সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক কমরেডকে তো ভগৎ সিংয়ের ছবি নিজেদের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করতে দেখেছেন, এবং কমরেডদের নিরন্তর প্রচারের ফলে ভগৎ সিংও কমিউনিস্ট হয়ে গিয়েছেন। এবং বামপন্থী প্রোপাগান্ডার ফলে এটাও জানতে বাকী নেই সাভারকর একজন ব্রিটিশ দালাল ছিল, মুচলেকা দিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও উপেন ব্যানার্জি, বারীন ঘোষ, চন্দ্রশেখর আজাদের গুরু শচীন্দ্রনাথ সান্যাল সহ অনেকেই মুচলেকা দিয়েছিলেন, কেননা ঐটা একমাত্র উপায় ছিল আন্দামানের নরক থেকে বেরিয়ে আসার। কমরেডদের পিতামহ পি সি যোশী , অমৃত ডাঙ্গে সহ আরও অনেকে যে চল্লিশের দশকে মুচলেকা দিয়েছিলেন এবং রীতিমতো ব্রিটিশদের দালালী করেছিলেন সেটার প্রমাণ দেখালেই আবার কমরেডদের গাত্রদাহ শুরু হয়।
যাইহোক ,এবার আসল কথায় আসা যাক ।ভগৎ সিং এবং সাভারকর একে অন্যকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন।দুর্গাদাস খান্না স্বাধীন ভারতে পঞ্জাব বিধান পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম যৌবনে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামে, এবং এই সংগ্রামে তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন ভগৎ সিং। দিল্লির নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরীর আর্কাইভ ঘাঁটলে দুর্গাদাস খান্নার একটি রেকর্ড করা সাক্ষাৎকার পাওয়া যাবে, সেখানে দুর্গাদাস খান্না উল্লেখ করেছেন ভগৎ সিং এবং সুখদেবের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার কথা। যেখানে ভগৎ সিং হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিশনের নতুন সদস্যদের অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ করছেন “চিত্রগুপ্ত” নামক ছদ্মনামধারী একজন লেখকের একটি বই, ” লাইফ অফ ব্যারিস্টার সাভারকর”। সাভারকর অচ্ছ্যুত ছিলেন না ভগৎ সিং এর কাছে।
সাভারকরের লেখা “ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ 1857”,( যা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে নিষিদ্ধ ছিল) বইটির চতুর্থ সংস্করণ ভগৎ সিংএর হাতে এসেছিল। বস্তুত নিষিদ্ধ হলেও বিপ্লবী সংগঠনগুলো গোপনে বইটির প্রকাশনা এবং প্রচার করতেন। সাভারকরের লেখা থেকে ভগৎ সিং গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । এর পর লাহোরের দ্বারকাদাস লাইব্রেরী থেকে নিয়ে “চিত্রগুপ্তে”র লেখা সাভারকরের জীবনীটি ভগৎ সিং পড়ে ফেলেন। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার সময় ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ যে বইগুলো বাজেয়াপ্ত করেছিল,তার মধ্যে এই বইদুটিও ছিল।
আসলে ভগৎ সিং অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলন, আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সংগ্রাম এবং সাভারকরের বিপ্লবীজীবন থেকে।
ভগৎ সিংয়ের জেল ডাইরিতে সাভারকরের লেখা “হিন্দু পাদ পাদাশাহী” গ্রন্থের থেকে কিছু উদ্ধৃতি পাওয়া যায় ,ভগৎ সিংয়ের নিজের হস্তাক্ষরে , সেগুলোর মধ্যে কিছু দেওয়া হল।
” ১. আত্মবলিদান তখনই সমর্থনীয় যখন তা কিছু উদ্দেশ্য সাধিত করে। বিনা কারণে আত্মবলিদান আত্মহত্যার নামান্তর এবং মারাঠা রণনীতিতেএর কোনও স্থান নেই।
২. রাজনৈতিক দাসত্ব যে কোনও সময় ছুঁড়ে ফেলা যায়,কিন্তু সাংস্কৃতিক দাসত্বের শিকল ভাঙা খুব কঠিন।
৩. একসময় হিন্দুদের রণহুঙ্কার ছিল ” ধর্মান্তরিত হওয়ার থেকে মৃত্যুবরণ করা শ্রেয়।” কিন্তু চতুর্থ শিখগুরু রামদাস হুঙ্কার দিয়েছিলেন, ” আমরা মৃত্যুবরণ করব না বা ধর্মান্তরিত হব না, বরং যে শয়তানরা আমাদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করছে তাদের ধ্বংস করব।”
