – লিয়াকত’ চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।এই চুক্তিতে স্থির হয় যে-
(১) সংখ্যালঘুরা নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে এবং তার কাছেই প্রতিকার চাইবে( আধুনিক সি এ এ এর ভিত্তি এখানেই)।
(২) পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলা বা আসাম থেকে কেউ অন্য দেশে শরণার্থী হতে চাইলে তাকে সাহায্য করা হবে।
(৩) ভারত ও পাকিস্তান এই সমস্যার সমাধানের জন্য অনুসন্ধান কমিটি ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে।
(৪) পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি থাকবে।
বলাবাহুল্য এই চুক্তি পশ্চিমবাংলার মানসিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।শ্যামাপ্রসাদ এবং ক্ষিতিশ চন্দ্র নিয়োগী নেহরুর কাছে দাবী করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান কোনমতেই হিন্দু ছিন্নমূলদের প্রতি ন্যায়বিচার করবেনা।এককথায় তাহারা পাকিস্তান সরকারের সদিচ্ছার উপর সম্পূর্ণ অনাস্থা প্রকাশ করেন।কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার দুই বাঙালি সদস্য কিছুতেই বাঙালি ছিন্নমূলদের প্রতি নেহরুর উদাসীনতা মেনে নিতে পারছিলেন না।
তখন চারিদিকে উদ্বাস্তুদের হাহাকার।ছিন্নমূল মানুষরা নিজেদের পুনর্বাসনের দাবীতে চারিদিকে আন্দোলন করছেন।১৯৫০ সালের আগস্টের শেষের দিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গেলেন আসামে।সেখানে ছিন্নমূল মানুষেদের সাথে কথা বলতে। উদ্বাস্তু অসহায় মানুষগুলো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য শ্যামাপ্রসাদকে জানালেন তারা আর কিছুতেই পূর্বপাকিস্তান ফিরে যাবেন না।
শ্যামাপ্রসাদ এই তথ্য জানালেন নেহরুকে।কিন্তু নেহরু ছিলেন বাঙালি হিন্দুদের প্রতি উদাসীন। ১৯৫০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নিখিল ভারত উদ্বাস্তু দিবসে এক বিশাল জনসভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দিলেন জ্বালাময়ী বক্তৃতা। চলুন দেখি কি বলেছিলেন সেইদিন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় –
মূল বক্তব্য ( অপরিবর্তিত)
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন কাশ্মীর সম্পর্কে পণ্ডিত নেহরুর কড়া কথা ও নরম কাজের মধ্যে আমরা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাই না। তিনি বলিয়াছিলেন পাকিস্তান যদি ঠিকপথে না চলে, তবে তিনি অন্য পথ অবলম্বন করিবেন।লোকে মনে করিয়াছিল,শক্তির দ্বারা পূর্ববঙ্গের অত্যাচারের প্রতিবিধান হইবে।রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রতিষ্ঠান উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলিয়া যেভাবে তাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন,পণ্ডিত নেহরু কি মনে করেন- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেইরূপ ব্যবস্থা তাঁহারা অবলম্বন করিবেন?
ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ বলেন,ইংলন্ড অখণ্ড ভারত চাহে না। তাহারা জানে,ভারতবর্ষ যদি এক হয়,তাহা হইলে উহা এমন শক্তিশালী হইবে যে,পৃথিবীতে ভারতের বিরুদ্ধে কেহই দাঁড়াইতে পারিবে না।বিনাযুদ্ধে আক্রমণকারী পাকিস্তানকে কি করিয়া পণ্ডিত নেহরু কাশ্মীর হইতে বিতাড়িত করিবেন,আমরা বুঝিতে পারি না।আন্তর্জাতিক বিধান অনুসারে শত্রু রাষ্ট্রের সঙ্গে যে রূপ ব্যবহার করা উচিত,পাকিস্তানের সঙ্গে সেইরূপ ব্যবহার করিতে হইবে।কাশ্মীর সম্বন্ধে একরকম নীতি এবং পূর্ববাংলা ও অন্যান্য ব্যাপারে অন্য রকম নীতিগ্রহণ করা চলিবে না।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন ভারতের নিকট হইতে পাকিস্তান ষোল আনা সুবিধা আদায় করিতেছে।চুক্তির সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে আস্তে আস্তে হিন্দুশূণ্য করিয়া তাহারা কাজ হাসিল করিতে অগ্রসর হইয়াছে।ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বজায় থাকিবে আবার সামরিক সরঞ্জামও তাহারা সংগ্রহ করিবে।শ্যামাপ্রসাদ বলেন পণ্ডিত নেহরু স্বীকার করিয়াছেন, পূর্ববঙ্গে যে অত্যাচার হইয়াছে,তাহার সঙ্গে কাশ্মীরের ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ দিককে ক্রমাগত উত্তেজিত করিতেছে।পূর্ব- বাংলার গভর্নর ফিরোজ খান হিন্দুদের বিরুদ্ধে পূর্বে যে বিষোদগার করিয়াছেন,তাহাতে জগতের সামনে পাকিস্তানের মুখোস খুলিয়া গিয়াছে।যখন হিন্দুদের ঘরবাড়ী লুন্ঠন, মেয়েদের উপর অত্যাচার ও নির্বিচারে হিন্দুদিগকে হত্যা করা হয়,তখন পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের রক্ষার জন্য কিছুমাত্র সাহায্য করেন নাই; মাত্র সাত দিন পূর্বে চট্টগ্রামের অনেকগুলি গ্রাম পোড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে।একটি হিন্দু মেয়েকে জোর করিয়া মুসলমান এর সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হইয়াছে।যখন বলা হইল,দিল্লী চুক্তি অনুযায়ী মেয়েটিকে হিন্দুদের হাতে দেওয়া হউক, তখন ম্যাজিস্ট্রেট মন্তব্য করেন, প্যাক্ট আইন নহে।আজ পূর্ব-বঙ্গের হিন্দুসমাজ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।শিক্ষা ব্যবসার ও জীবনযাত্রার উপায় যদি না থাকে তবে পাকিস্তানে হিন্দুরা থাকিবে কি করিয়া? হুকুম দিলেই মানুষ সেখানে গিয়া বসবাস করিতে পারে না।যাহারা এইভাবে আদেশ দেন,তাহারা নিজেরা পাকিস্তানে গিয়া বসবাস করেন না কেন?
পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের বসবাসের উপায় নির্ধারণ করিয়া শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন আমি বলিয়াছিলাম এক একটি জেলা বাছিয়া নিন।কে কে ফিরিয়া যাইতে চায়,তাহার তালিকা করুন।ভারত,গভর্নমেন্ট তাহাদিগকে লইয়া গিয়া হিন্দুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করিয়া দিবেন।কিন্তু যতদিন সেখানে মুসলমান রাষ্ট্র থাকিবে ততদিন হিন্দুরা সেখানে থাকিতে পারিবে না।তাহাদিগকে রক্ষা করিবার দায়িত্ব ভারত গভর্নমেন্টকে গ্রহণ করিতে হইবে।সেই ব্যবস্থা যদি করা হয় তাহা হইলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানে ফিরিয়া যাইতে প্রস্তুত আছে।তাহারা চলিয়া আসিতেছে – কারণ মানুষ হিসাবে সেখানে থাকিতে পারিতেছে না।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন – পূর্ববঙ্গ হইতে আগত হিন্দুদিগকে যদি বাঙ্গলার বাহিরে প্রেরণ করিতে হয়,তবে এমন পরিকল্পনা তৈয়ারি করা উচিত যাহাতে নতুন জায়গায় তাহাদের শিক্ষা,সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রার প্রণালী অব্যাহত থাকে।আমরা চাই অখণ্ড ভারত।ছিন্নমূলরাও একত্র হতে চায়।
(১৯৫০) শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সংসদে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘…… নেহরু- লিয়াকত চুক্তি পূর্ব বাংলার হিন্দুদের কখনওই স্থায়ী নিরাপত্তা দিতে পারবে না…..।’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। congress working committee শ্যামাপ্রসাদের নিকট আবেদন রাখে তিনি যেন নিজ পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন।শ্যামাপ্রসাদ এই আবেদনে সাড়া দেন নি।
