ঈশ্বর-অবিশ্বাসী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের | কেমন ছিল দুই কিংবদন্তির সাক্ষাৎ ? জানতে ফিরে যেতে হবে ১৩৩ বছর আগে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে …

ঈশ্বর-অবিশ্বাসী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের | কেমন ছিল দুই কিংবদন্তির সাক্ষাৎ ? জানতে ফিরে যেতে হবে ১৩৩ বছর আগে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে …

বিদ্যাসাগর মহাপণ্ডিত |
তিনি ষড়দর্শন পাঠ করেছেন |
জানতে চেয়েছেন ঈশ্বরকে | আর এইটুকু বুঝতে পেরেছেন যে‚ ঈশ্বরের বিষয়ে কিছুই জানা যায় না |
শ্রীরামকৃষ্ণ তাকালেন বিদ্যাসাগরের দিকে | যেন বুঝতে পারলেন বিদ্যাসাগরের মনের কথা | বললেন‚ ব্রহ্মবিদ্যা ও অবিদ্যার পার | তিনি মায়াতীত |
মহাপণ্ডিত বিদ্যাসাগর শুনছেন মুগ্ধ বিস্ময়ে |

বলে চলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ —

এই জগতে বিদ্যামায়া-অবিদ্যামায়া দুই আছে | জ্ঞান-ভক্তি আছে | আবার কামিনীকাঞ্চনও আছে | সৎ-ও আছে | আবার অসৎ-ও আছে | ভাল আছে | আবার মন্দও আছে | কিন্তু ব্রহ্ম নির্লিপ্ত | ভাল-মন্দ জীবের পক্ষে | সৎ-অসৎ জীবের পক্ষে | ব্রহ্মের ওতে কিছু হয় না |

বিদ্যাসাগর বললেন‚ একটু ব্যাখ্যা করে‚ আরও সহজ করে বুঝিয়ে দিন |

শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ সরল হাসি হেসে বললেন‚ প্রদীপ যেমন নির্লিপ্ত‚ ব্রহ্মও সেইরকম | প্রদীপের সামনে কেউ ভাগবত পড়ছে আর কেউ বা জাল করছে | প্রদীপের তাতে কিছু যায় আসে না | কোনও কাজটির সঙ্গেই প্রদীপ যুক্ত হচ্ছে না | সে নির্লিপ্তভাবে শুধু জ্বলছে | যদি বলো দুঃখ‚ পাপ‚ অশান্তি এ সকল তবে কী ? তার উত্তর এই যে ওসব জীবের পক্ষে | ব্রহ্ম নির্লিপ্ত | যেমন ধরো সাপের মধ্যে বিষ আছে | অন্যকে কামড়ালে মরে যায় | সাপের কিন্তু কিছু হয় না |

বিদ্যাসাগরের মুখে রা নেই | তিনি ক্রমে বুঝতে পারছেন‚ এক নিরক্ষর ব্রাহ্মণের মুখে বেদান্ত কী সহজ সরল ভাষায় উচ্চারিত হচ্ছে !
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন‚ ব্রহ্ম যে কী মুখে বলা যায় না |
সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে।
বেদ‚পুরাণ‚ তন্ত্র‚ ষড়দর্শন‚ সব এঁটো |
থামলেন শ্রীরামকৃষ্ণ | তাকালেন বিদ্যাসাগরের মুখের দিকে |
বিস্মিত বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন‚ এঁটো কেন ?
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে উত্তর দিলেন‚ মুখে পড়া হয়েছে‚ মুখে উচ্চারণ হয়েছে‚ তাই এঁটো হয়ে গেছে |
কিন্তু একটি জিনিস কেবল উচ্ছিষ্ট হয়নি গো !
সেই জিনিসটি ব্রহ্ম |
ব্রহ্ম যে কী‚ আজ পর্যন্ত কেউ মুখে বলতে পারেনি |
বিদ্যাসাগরের বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল |
আবেগে কাঁপছে তাঁর শরীর |
শ্রীরামকৃষ্ণ বয়েসে অনেক ছোট‚ তবু বিদ্যাসাগরের ইচ্ছে হল তাঁর কাছে নতজানু হওয়ার |
তিনি শুধু কম্পিত কণ্ঠে বললেন‚ আজ একটি নতুন কথা শিখলাম |
ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হননি !

