ক’ দিন আগে শিবপুরের ইতিহাসে ফার্স্ট ক্লাস গোল্ড মেডালিস্ট স্বর্ণালী সামন্ত এন আর এস-এ ডোমের চাকরির লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন বলে প্রচুর হৈ চৈ হয়েছিল । হওয়ারই কথা ।
তথ্য প্রকাশ্যে আসায় আমরা জানতে পেরেছিলাম মাত্র ৬ টি contractual পোস্টের জন্য ( যার মাইনে মাসে ১৫ হাজার) ৮ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে ১০০ জন ইঞ্জিনিয়ার, ৫০০ জন এম এ, এম এস সি, এম কম, ২২০০ জন স্নাতক । ক্লাস এইট পাশ হলেই চলবের পদে শেষ পর্যন্ত কার সুপারিশে বা কত লক্ষ টাকার বিনিময়ে কেউ ঢুকেছেন কি না আমরা কেউ জানি না ।
কিন্তু এই তথ্য গুলো বর্তমান বাংলার একটা জীবন্ত দলিল । খেলা, মেলা, উৎসব, ভাতা ভিক্ষের এই সরকার এভাবেই বাংলাকে রেখেছে এটাই সত্য । এগুলো চাকরি না দিলেও ভোট তো জোগাড় করে দেয় । এই সার মর্মটা বুঝে গেছেন নেত্রী মমতা । তাই আটকায় কে ?
একটা কাহিনী বলি ।
যেদিন নবান্নে বসে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের স্তুতি-সঙ্গীত গাইছিলেন ঠিক তার আগের রাতে সল্টলেকে বিকাশ ভবনের উল্টোদিকে সেন্ট্রাল পার্কের ৫ নম্বর গেটের সামনে হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে ১৮৭ দিন ধরে ধর্নায় বসে থাকা সাড়ে তিনশো হবু শিক্ষকদের অনশন ঘোর বর্ষার অন্ধকারে মেরে তুলে দিয়েছিল বিধান নগর পুলিশ । রিপাবলিক বাংলা ছাড়া সবাই চেপে গিয়েছিল সেই করুণ কাহিনী, কেউ রাগ করবেন বলে ।
লিখেছিলাম সেই ইতিহাস, ক দিন আগে, এই দেওয়ালে ।
পরের দিনের কাহিনীটা শুনুন আজ ।
ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া ধ্বংস স্তুপে সাড়ে তিনশোর প্রতিনিধি হয়ে ১৩ জন আবার জড় হয়েছিলেন পরের দিন, আগের রাতের মর্মান্তিকতার মৌন প্রতিবাদ করতে । হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে । মুহূর্তের মধ্যে বিধান নগর পুলিশ কলার ধরে, চুলের মুঠি টেনে, ঘাড় ধরে তাদের নিয়ে চলে যায় বিধান নগর নর্থ থানায় । রাত সাড়ে ন টা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে ৫ জন ছেলেকে ঢোকানো হয় গরাদের ভেতরে ।
বাকি আট জন মহিলাকে নিয়ে গিয়ে বিধান নগর পূর্ব থানার কয়েদি করা হয় । রাতে প্রায় ছুঁড়ে দেওয়া হয় কিছু পোড়া রুটি আরশুকনো তরকারি । তারপর…..
পরের দিন দুপুরে নিয়ে যাওয়া হয় কোর্টে ।
মেয়েদের তবুও জুটেছিল কিছুটা ভাত ডাল, ছেলেদের তাও দেওয়া হয়নি । সন্ধ্যের মুখে যখন তাঁরা জামিন পান, বাড়ি ফেরার সময়টুকুও তাদের পেরিয়ে গেছে কারুর, কারুর । সে রাতে কোথায় থাকলেন তাঁরা ? সংকোচে অনেকেই আর বলেননি সেই ইতিহাস । ফুটপাথে কি রাত কেটেছিল ? মাথা নীচু করে উত্তর এড়িয়েছেন অনেকেই ।
কারা এঁরা ? একবার তাকিয়ে দেখুন ।
১. পলাশ মন্ডল ( ইংলিশে এম এ, বি এড) বাড়ি সোনারপুর ২. তৃদীপ সুন্দর বাহাদুর ( এম এস সি ( অঙ্ক ) বি এড ) বাড়ি দুর্গাপুর ৩. লালটু মন্ডল ( বাংলায় এম এ, বি এড ) বাড়ি বাঁকুড়া ৪. পার্থপ্রতিম মন্ডল ( অঙ্কে এম এস সি, বি এড ) বাড়ি বসিরহাট ৫. প্রশান্ত বাউড়িয়া ( ইতিহাসে এম এ, বি এড ) ৬. লক্ষী পাল ( এডুকেশনে এম এ, বি এড) বাড়ি বনগাঁ ৭. মৌমিতা পাল ( রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এম এ, বি এড) বাড়ি হাওড়া ডোমজুড়ে ৮. মৌসুমী দাস ( এম এ, বি এড) বাড়ি বেহালা ৯. তৃণা হালদার ( জীবন বিজ্ঞানে এম এস সি, বি এড ) বাড়ি মধ্যমগ্রাম ১০. তোমা হোসেন ( ইংলিশে এম এ, বি এড ) বাড়ি দুর্গাপুর, ১১. প্রথমা মিত্র ( ভূগোলে এম এস সি, বি এড ) বাড়ি কল্যাণী ১২. রেখা রায় ,( ইতিহাসে এম এ, বি এড) বাড়ি, শ্যামপুর ১৩. কৃষ্ণা সরদার ( ইতিহাসে এম এ, বি এড) বাড়ি ঘটকপুকুর ।
এঁদের থেকে কম নম্বর পেয়েও এস এস সি র চাকরি জুটেছে অনেকের । এঁদের জোটেনি । এঁদের ২৭ মার্চ ২০১৯ মেও রোডে অনশন তুলিয়েছিলেন মমতা, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাখেননি । এমন সাড়ে তিনশো জনের প্রতিনিধি ছিলেন এই তেরো জন । সেদিন, সেরাতে ।
এরা প্রত্যেকেই কয়েদি হয়ে বিধান নগর উত্তর এবং পূর্ব থানায় সেই রাতটা কাটালেন । পোড়া রুটি, অবজ্ঞা, অপমান, অসম্মানকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধকার কুঠুরিতে জীবনের নিষ্ঠুরতম রাতটাকে খুব কাছ থেকে দেখলেন ।
তারপর দু দিন বাদে যখন ঘরে ফিরলেন টি ভি র খবর তখন দেখাচ্ছে এ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ত্রিপুরার খোয়াই থানায় বসে সে রাজ্যে গণতন্ত্র ফেরাতে প্রাণপন লড়াই করে যাচ্ছেন ।
১৮৭টা দিন বিকাশ ভবনের উল্টোদিকে এই শিক্ষা মন্ত্রীর দেখা পেতেই এঁরা দিন রাত একাকার করে ফেলেছেন ।
সেই মানুষটাকেই কত কাছে পেয়ে গেল ত্রিপুরা । কত ভাগ্যবান ওরা । ওরা মানে, ত্রিপুরা ।
আজ রাতে ঘুম না আসা চোখে এই দৃশ্যই হয়তো দেখছেন এঁরা, এঁরা মানে এঁরা, যাঁরা স্বপ্ন দেখেছিল পড়াশুনা শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পাওয়া যায় একটা চাকরি ।
শিক্ষকতার চাকরি ।
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮ )