ময়দান ফিরে পাক হারানো গরিমা

বঙ্গ রাজনীতিতে পালা বদলের ইঙ্গিত মেলার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতা ময়দান রাজনীতিতেও এবার লাগতে চলেছে পালা বদলের হাওয়া। ময়দানের তথাকথিত বড় ক্লাবগুলো থেকে পাড়ার ক্লাবগুলোতেও শাসক দলের প্রভাব চলছে অবাধ গতিতে। বছরে ২ লক্ষ টাকা অনুদান তো আর হেলাফেলা করার মতো ব্যাপার নয়। তার জন্য রাতারাতি ক্লাব তৈরি হয়ে গেল অনেক জায়গায়। সেই ক্লাবগুলো শাসক দলের ঘনিষ্ঠ নেতার প্রভাবিত। তাতে গুনতিতে ক্লাব বাড়ানো গেল আবার ব-কলমে ক্লাব অনুদান দেওয়ার নামে নিজের দলের লোকেদের ছড়িয়ে দেওয়া গেল। যাঁরা পাড়ায় পাড়ায় রীতিমতো অলিখিত প্রতিপত্তি চালাতে লাগলেন। নিয়মের তোয়াক্কা না করে দুর্নীতির বেনোজল প্রবেশ করাতে লাগলেন ক্লাব ও সংস্থাগুলোর অন্দরে। আর একদিকে ময়দানের প্রায় সব ক্লাবগুলোর বা সংস্থাগুলোর শীর্ষপদে বসে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রীর দাদা-ভাইরা। কোথাও বা ব-কলমে ক্লাবগুলোর সব কতৃত্বই চলে গেল ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং-এর হাতে। এ ব্যাপারে খুব সম্প্রতি এক বড় ক্লাব নির্বাচনের উদাহরণ টানা যেতে পারে। সেই ক্লাবের শাসন ক্ষমতা কোন দিকে থাকবে এটা বুঝতে এক কর্তার লেগে গিয়েছিল প্রায় মাস চারেক। আসলে ক্লাবের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর শীর্ষে ছিলেন আবার শাসক দলের দুই মন্ত্রী। সেই মন্ত্রীদের মধ্যে কে দিদিমণির খুব কাছের এটা বুঝতে ব্যয় করে ফেললেন অনেকটা সময়। আবার যেইনা বোঝা অমনি রাতারাতি ডিগবাজি খেয়ে দিদিমণি ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীগোষ্ঠীতে নাম লেখালেন। কিন্তু ততদিনে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।
শাসক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার একটা খেলা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে এই রাজ্যে। প্রশাসনের রং পরিবর্তন হলেও খেলা বন্ধ হয়নি। বামজমানায় কোনো কোনো ক্রীড়াসংস্থা বা ক্লাবগুলোর শীর্ষস্থানে যেমন ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বা ক্ষিতি গোস্বামী বা কান্তি গাঙ্গুলিরা পাশাপাশি সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি ঘনিষ্ঠ দু-একজন নেতাও ছিলেন শীর্ষস্থানে। এ জমানায় আবার এসবের বালাই নেই। প্রায় সমস্ত সংস্থার ভিতরেই ঢুকে পড়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর দাদা-ভাইরা। সর্বত্রই বিরোধীশূন্য করে রাখার এই প্রচেষ্টা ঢুকে পড়েছে ময়দানেও। যে ময়দানকে বলা হয় এখানে কেউ আলাদা নয়, এখানে একটাই মন্ত্র খেলা-ধূলার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠুক সমন্বয়। তবে এই বিরোধীশূন্য মানসিকতায় ময়দানে লাভের থেকে ক্ষতি হচ্ছে অনেক বেশি। কারণ ঘৃণ্য রাজনীতি আর যাই করুক খেলাধূলার সার্বিক উন্নয়নের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন পড়ে তা জোগান দিতে পারে না। ক্যাডার তৈরির স্বার্থে বা জনসমর্থন নিজেদের দিকে ধরে রাখতে গেলে বছরে ২ লক্ষ টাকা করে দিতে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে তা একাধারে যেমন ঘুর পথে জনগণের করের টাকা, তেমনই ২ লক্ষ টাকায় কোনো খেলারই সার্বিক পরিকাঠামো গড়া যায় না। তাই সেই টাকা দিয়ে ক্লাবগুলোকে দিয়ে মেলা বা ফাংশন করানো গেলেও দলগত বা ব্যক্তিগত স্তরে খেলোয়াড় তৈরি করানো যায় না। আর ময়দানের গুটিকয় বড় দল যারা খেলাধুলোর জন্যই জনপ্রিয় তাদের তো আবার এই ২ লক্ষ টাকায় চিড়েও ভেজে না। আবার সরাসরি টাকার জোগান প্রসাশন করে দিতে পারে না। একইভাবে এঁকে, ওঁকে, তাকে স্পনসর হিসাবে পেতে গেলেও সমস্যা। কারণ তারা আবার কোন্দলের ঘনিষ্ঠ সেটা বুঝে তবেই মাঝে মধ্যে স্পনসর মেলে। আর এভাবে দীর্ঘদিন চলে আসতে আসতে ময়দানের বাকি ক্লাবগুলো নিজেদের অজান্তেই অবক্ষয়ের পথে পা দিয়ে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠিত ২ বা ১টি ক্লাব ছাড়া কারো সেভাবে স্পনসর নেই, আবার একইভাবে সব ক্লাবে গৌরী সেনও নেই, যাঁরা শুধুমাত্র শখ মেটাতে টাকা ঢেলে যাবেন দিনের পর দিন। ময়দানের ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্লাবগুলো প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। সেখানে মুষ্টিমেয় কর্মকর্তারা আড্ডার আসর বসালেও খেলাধুলো প্রায় বন্ধ হবার পথে। অনেক ক্লাবই ময়দানের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই তবে বাজি ধরে একথা বলা যায় তাদের কেউই স্বচ্ছন্দে নেই। এমনই এক ক্লাবের কর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলছিলেন সবার তো আর প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ক্ষমতা নেই তাই তারা আজ ব্রাত্য। ক্রীড়া সংস্থাগুলোরও প্রায় একই হাল। কোথা থেকে আসবে টাকা? কে করবে সঠিক পরিকল্পনা? কিছু কর্মকর্তা আবার এরই মাঝে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন। অনেকে আবার ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো অবস্থান করছেন। হাওয়া বুঝে জ্বলে উঠবেন। কেউ কেউ আবার আশায় বুক বাঁধছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতা ধরে রাখা বিজেপি রাজ্যেও যথেষ্ঠ ভালো ফল করায়। তাদের আশা যদি এমন কোনো ক্রীড়াপ্রেমী নেতা এসে হাল ধরেন ময়দানের। বর্তমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছেন কেউ কেউ। তবে এটুকু হলপ করে বলা যায় এদের বেশির ভাগই সুবিধাবাদী। পরিশেষে একটা কথা বলতে হবে, যদি সত্যিই কোনো পরিবর্তন হয়, তাঁরা যেন ৫০, ৬০ বা ৭০ দশকের মতো প্রকৃত ক্রীড়াপ্রেমীদের এই সব জায়গার শীর্ষে নিয়ে আসেন। এমন কোনো ব্যক্তিত্বের হাতে তুলে দেওয়া হোক ব্যাটন, যাতে তাদের হাত ধরেই ময়দান ফিরে পায়া হারানো গরিমা।
অনামিকা দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.