ঘরে তখন অনেক মানুষের ভিড় হয়ে গেছে |
সবাই শুনছে ঠাকুরের কথা |
কী সহজ‚ কী প্রাণস্পর্শী‚ কী গভীর !
ঠাকুর কী অনায়াসে আড়াল সরিয়ে দিচ্ছেন !
ফুটে উঠছে নতুন আলো |
জাগ্রত হচ্ছে নব চেতনা |
উদ্ঘাটিত হচ্ছে সত্যের মুখ |
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন‚ এবার একটা গল্প বলছি‚ শোনো |
এক বাপের দুটি ছেলে |
ব্রহ্মবিদ্যা শেখবার জন্যে ছেলে দুটোকে বাপ আচার্যের হাতে দিলেন |
কয়েক বছর পরে তারা গুরুগৃহ থেকে ফিরে এল |
এসে বাপকে প্রণাম করলে |
বাপের এবার ইচ্ছে হল‚ এদের ব্রহ্মজ্ঞান কেমন হয়েছে একটু বাজিয়ে দেখবার |
বড় ছেলেকে জিগ্যেস করলেন‚ বাপ ! তুমি তো সব পড়েছো | ব্রহ্ম কীরূপ বলো দেখি |
বড় ছেলেটি বেদ থেকে নানা শ্লোক বলে বলে ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝাতে লাগল |
বাপ শুনলেন | কোনও কথা বললেন না | বড় ছেলে বাপের মনের ভাব বুঝতে পারল না |
এবার ছোট ছেলেকে বললেন‚ তুমি বলো দেখি ব্রহ্মের কী রূপ ?
ছোট ছেলের মুখে কোনও কথা নেই |
সে হেঁট মুখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল |
বাপ প্রসন্ন হয়ে ছোট ছেলেকে বললেন‚ বাপু‚ তুমি একটু বুঝেছো | ব্রহ্ম যে কী তা মুখে বলা যায় না |
শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ থামলেন। তিনি জানেন‚ সাধারণ মানুষকে তাঁর কথার মর্ম বুঝতে একটু সময় দিতে হয় |
তারপর তাঁর গল্পের সূত্রটি ধরেই বললেন‚ মানুষ মনে করে আমরা তাঁকে জেনে ফেলেছি |
কিন্তু সত্যি কি জানা যায় ?
জানা গেলেও কতটুকুই বা জানা যায় তাঁকে ?
বিদ্যাসাগর নিবিষ্ট হয়ে শুনছেন | আর অপলক তাকিয়ে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে | আর কারও কথা শুনে কখনও এমন ঘোর লাগেনি তাঁর |
শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের মুখের দিকে তাকিয়েই বললেন‚ আর একটা গল্প বলছি শোনো |
একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ে গিছলো |
এক দানা খেয়ে পেট ভরে গেল | আর এক দানা মুখে করে সে বাসার পথে চলেছে |
যাবার সময় ভাবল‚ এবার এসে সব পাহাড়টা নিয়ে যাব |
ক্ষুদ্র জীবেরা এইসব মনে করে |
জানে না ব্রহ্ম বাক্যমনের অতীত !
যে যতই বড় হোক না কেন‚ তাঁকে জানা যায় না |
বিদ্যাসাগর হঠাৎ বলে ফেললেন‚ কেন শুকদেব ? তিনি তো …
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বললেন‚ শুকদেবাদি না হয় ডেঁও পিঁপড়ে |
চিনির আট-নটা দানা না হয় মুখে করেছে | তার বেশি নয় |
ঘরে এত মানুষ | তবু পিন পড়লে শব্দ পাওয়া যাবে |
রোজ কত পণ্ডিত মানুষের আসা-যাওয়া বিদ্যাসাগরের বাড়িতে |
কিন্তু এমন জীবন্ত বেদান্ত কখনও দেখিনি ! শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনছেন আর ভাবছেন বিদ্যাসাগর |

