সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবি, কেবল সাম্প্রতিককালেই বিজেপির তোলা ইস্যু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী মানুষ এই দাবি তুলে আসছেন। সম্প্রতি লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই মনের কথাই তুলে ধরেছেন। বিরোধীদের দাবি ছিল জম্মু-কাশ্মীরকে অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে সমদৃষ্টিতে দেখলে চলবে না, কারণ সংবিধানের ৩৭০ ধারা বলে এই রাজ্যটি বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা পায়। প্রত্যুত্তরে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন সংবিধানের এই ধারাটি সাময়িক’, ‘স্থায়ী নয়। শাহের এই বক্তব্যকে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা স্বাগত জানিয়েছেন।
ভারতের সংবিধান প্রণেতা ড. বি. আর. আম্বেদকর সংবিধানের ৩৭০ ধারার খসড়া তৈরি করতে অস্বীকার করেন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কাশ্মীরি নেতা শেখ আবদুল্লাকে পরামর্শ দেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আম্বেদকরের সঙ্গে কথা বলে এমন সুবিধে যুক্ত কোনও আইন তৈরি করতে যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। পরে ৩৭০ ধারার খসড়া তৈরি করেন গোপাল স্বামী আয়েঙ্গার। এই ৩৭০ ধারার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তার দৃঢ় অভিমত ছিল যে এই ধারাটি জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এরই বিরোধিতা করতে গিয়ে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, চক্রান্তকারী ছিলেন ওই শেখ আবদুল্লা।
শুধু জম্মু-কাশ্মীর নয়, ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগের সময় অনেক প্রিন্সলি স্টেট ই ভারতে যোগ দিয়ে ভারতের সংবিধানকেই মেনে নিয়েছিল। তাহলে জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো কেন? এমনিতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অপরিণামদর্শিতায় খণ্ডিত জম্মু-কাশ্মীরের অধিকার ভারত পেয়েছিল। কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংহের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মর্যাদা দেয়নি ক্ষমতালোলুপরা। তাই ৩৭০ ধারা নামক একটি সাংবিধানিক গাজর নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যতই গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, অখণ্ড ভারতের দিকে দৌড়নো যাক না কেন তা অধরাই থেকে যাবে।
সংবিধানের একুশতম অংশ যেখানে ৩৭০ ধারার খসড়া রয়েছে তাতে এটিকে সাময়িক (টেম্পোরারি), পরিবর্তনশীল (ট্রানজিশনাল) ও বিশেষভাবে অস্থায়ী (স্পেশাল প্রভিশনাল) বলে বর্ণনা করা রয়েছে। এই ধারার বলে জম্মু-কাশ্মীর দীর্ঘদিন ধরে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য’-এর মর্যাদা পেয়ে আসছে। ফলে সাংবিধানিকভাবে ভারতের নিয়ন্ত্রণ জম্মু-কাশ্মীরে কায়েম না হওয়ার ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ, ভারত বিরোধিতা সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে, কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের বিতাড়নের মতো ঘটনা ঘটছে। ভারতের আর্থিক সমৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে একদিকে কাশ্মীরে ভারতবিরোধীরা অর্থনৈতিক ফায়দা লুটছে, অন্যদিকে পাকিস্তান ও চীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। আর এর মূলে রয়েছে সংবিধানের ৩৭০ ধারা।
হুরিয়ত কনফারেন্সের মতো মধ্যস্থতাকারী গোষ্ঠীগুলি আসলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। ৩৭০ ধারা এদের বলীয়ান করেছে। একদিকে আলোচনার টেবিলে ভারতে নিয়ে যেতে অন্যদিকে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের বুকে পাক-সন্ত্রাস অব্যাহত রাখারও পথ খুলে দিতে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা হচ্ছে, ১৯৫৬ সালে বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্যগুলি যখন সংবিধানের ২৩৮ ধারা বিলোপের মধ্য দিয়ে পুনর্গঠিত হয়ে দেশের সংবিধানকেই মেনে নিল, জম্মু-কাশ্মীর কিন্তু ৩৭০ ধারার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল। দেশের অখণ্ডতার পক্ষে এই প্রবণতা ভয়ংকর।
এই বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে জম্মু-কাশ্মীরে দেশের সাংবিধানিক বিধি কায়েম করতে, ‘এক দেশ, এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধান’-এর নীতিকে কার্যকর করতে ৩৭০ ধারার অন্তরায়কে অপসৃত করাটা খুবই জরুরি এবং সেই দৃঢ়তার কথাই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন। লোকসভায় জম্মু-কাশ্মীর সংরক্ষণ (সংশোধন) বিল, ২০১৯ এনে ওই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনকে আরও ছ’মাস বর্ধিত করেছে কেন্দ্র সরকার। কেন্দ্র যে গণতান্ত্রিক, মুক্ত ও ভয়শূন্য পরিবেশে সেখানকার মানুষকে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের সুযোগ করে দিতে বদ্ধপরিকর, অমিত শাহ তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
নেহরুর ভুলে গলায় কাটার মতো আটকে থাকা কাশ্মীর ভারতের প্রতিরক্ষা বা বিদেশ নীতির ক্ষেত্রেই কেবল সমস্যা-জর্জর নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বিপজ্জনক। তাই যতক্ষণ ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় মূলস্রোতের সাংবিধানিক ধারা যতক্ষণ না কায়েম হবে ততদিন কাশ্মীর গলার কাটা হয়েই থাকবে।
অভিমন্যু গুহ
2019-07-12