টোকিও অলিম্পিকের  স্মৃতিশক্তি চিরকাল মনে থাকবে – ভারতের প্রকৃত নায়কদের প্রণাম

“বিন্দু থেকে সিন্ধু” কথাটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অদম্য সাহসিকতা , লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ় প্রত্যয়, ইচ্ছাশক্তি, প্রবল ধৈর্য্য ।খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দিতে প্রাচীন গ্রীসের অলিম্পিয়া থেকে শুরু হওয়া প্রাচীন অলিম্পিক গেমস থেকেই মূলত আধুনিক অলিম্পিক গেমসের ধারণা জন্মে। ১৮৯৪ সালে ব্যারন পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁ সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) গঠন করেন। এই আইওসি-ই অলিম্পিক গেমস সংক্রান্ত সকল কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অলিম্পিক  হলো একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যেখানে গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা বিভিন্ন ধরনের খেলায় অংশগ্রহণ করে।১৯০০  সালের পর থেকে অলিম্পিক গেমসে ভারত এখনও পর্যন্ত ৩৫  টি পদক জিতেছে।

প্রথমে আমস্টারডাম এ অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে  ,১৯২৮ সালে ভারতীয় হকি টিম পাঁচ ম্যাচে মোট ২৯ টি গোল করে , এবং হকির জাদুকর ” ধ্যানচাঁদ” একাই ১৪ টি গোল করেছিলেন ও ফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন এবং ফলে ভারতবর্ষের মুকুটে একটি স্বর্ণপদক যোগ হল। 

লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক ,১৯৩২ সাল , ভারতীয় হকি টিমের দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্সে ভারতবর্ষের ইতিহাসে আরোও একটি স্বর্ণপদক যুক্ত হল। প্রতিপক্ষ USA , রুপ সিং একাই ১০ টি গোল দিলেন , রুপ সিং ধ্যানচাঁদ এর ছোট ভাই ।
ফলস্বরুপ আরোও একটি স্বর্ণপদক প্রাপ্তিলাভ ঘটল।

বার্লিন অলিম্পিক, ১৯৩৬ , ধ্যানচাঁদ তখন ভারতীয় হকি টিমের ক্যাপ্টেন। ভারতীয় হকি টিম পাঁচ ম্যাচে ৩৮ টি গোল করেছিল , ফাইনালে প্রতিপক্ষ জার্মানি , প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ৮-১ এ জয়ী হল ভারত। ভারতীয় হকি টিমের হ্যাটট্রিক ও ক্যাপ্টেন ধ্যানচাঁদ এর ও অলিম্পিক এর ইতিহাসে দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক , গৌরবের ইতিহাস রচিত হল ।

উপরের তিনটি ম্যাচ ছিল স্বাধীনতার পূর্বের গৌরবান্বিত ইতিহাস , বিশ্বগুরু হিসেবে পথচলার শুভ সূচনা শুরু হয়েছে , বিপ্লবী আন্দোলনে ইংরেজ সরকার দিশাহীন। আসুন দেখে নিই স্বাধীনতা পাওয়ার পরে প্রথম অলিম্পিক গেমস ভিলেজে ভারতীয় হকি টিমের পারফরম্যান্স।

লন্ডন অলিম্পিকস , ১৯৪৮ সাল, ভারতীয় হকি টিমের চতুর্থ স্বর্ণ পদক প্রাপ্তি, তবে খুশি আরোও বেশি , কারণ ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। একটা নতুন নাম শোনা গেল , বলবীর সিং, একাই ১৯ টি গোল করেছেন, তিন ম্যাচে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ আয়োজক দেশ গ্ৰেট ব্রিটেন , ৪-০ পয়েন্টে ভারতীয় হকি টিম বিজয়ী ঘোষণা হল। আবার এই অলিম্পিক এ ভারতীয় ফুটবল টিমের প্রতিপক্ষ ফ্রান্স , কিন্তু ভারতীয় ফুটবল দলের কোনো খেলোয়াড়ের পায়ে জুতো দেখা গেল না , অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ় প্রত্যয় এর জন্য খালি পায়েও শক্তিশালী ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও ১ গোল দিয়েছিল ভারত , হয়তো সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির অপূর্ণতার জন্য ভারতীয় ফুটবল দল বিজয়ী হয়নি কিন্তু তাঁরা সকল দেশবাসীর মনে চিরতরে জায়গা করে নিয়েছিল ।

১৯৫২ সালের সামার অলিম্পিক, খাশাবা যাদব, প্রথম ভারতীয় কুস্তিগীর , ব্রোঞ্জ পদক জিতলেন , ভারতের কুস্তির ইভেন্টে অংশগ্ৰহণ ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করল। এই অলিম্পিকেই প্রথমবার ভারত থেকে দুজন মহিলা অংশগ্রহণ করেছিলেন, নিলিমা ঘোষ ও মেরি ডি সুজা। একইসঙ্গে পঞ্চম স্বর্ণ পদক প্রাপ্তি ভারতীয় হকি টিমের ।

১৯৫৬ , মেলবোর্নে অলিম্পিকস, ভারতীয় ফুটবল দল চতুর্থ স্থানে তাদের যাত্রা শেষ করলেও , তাদের অংশগ্ৰহণ ভারত কে অলিম্পিক এর ফুটবল ইভেন্টেও পরিচিত করে তুলল। নেভিল ডি সুজা প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হ্যাট ট্রিক করেছিলেন।

অলিম্পিকস, ১৯৬০ সাল , মিলখা সিং ,একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়, ৪০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতার রেকর্ড ভাঙলেন, কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকায় ০.১ সেকেন্ড এর জন্য ব্রোঞ্জ পদক হারালেন কিন্তু ভারতীয় হকি টিম রোম গেমসে রূপোর পদক জিতেছিল এবং প্রতিপক্ষ পাকিস্তান বিজয়ী হয় , ম্যাচটি ১-০ তে জিতে যায় পাকিস্তান। প্রায় জেতার অবস্থায় এসেও ভারতীয় হকি দল হেরে গিয়েছিল , কিন্তু বিজয়রথ তার স্বর্ণ জয়যাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলছিল , আর তার ফল পাওয়া গেল পরের অলিম্পিকস এ।

টোকিও অলিম্পিকস , ১৯৬৪ , ভারতীয় হকি টিমের স্বর্ণ পদক প্রাপ্তি, প্রতিপক্ষ গতবারের বিজয়ী পাকিস্তান, ১-০ পেনাল্টি  গোলে বিজয়ী ভারত। সেমি ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া ।

১৯৬৮, মেক্সিকো অলিম্পিক, স্পেন জাপান কে হারিয়ে সেমি ফাইনালে উঠলেও ২-১ গোলে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যায়, কিন্তু ফাইনালে ভারতীয় হকি টিমের প্রতিপক্ষ এবার মেক্সিকো , কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় হকি টিম দ্বিতীয় স্থানে এই অলিম্পিক শেষ করে।

মূনিচ অলিম্পিক, ১৯৭২ , ভারতীয় হকি টিমের দ্বিতীয়বার ব্রোঞ্জ পদক প্রাপ্তি।

১৯৮০ সাল, মস্কো অলিম্পিক, ভারতীয় হকি টিমের দুরন্ত জয়, স্বর্ণ পদক প্রাপ্তি হল । অত্যন্ত প্রশংসনীয় সেই পারফরম্যান্স ও টিম স্পিরিট। ১৯২০  থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ভারত হকিতে মোট আটটি স্বর্ণ পদক পায়।

১৯৮৪ , লস এঞ্জেলেস অলিম্পিকে, পিটি ঊষা ৪০০ মিটার হার্ডলস ফাইনালে করে ০.০১ সেকেন্ডে ব্রোঞ্জ পদক হারান।

১৯৯৬ অলিম্পিক , লিয়েন্ডার পেজ ভারতের দ্বিতীয় অলিম্পিক পদক জয়ী ,  আটলান্টায়  টেনিস প্রতিযোগিতায়  ব্রোঞ্জ জিতলেন – ৪৪ বছর পরে।

১৯৯৮, নাগানো অলিম্পিক, শিবা কেশবন শীতকালীন অলিম্পিক এর ” Luge” ইভেন্টে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন , এরপর থেকে তিনি প্রায় প্রতিটি অলিম্পিকেই অংশ নিয়েছিলেন।

২০০০ সাল, সিডনী অলিম্পিক – কর্ণাম মল্লেশ্বরী – অলিম্পিক পদক জয়ী প্রথম ভারতীয় মহিলা। ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপের ৬৯  কেজি বিভাগে  ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন।

২০০৪  সাল, এথেন্স অলিম্পিক গেমস,  ১৭৯ পয়েন্ট অর্জনের পর রাঠোর একটি রৌপ্য পদক জিতেছিলেন, এটি দেশব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি অলিম্পিকে একটি ব্যক্তিগত ইভেন্টে ভারতকে প্রথম রৌপ্য পদক উপহার দেন।

২০০৮ অলিম্পিক, বেজিং , অভিনব বিন্দ্রা ১০ মিটার এয়ার রাইফেল শ্যুটিং এ ভারতকে প্রথম স্বর্ণপদক উপহার দেন । বিজেন্দর সিং, প্রথম ভারতীয় বক্সার হিসেবে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করলেন । সুশীল কুমার ভারত্তোলন বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতলেন।

২০১২ , লন্ডন অলিম্পিকস,ভারতকে খেলার জগতে বিশ্বের দরবারে আরোও  পরিচিতি ঘটার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের পতাকাবাহক ছিলেন সুশীল কুমার , ২০১২ এর অলিম্পিক গেমস এ ভারতের প্রতিটি মানুষের আশা তাঁকে ঘিরে ছিল , ফল পাওয়া গেল হাতে-নাতে , ৬৬ কেজী ভারত্তোলন বিভাগে রূপোর পদক উপহার দিলেন। ২৫ মিটার পিস্তল শ্যুটিং এ বিজয় কুমার রৌপ্য পদক উপহার দিলেন। মেয়েদের বক্সিং বিভাগে মেরী কম ব্রোঞ্জ পদক উপহার দিলেন। যোগেশ্বর দত্ত, ৬০ কেজী ভারত্তোলন বিভাগে ব্রোঞ্জ পদক জিতলেন, তিনি  নর্থ কোরিয়া এর  রি জং মিয়ং কে ১ মিনিট ২ সেকেন্ড এ পরাজিত করেন। সাইনা নেওয়াল ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে ব্রোঞ্জ পদক ভারত কে উপহার দিলেন।

২০১৬ সালে,রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকে ব্যাডমিন্টনে রৌপ্য পদক জিতেছিলেন পি.ভি.সিন্ধু। রিওতে ৫৮ কেজি রেসলিংয়ে ব্রোঞ্জের পদক জেতার প্রথম ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীর হলেন সাক্ষী মালিক।দীপা কর্মকার অলিম্পিকে ভারতের প্রথম মহিলা জিমন্যাস্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তিনি রিওতে প্রদুনোভা ভল্টে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিলেন।

২০২০ ,এই বছরের টোকিও অলিম্পিকে, মিরাভাই চানু মহিলাদের ৪৯ কেজি ভারোত্তোলনে রৌপ্য পদক জিতেছিলেন। এটি তার প্রথম অলিম্পিক পদক এবং মল্লেশ্বরীর পর তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় ভারোত্তোলক হিসেবে ভারতকে অলিম্পিক পদক জেতান।পিভি সিন্ধু প্রথম ভারতীয় মহিলা এবং সুশীল কুমারের পরে দ্বিতীয় ভারতীয় ক্রীড়াবিদ – যিনি দুটি পৃথক অলিম্পিক পদক জিতেছিলেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া টোকিও গেমসে তিনি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন।রবি কুমার দাহিয়া পুরুষদের ৫৭ কেজি ফ্রি স্টাইল কুস্তি, টোকিও ২০২০ তে রৌপ্য পদক জিতেছেন। এটি অলিম্পিক ইতিহাসে ভারতের নবম রৌপ্য পদক এবং কুস্তিতে দ্বিতীয় রৌপ্য পদক। ভারতীয় হকি দল এই বছর দীর্ঘদিনের খরা কাটিয়ে  ৪১ বছর পর ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছে । কুস্তিগীর বজরং পুনিয়া টোকিও ২০২০ তে পদক জেতার ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানাধিকরী হন। পুরুষদের ৬৫  কেজি কুস্তিতে তাঁকে ব্রোঞ্জ দেওয়া হয়। তিনি প্লে অফে কাজাখস্তানের দৌলেট নিয়াজবেকভকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জিতলেন। গোল্ডেন বয় নীরজ চোপড়া ভারতের দ্বিতীয় স্বতন্ত্র অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন – অভিনব বিন্দ্রার পরে, তিনি জ্যাভলিন থ্রো এই ইভেন্ট স্বর্ণ পদক অর্জন করলেন।লভলিনা বোরগোহেন মেয়েদের ৬৯ কেজী তে  ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করলেন। এবারের মেয়েদের হকি টিমের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই ক’দিন অলিম্পিক নিয়ে ভারতের সাধারণ মানুষ যা আগ্রহ দেখিয়েছেন, সেটাই বোধহয় এবারের অলিম্পিকের সবথেকে সেরা পাওয়া। পুরো দেশের মানুষ ভারত-ইংল্যান্ড ক্রিকেট টেস্ট না দেখে, অলিম্পিক দেখেছেন। দেশের জন্য গলা ফাটাচ্ছেন। টুইটারে আক্ষরিক অর্থেই প্রতি মুহূর্তে কয়েককোটি টুইটের বন্যা হচ্ছে। রেডিও, টিভি, স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার যে যাতে পারছেন, খেলা দেখেছেন।মেয়েদের হকি নিয়ে কোন সিনেমা নয়, বাস্তবে সিনেমার থেকেও ইন্সপায়ারিং ইতিহাস লেখা হচ্ছে।টোকিও অলিম্পিকের  স্মৃতিশক্তি চিরকাল মনে থাকবে।

।।সপ্তর্ষি।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.