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতে লাগলেন‚ তবে বেদে পুরাণে যা বলেছে‚ সে কী রকম বলা জানো ?
বিদ্যাসাগর বুঝলেন‚ ঘরের মধ্যে আর কেউ না বুঝুক তিনি অন্তত ধারণা করতে পারলেন‚ শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হতে চলেছে বেদ ও পুরাণ !
তিনি উদগ্রীব হয়ে শুনছেন |
ঠাকুর বললেন‚ একজন সাগর দেখে এলে কেউ যদি জিগ্যেস করে‚ কেমন দেখলে‚ সে লোক মুখ হাঁ করে বলে‚ — ও ! কী দেখলুম ! কী হিল্লোল‚ কল্লোল |
ব্রহ্মের কথাও সেই রকম | বেদে আছে তিনি আনন্দস্বরূপ | সচ্চিদানন্দ |
বিস্মিত বিদ্যাসাগর | শ্রীরামকৃষ্ণ বেদ পড়েছেন!
তিনি তো নিরক্ষর |
বিদ্যাসাগর কী ভাবছেন‚ শ্রীরামকৃষ্ণ যেন বুঝতে পারলেন |

বললেন‚ শুকদেবাদি এই ব্রহ্মসাগর-তটে দাঁড়িয়ে দর্শন স্পর্শন করেছিলেন মাত্র |
তাঁরা কিন্তু ব্রহ্মসাগরে নামেননি | এ সাগরে নামলে আর ফেরবার জো নেই গো |
ঠাকুরের কথায় চমকে উঠলেন বিদ্যাসাগর | এতো একেবারে নতুন কথা |
অথচ কী অবলীলায় কথাটি বললেন পরমহংস !
বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন তাহলে ব্রহ্মাণ্ডজ্ঞান হওয়ার উপায় ? ঠাকুর উত্তর দিলেন‚ সমাধিস্থ হলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় |
সেই অবস্থায় বিচার একেবারে বন্ধ হয়ে যায় |
মানুষ চুপ হয়ে যায় |
ব্রহ্ম কী বস্তু‚ মুখে বলবার শক্তি থাকে না | শ্রীরামকৃষ্ণ আর একটা গল্প বললেন—-
নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিছলো | কত গভীর জল সেই খবরটা সে দিয়ে চেয়েছিল | কিন্তু খবর দেওয়া আর হল না। যেই নামল জলে অমনি গেল গলে | কে আর খবর দেবে ? একজন প্রশ্ন করলেন‚ সমাধিস্থ ব্যক্তি যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে তিনি কী আর কথা কন না ?

বিদ্যাসাগরকে চমকে দিল ঠাকুরের বিদ্যুতের মতো উত্তর

শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য বিদ্যার ‘আমি’ রেখেছিলেন | বিদ্যাসাগর এই কথার গভীর অর্থটুকু বুঝতে পারলেন | আপাত অশিক্ষিত একটি মানুষের জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও গভীরতা দেখে তিনি স্তম্ভিত !
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার আরও সহজ করে তাঁর বক্তব্যের সারাৎসার তুলে ধরলেন—-
ব্রহ্মদর্শন হলে মানুষ চুপ হয়ে যায় | যতক্ষণ দর্শন না হয়‚ ততক্ষণই বিচার তেমনি সমাধিত পুরুষ—-লোকশিক্ষা দেবার জন্য আবার নেমে আসে আবার কথা কয় |
বিদ্যাসাগরের চোখে একইসঙ্গে ফুটে ওঠে মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা |
তাঁর মন বলে ওঠে ‚ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস সেই পুরুষ তো তুমি নিজে | সমাধিস্থ হয়েও লোকশিক্ষার জন নেমে এসেছো‚ কথা বলছো !
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার ব্রহ্মজ্ঞানীর স্বরূপ অন্যভাবে ফুটিয়ে তোলেন্—
যতক্ষণ মৌমাছি ফুলে না বসে ততক্ষণ ভনভন করে‚ ফুলে বসে মধুপান করতে আরম্ভ করলে চুপ হয়ে যায় | মধুপান করে মাতাল হবার পরে আবার কখনও-কখনও গুনগুন করে |
পুকুরে কলসিতে জল ভরার সময় ভকভক শব্দ হয় | পূর্ণ হয়ে গেলে আর শব্দ নেই | তবে আর এক কলসিতে যদি ঢালাঢালি হয় তাহলে আবার শব্দ হয় |