এরপরে জনসংঘের নেতৃত্ব গ্রহণ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিন্নমূলদের হয়ে লড়াই শুরু করলেন।জনসংঘের সভাপতি হিসাবে তিনি নেহরুর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। পাশে পেলেন ডাক্তার সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,শ্রী হেমন্তকুমার বসু এবং ডাক্তার মেঘনাদ সাহা প্রমুখকে।তাহারা স্মারকলিপি পেশ করেন নেহরুর নিকট।এই স্মারকলিপিতে লিপিবদ্ধ ছিল,পাকিস্তান যাতে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে তাহাদের নীতি পরিবর্তন করেন,সেই ব্যাপারে চাপ দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ জারী করা এবং পাকিস্তানের সাথে সমস্ত প্রকার ব্যবসা বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। তাছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন রেল স্টেশন ও স্টীমারঘাটে যে সহস্র ছিন্নমূল মানুষ আটকে পড়েছে এবং যাহারা পাসপোর্ট প্রবর্তনের ফলে আসতে পারছে না তাদের সমস্যার সমাধানের কথাও প্রতিনিধি দল জানায়।
১৯৫২ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সম্মেলনের আহবান করেন ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। উক্ত সম্মেলনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পাশে পেয়েছিলেন হুকুম সিং,ডাঃ চৈৎরাম গিদওয়ানীর মতো ব্যক্তিত্বকে। সম্মেলনের উদ্বোধন করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন যে,উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সম্পর্কিত ব্যাপারে তদন্ত করবার জন্য সরকার ও জনসাধারণ উভয়েরই আস্থাভাজন এইরূপ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা হোক।তিনি বলেন যে,উদ্বাস্তু সমস্যা কোনও স্বার্থসংশ্লিষ্ট দলের রাজনৈতিক চাল নয়,বস্তুতপক্ষে এটা একটি জাতীয় সমস্যা।এখনও লক্ষ লক্ষ লোক আশ্রয়ের সন্ধানে নানাস্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে,তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার সব দায়িত্ব সরকারেরই।এই সকল ব্যক্তি দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন।মুখোপাধ্যায় বলেন,জনমত গঠন করে চাপসৃষ্টি করে সরকারকে প্রয়োজনীয় কাজ করতে বাধ্য করতে হবে।একটি নির্দিষ্ট সময় সরকারকে দেওয়া হবে,তারমধ্যে সরকারকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।শ্যামাপ্রসাদ আরও বলেন যে,এ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪৫ লক্ষ উদ্বাস্তু এদেশে এসেছেন এবং এখনও সংখ্যালঘু(হিন্দু,বৌদ্ধ,শিখ,খ্রীস্টান) সম্প্রদায়ের প্রায় ৯০ লক্ষ লোক পূর্ববঙ্গে রয়েছেন,যারা এখনও আসে নি তাদের সম্পর্কেও মানুষের মনে দুশ্চিন্তা রয়েছে।তিনি সরকারের পুনর্বাসন সংক্রান্ত কাজের তীব্র সমালোচনা করেন।শ্যামাপ্রসাদ বলেন যে,যে সকল স্থান মানুষের কাজের অযোগ্য সেই সকল স্থানে নেহরু সরকারের উচিত নয় কাউকে প্রেরণ করা।প্রত্যেক উদ্বাস্তু যাতে সমান ক্ষতিপূরণ পান সেই বিষয়টি শ্যামাপ্রসাদ সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন।
কাশ্মীরে ভারত কেশরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে।ছিন্নমূল আন্দোলনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে এই মানুষটির নাম।২৪ শে জুন রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় স্মরণসভায় অশ্রুজলে স্মৃতিচারণ করেছিলেন অন্যতম প্রিয় ছাত্র শ্যামাপ্রসাদের।এর কয়েকদিন পরে The statesman পত্রিকার দিল্লির সংবাদদাতার একটি রিপোর্ট বের হয়-‘ বিব্রত কেন্দ্রীয় সরকার সেনেট হলের শোকসভায় রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় বক্তৃতার পূর্ণ বয়ান গোয়েন্দা দফতরের কাছে চেয়ে পাঠিয়েছেন।’
সন্দীপ মুখোপাধ্যায়…
তথ্যসূত্র- উদ্বাস্তু আন্দোলন ও পুনর্বসতিঃ অর্পিতা বসু।
জ্যোতি বসুকে চিনেছিলেন শ্যামাপ্রসাদঃ সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত।
আধুনিক ভারতঃ গৌতম বসু।
উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সমস্যাঃ গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী।