বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে স্বদেশি-বয়কট আন্দোলনে উৎসাহিত হয়েছিলেন একদল বাঙালি৷ বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে হলে, বানচাল করে দিতে হবে লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা৷ সেদিন অবশ্য ইংরেজ বিরোধিতা করতে নেমে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলেন একদল বঙ্গসন্তান ৷
ইংরেজদের আঘাত করতে যেমন বিদেশি পণ্য ‘বয়কট’ এই আন্দোলনের অঙ্গ ছিল তেমনই তাঁরা নিজস্ব পণ্য উৎপাদন করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন৷ সেই সঙ্গে বেশ কিছু মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন কারখানা গড়তে ৷ অবশ্য স্বদেশি আন্দোলনের প্রাক্কালেই ব্রিটিশ সরকারের তাচ্ছিল্য আর দেশি বিদেশি চিকিৎসকদের অসহযোগিতা উপেক্ষা করেই ব্যবসায় নেমেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ৷ ফলে এই বিজ্ঞানীর উদ্যোগে ১৯০১ সালে ২৩,৩৭১ টাকা মূলধন নিয়ে বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড নামে এক সংস্থা আত্মপ্রকাশ করে আর ১৯১৫ সালে সেই মূলধন চারলক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায় ৷ সেদিন বাঙালির শিল্পবিমুখতা কাটাতে নিজেই এগিয়ে এসে ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছিলেন আচার্য।
১৮৬১ সালের ২অগস্ট বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাডুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মা ভূবনমোহিনী দেবী এবং পিতা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন ওই অঞ্চলের একজন জমিদার । তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় স্কুলে। তবে ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু তখন রক্ত আমাশায় আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে। ওই সময় বাধ্য হয়ে তিনি নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে থাকার এই সময়টা তাঁর জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। ওই সময় বাবার গ্রন্থাগারে থাকা বই পাঠ করে তাঁর জ্ঞানমানসের বিকাশসাধনে প্রভূত সহযোগিতা করেছিল।
১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র ফের কলকাতায় ফিরে গিয়ে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৮১ সালে এফএ পরীক্ষায় পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ পড়তে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সী থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান।
এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি বিএসসি পাশ করেন এবং ডিএসসি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তাঁর সেই গবেষণার বিষয় ছিল কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ। দু’বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করে পিএইচডি এবং ডিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। এমনকি তাঁর এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে ‘হোপ প্রাইজে’ ভূষিত করা হয়। এদিকে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় ১৮৮৫ সালে সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে ভারত বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে আচার্য দেশে ফেরেন। ফিরে প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। কিন্তু অধ্যাপনাকালে তার প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে তিনি নিত্য নতুন অনেক গবেষণাও চালিয়ে যান। তাঁর উদ্যোগে তার নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। তাঁর এই গবেষণাস্থল থেকেই এমন ভাবে কারখানার সৃষ্টি ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তাই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সমবায় ক্ষেত্রেরও পুরোধা ছিলেন স্যার প্রফুল্লচন্দ্র৷ ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।বেঙ্গল কেমিক্যালসের পাশাপাশি আচার্যের সহযোগিতায় লাভ করেছিল আরও বেশ কয়েকটি দেশিয় প্রতিষ্ঠান৷ যাদের মধ্যে ছিল বেঙ্গল পটারিজ, বেঙ্গল এনামেল, ক্যালকাটা সোপ ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারিজ মার্কেনন্টাইল মেরিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷
ব্যবসা করা মানে মুনাফা অর্জন করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করা এই দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন না আচার্য৷ জাতির মনে ব্যবসাপ্রীতি ঢুকিয়ে তিনি স্বনির্ভর করতে চেয়েছিলেন গোটা বাঙালিকে৷ বিলিতি ওষুধের রমরমা বাজারে দেশি ওষুধের প্রচার চালিয়েছিলেন তিনি। বন্ধু ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু থেকে শিষ্য রাজশেখর বসুকে নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানকে বড় করেছিলেন কখনই তা বাঙালিকে অর্থলোলুপ করার জন্য নয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় যখন অনেকেই নেহাৎ আবেগের বশে বা হঠাৎ শখ করে ব্যবসায় নেমেছিলেন তিনি অবশ্যই তাদের দলে ছিলেন না। প্রতিযোগিতার নিয়মকানুন বুঝে এবং বাজার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা করে ব্যবসার জগতে প্রবেশ করেছিলেন। ব্যবসায় টিকে থাকতে খরচ কমানোর প্রয়োজনীয়তা তিনি শুধু উপলব্ধিই করেননি তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাত্রাই সেই বার্তা বহন করে৷
বাঙালিকে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য তিনি ব্যবসা করতে বলেছিলেন ঠিকই৷ তবে ব্যবসা করলেও তাঁর বিজ্ঞানচর্চাও চলেছিল৷ তাই ১৮৯৫ সালে তাঁর আবিষ্কৃত মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২ টি যৌগিক লবন এবং ৫ টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। আচার্যের দেশপ্রেম তাঁকে ইউরোপে থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। দেশে এসেও তিনি তার সেই স্বদেশপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন নানা ভাবে। তাই সেই যুগেও তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ক্লাসে প্রয়োজনে বাংলায় লেকচার দিতে দ্বিধা করেননি। বাংলা ভাষা যে তাঁর অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিল। অথচ ইংরেজ চলে যাওয়ার পর স্বাধীন ভারতে আজকের বাঙালি হিন্দি আগ্রাসনের চাপে সেটাই যেভাবে অনুসরণ করছে তাতে বুঝিয়ে দেয় প্রফুল্লচন্দ্রের দেওয়া শিক্ষা আদৌ নিতে পারেনি বাঙালি৷