“মতওয়ালা ” পত্রিকার দুটি সংখ্যায় ( ১৫ নভেম্বর, ২২শে নভেম্বর ১৯২৬) ভগৎ সিং লেখেন ” সাভারকর শুধু রুদ্রের উপাসক নন, এই বিপ্লবী নায়কের আপাতকঠোর চেহারার পিছনে একটি সুকোমল হৃদয়ও রয়েছে।” সেই সুকোমল হৃদয়বৃত্তির পরিচয়ও ভগৎ সিং লিখেছেন ,” ১৯০৯এর পয়লা জুলাই মদনলাল ধিংড়া কার্জন উইলিকে হত্যা করলে যখন লন্ডনের প্রবাসী ভারতীয়রা ধিংড়াকে প্রকাশ্যে নিন্দায় রত হয়, এমনকি ধিংড়ার পিতা পঞ্জাব থেকে একটি টেলিগ্রামে জানান তিনি ধিংড়াকে ত্যজ্যপুত্র করছেন, সেই সময় একমাত্র সাভারকর তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন।”
সাভারকরের সম্পাদিত “শ্রদ্ধানন্দ” পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ ” দ্য রিয়েল মিনিং অফ টেরর” ১৯২৮ সালে ভগৎ সিং “কীর্তি” পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশ করেন। ভগৎ সিংয়ের সমর্থনে সাভারকর আর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, “আর্মড বাট টাইর্যানিক্যাল” ।
সাভারকরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বাবুরাও ১৯৩১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ওয়ার্ধায় মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, লর্ড আরউনের সঙ্গে গান্ধীর সাক্ষাতের ঠিক আগের দিন, উদ্দেশ্য , গান্ধী যদি ভাইসরয়ের কাছে ভগৎ সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসি রদ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু অহিংসার পূজারী বাপুর থেকে বাবুরাওকে খালি হাতে ফিরতে হয়। (সাভারকরের পক্ষে তখন রত্নগিরি ত্যাগ করা নিষিদ্ধ ছিল, সরকারের আদেশে)
১৯৩১এর ২৩শে মার্চ যেদিন ভগৎ সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসি হয়, সেদিন সাভারকরের রত্নগিরির আবাসভবনের ছাদে কালো পতাকা উড়তে দেখা গিয়েছিল।
রত্নগিরির শিশুরা একটি মিছিল বের করেছিল, কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল সাভারকরের লেখা একটি কবিতা
Go martyr
We take oath with testimony
The fight with arms is explosive
We are remaining behind you
We fight and win freedom
Hi Bhagat Singh, Hi Ha!!
পরিশেষে বলা যেতে পারে সাভারকরের দেশভক্তি নিয়ে তাঁর সঙ্গে একই সঙ্গে সেলুলার জেলে বন্দী সহবিপ্লবী, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, এমনকি সাভারকরের কট্টর সমালোচক পুলিনবিহারী দাশ তাঁদের আত্মজীবনীতে কোথাও সন্দেহ প্রকাশ করেননি।( পুলিনবিহারী সাভারকরকে অহঙ্কারী, বাঙ্গালী বিদ্বেষী এমনকি গুপ্ত সংগঠন চালানোর অনুপযুক্ত বললেও কোথাও ব্রিটিশদের পদলেহী বলেননি)
সাভারকরকে নিয়ে সেই কমিউনিস্টদেরই কুৎসা করতে দেখা যায় যারা পুরো চল্লিশের দশক জুড়ে ব্রিটিশ সরকারের দালালী করে গিয়েছে এবং মুসলিম লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে গিয়েছে।
কমিউনিস্টদের জনযুদ্ধের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নির্লজ্জভাবে ব্রিটিশদের দালালী করতে দেখে ঢাকা অনুশীলন সমিতির সভাপতি ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ( ইনিও আন্দামানে বন্দী ছিলেন) লিখেছেন ” একটা রাজনৈতিক দলের এরূপ স্বদেশদ্রোহীতা এবং জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ” এমনকি পরবর্তীতে স্ট্যালিন নিজে পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির ব্রিটিশ দালালীতে বিরক্ত হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র: 1. Savarkar, echoes from a forgotten past . Vikram Sampath.
Page 130-131. Penguin India
2.Savarkar. A Contested Legacy. Vikram Sampath. Page 144, 150-153. Penguin India.
- জেলে ত্রিশ বছর। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।
- বিপ্লবী পুলিন দাশ। সম্পাদক ভবতোষ রায়। গীতা পাবলিশার্স। ( পুলিনবিহারী দাশের আত্মজীবনী)
(বিক্রম সম্পতের সাভারকরের জীবনী,ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর আত্মজীবনীর অংশ এবং ফ্রন্টলাইন পত্রিকার অংশ দেওয়া হল।)
Pinaki Paul