এ বছরের ২৮ জুন জম্মু-কাশ্মীরকে নিয়ে ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় যে আলোচনা হলো তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাশ্মীরকে নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন এনডিএ সরকার আগামী পাঁচ বছর কোন পথে হাঁটতে চলেছে তার একটা আভাস পাওয়া গেল এই বিতর্কে। বিশেষত সংবিধানের ৩৭০ ধারা সম্পর্কে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিজেপির নীতি এবং কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘এক দেশ এক আইন নীতি’। এই নীতিকে অনুসরণ করেই বিজেপি সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি চেয়েছে প্রথম থেকেই। জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সংগ্রাম এবং আত্মবলিদানের প্রধান কারণই ছিল কাশ্মীরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার বিরোধিতা এবং এর অবলুপ্তির দাবি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে দিল্লির ক্ষমতায় দ্বিতীয়বারের জন্য অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সকলের তাই আগ্রহ ছিল ৩৭০ ধারা নিয়ে কেন্দ্রের নীতি এবার কোন পথে চলবে। অমিত শাহের বক্তব্যে তারও আভাস পাওয়া গেল। ৩৭০ ধারা নিয়ে এবার সত্যিই নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হবে। সমগ্র দেশ এগোচ্ছে ‘এক দেশ এক সংবিধান’-এর পথেই। এই প্রসঙ্গেই নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে সংবিধানের ৩৭০ ধারাটিকেনিয়ে। এই ধারাটির প্রকৃত সাংবিধানিক মর্যাদা, এর গুরুত্ব এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে। কাশ্মীরের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা বাদ দেওয়া যায়, কারণ ৩৭০ ধারা তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু এদেশের ‘বাম-কংগ্রেস ব্যবস্থা’-র ফসল বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশও যেভাবে ৩৭০ ধারাকে প্রায় একটি চিরন্তন সাংবিধানিক ব্যবস্থা বলে ধরে নিয়েছেন তার বাস্তবতা কতটুকু? সংবিধানের একটি বিশেষ ব্যবস্থা কখনো অলঙ্ঘনীয়, চিরন্তন হতে পারে? আজ তারই উত্তর খুঁজবো।
১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীর ভারতভুক্ত হয়। তা না হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে জম্মু-কাশ্মীরকে রক্ষা করতে হস্তক্ষেপ করা সদ্য স্বাধীন ভারতের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিজের রাজ্যকে রক্ষা করা প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতে যোগ না দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা মহারাজা হরি সিংহের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। একারণেই হরি সিংহের ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত এবং একারণেই ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবরের সেই বহু আলোচিত ‘The Instrument of Accession of Jammu and Kashmir to India.’ এই প্রেক্ষপটেই সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে নিয়ে আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ২১তম অংশে নিহিত এই ধারা জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য কতগুলি বিশেষ সুবিধার বন্দোবস্ত রেখেছে। যেমন :
প্রথমত, ভারতের ‘পার্টি বি’ রাজ্যগুলির জন্য সৃষ্ট সংবিধানের ২৩৮ ধারা জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য ছিল না, যদিও ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারী কার্যকরী হওয়া ভারতীয় সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মীর ‘পার্টি বিভুক্ত একটি রাজ্য ছিল। ১৯৫৬ সালে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর পর এই ধারটির আর অস্তিত্ব নেই। দ্বিতীয়ত ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভার আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা সেই সমস্ত কেন্দ্রীয় এবং যুগ্ম তালিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ যা Instrument of Accessionএ সুনির্দিষ্ট করা আছে। তৃতীয়ত, ভারতীয় সংবিধানের ১নং ধারা (সেখানে ভারতকে একটি ‘union of state’বলে ঘোষণা করা হয়েছে) এবং ৩৭০ ধারা জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ অন্য রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে যেমন কেবল সংবিধানের ১নং ধারাটি প্রযোজ্য, জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ১নং ধারার সঙ্গে ৩৭০ ধারাটিও প্রযোজ্য। চতুর্থত, উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলি ছাড়াও সংবিধানের অন্যান্য ধারাগুলি কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে যদি ভারতের রাষ্ট্রপতি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের সম্মতিসাপেক্ষে তা প্রয়োগ করেন। পঞ্চমত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভারতের রাষ্ট্রপতি এই সঙ্গে ঘোষণা করতে পারেন যে, ৩৭০ ধারাটি কার্যকরী করা হবে না’ (ceses to be operative) কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে এবং সংশোধিত উপায়ে প্রয়োগ করা হবে (operates with exceptions and modifications)। রাষ্ট্রপতি কেবল রাজ্যের Constituent Assembley-এর পরামর্শ অনুযায়ী তা করতে পারেন।
এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে জম্মু ও কাশ্মীরের ভারতভুক্তির সঙ্গে সংবিধানের ৩৭০ ধারাটির প্রত্যক্ষ যোগ থাকলেও এই ধারাটিকে কখনোই চিরন্তন কিংবা অপরিবর্তনীয় ভাবা হয়নি। তা যদি ভাবা হতো তবে এই ধারা কার্যকরী না করা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে এবং সংশোধিত উপায়ে প্রয়োগ করা’–এই ব্যবস্থা ভারতীয় সংবিধানে রাখা হতো না। সর্বোপরি সংবিধানের ৩৭০ ধারাটিকে রাখা হয়েছে ২১তম অংশে যা সংবিধান অনুযায়ী টেম্পুরারি বা অস্থায়ী transitional বা পরিবর্তনশীল এবং special বা বিশেষ। ৩৭০ ধারাটিকে স্থায়ী হিসেবে যদি কল্পনা করা হতো তবে কখনোই তাকে ২১তম অংশের অস্থায়ী পরিবর্তনশীল, বিশেষ ব্যবস্থাগুলির অন্তর্ভুক্ত করা হতো না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ৩৭০ ধারাটিকে কখনোই ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তার একাধিক রায়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অপরিবর্তনীয় নিয়ে যে মত প্রকাশ করেছেন এবং সংবিধানের যে অংশগুলোকে তার অন্তর্ভুক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে ৩৭০ ধারা তার অন্তর্ভুক্ত নয়।
৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ে। কিন্তু ইতিহাস স্থিতিশীল নয়। ইতিহাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার গতিশীলতা একবিংশ শতকে গোটা বিশ্বের সমীহ আদায় করছে এক শক্তিশালী ভারত। ঐক্যবদ্ধ দেশই হয় শক্তিশালী দেশ। সেখানে দেশের মধ্যেই এক ধরনের অনৈক্যের ভাবনা জন্ম দেয় যে ধারা তাকে আর কতদিন বয়ে চলা হবে সে নিয়ে ভাবনারও সময় এসেছে। ৩৭০ ধারাকে হাতিয়ার করে কিছু সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল তাদের খেলা’ চালিয়ে যাবে সেটা দেশের মানুষের পক্ষে আর বেশিদিন মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না।
বিমল শঙ্কর নন্দ
2019-07-12