একজন হঠাৎ বললেন‚
ঋষিদের কি ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল ?
শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন‚ হ্যাঁ হয়েছিল | বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না | ঋষিরা দেখা-শোনা-ছোঁয়া এসবের বিষয় থেকে মনকে আলাদা রাখত | সমস্ত দিন ধ্যান করে কাটত | তবে ব্রহ্মকে বোধে বোধ করত | এবার সরাসরি বিদ্যাসাগরের দিকে তাকালেন ঠাকুর | বললেন‚ কলিতে অন্নগত প্রাণ | দেহ বৃদ্ধি যায় না | যারা বিষয় ত্যাগ করতে পারে না‚ তাদের ‘আমি’ কোনওভাবে যায় না |
তাদের বরং ‘আমি ব্রহ্ম’ না বলে বলা উচিত আমি ভক্ত‚ আমি দাস |
এ অভিমান ভাল |
ভক্তিপথে থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায় | বিদ্যাসাগরকে যেন সরাসরি বলছেন ঠাকুর—-জ্ঞানীর পথও পথ | আবার জ্ঞান-ভক্তির পথও পথ | আবার ভক্তির পথও পথ |
জ্ঞানযোগও সত্য | ভক্তির পথও সত্য | সব পথ দিয়েই তাঁর কাছে যাওয়া যায় |
কিন্তু যতক্ষণ তিনি ‘আমি’ রেখেছেন আমাদের মধ্যে ততক্ষণ ভক্তিপথই সোজা |

শ্রীরামকৃষ্ণ এবার যেন শুধু বিদ্যাসাগরকেই দেখছেন | তিনি এই মহাপণ্ডিতকে বললেন‚ বিজ্ঞানী কী বলে ? বিজ্ঞানী বলে‚ যিনি ব্রহ্ম‚ তিনিই ভগবান |
অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি |
ব্রহ্ম নির্গুণ | তিনি গুণাতীত | ভগবান ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ |
এই জীবজগৎ‚ মন বুদ্ধি‚ বৈরাগ্য‚ জ্ঞান‚ এসব তাঁর ঐশ্বর্য |
দেখো না এই জগৎ কী চমৎকার | কত রকম জিনিস‚ চন্দ্র‚ সূর্য‚ নক্ষত্র | কত রকম জীব | বড় ছোট ভালমন্দ কারু বেশি শক্তি‚ কারু কম শক্তি | ব্রহ্মই ভগবান হয়েছেন | যিনি নিরাকার‚ তিনিই সাকার | যিনি নির্গুণ তিনিই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ |

বিদ্যাসাগর হঠাৎ প্রশ্ন করলেন তিনিই কি কাউকে বেশি শক্তি‚ কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন ?
উত্তর দিলেন পরমহংস—তিনি বিভুরূপে সর্ব ভূতে আছেন | বিভু মানেই তো পরমেশ্বর | আবার বিভু মানে সর্বব্যাপী |
পিঁপড়ের মধ্যেও তিনি আছেন। আবার বিরাট পাহাড়ও তারই প্রকাশ | সর্বত্র তিনি |
কিন্তু শক্তির তারতম্য তো আছেই | ঠাকুর এবার বিদ্যাসাগরকেই বললেন—-এই যেমন তুমি |
তোমাকেই বা সবাই মানে কেন ?
তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো ?
তোমাকে মানে তার কারণ তোমার দয়া‚ তোমার বিদ্যে আছে অন্যের চেয়ে অনেক বেশি |
তুমি একথা মানো কি না ?
বিদ্যাসাগর লজ্জা পেলেন | তিনি মৃদু মৃদু হাসছেন |
শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরকে বললেন—-একঘর লোকের সামনে বিদ্যাসাগরকে একথা বলার সাহস কারও হত না—- ঠাকুর বললেন শুধু পাণ্ডিত্যে কিছু হয় না | মনে রেখো‚ তাঁকে জানবার জন্যেই বই পড়া | তাঁকে জানাই একমাত্র জানা | তাঁকে জানাই সব জানা আর সব অবিদ্যা |
এবার প্রশ্ন করলেন বিদ্যাসাগরকে‚ গীতার অর্থ কী ?
কী বলবেন বিদ্যাসাগর ? গীতার অর্থ এককথায় বলা যায়? চুপ করে থাকলেন বিদ্যাসাগর |
বললেন শ্রীরামকৃষ্ণ‚ গীতার অর্থ দশবার ‘গীতা’ বলতে যা হয় তাই | দশবার ‘গীতা’ বলতে গেলে গেলে ত্যাগী হয়ে যায় |
গীতার শিক্ষা হল‚ হে জীব সব ত্যাগ করে ভগবানকে লাভ করার চেষ্টা করো |
সাধুই হও‚ আর সংসারী হও‚ মন থেকে সব আসক্তি ত্যাগ করতে হবে |
এবার বিদ্যাসাগরের দিকে তাকালেন শ্রীরামকৃষ্ণ | ঘরে যেন আর কেউ নেই | বললেন‚ অনেক পড়লেই কিছু হয় না গো | অন্তরের কথাটি বুঝতে হবে | শুধু পাণ্ডিত্য নয় | ভক্তি চাই | তাঁকে ভালবাসতে হবে | তোমাকে একটা গপ্পো বলছি | গল্পটা বুঝতে পারলে সব হবে।

চৈতন্যদেব তখন দক্ষিণে তীর্থভ্রমণ করছিলেন | দেখলেন একজন গীতা পড়ছে আর একজন একটু দূরে বসে শুনছে আর কাঁদছে। কেঁদে চোখ ভেসে যাচ্ছে | চৈতন্যদেব জিগ্যেস করলেন‚ তুমি এসব বুঝতে পারছো ? সে বললে‚ ঠাকুর‚ আমি এসব শ্লোক কিছুই বুঝতে পারছি না।
চৈতন্যদেব জিগ্যেস করলেন তবে কাঁদছো কেন ?

ভক্তটি তখন বললে‚ আমি দেখেছি অর্জুনের রথ | আর তাঁর সামনে কৃষ্ণ | আর অর্জুন কথা কচ্চেন |
তাই দেখে আমি কাঁদছি | বিদ্যাসাগরের বুকের শিরায় টান ধরল | তাঁর চোখ ভরে এল জলে | মন ভরে গেল গভীর কৃতজ্ঞতায় | নতুন চেতনায় উত্তীর্ণ হলেন তিনি !

বিদ্যাসাগরকে বলতে লাগলেন শ্রীরামকৃষ্ণ | মনে মনে বিদ্যাসাগর নতজানু‚ করজোড় | শুনছেন তিনি | নিষ্কম্প শিখার মতো |ঠাকুর বলতে লাগলেন– তাঁকে কি শুকনো পাণ্ডিত্য দিয়ে বিচার করে জানা যায় গো ? তাঁর দাস হয়ে তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁকে ডাকো |
মনে রেখো‚ ‘আমি’ ও ‘আমার’‚এই দুটি অজ্ঞান |
আমার বাড়ি‚ আমার টাকা‚আমার বিদ্যা‚আমার এইসব ঐশ্বর্য‚এই যে ভাব‚ এটি অজ্ঞান থেকে হয় | আর যদি ভাবো‚হে ঈশ্বর‚তুমিই কর্তা‚এসব জিনিস তোমার‚টাকাকড়ি‚ আমার বিদ্যা‚আমার ঐশ্বর্য‚আমার পরিবার‚সব কিছুই তোমার‚আমার বলতে কিছুই নেই—-এই ভাব জ্ঞান থেকে হয় |
বিদ্যাসাগর‚তোমার কোন ভাব গো ? হঠাৎ জানতে চাইলেন ঠাকুর | বিদ্যাসাগর কিছুটা অপ্রস্তুত | খুব মৃদু স্বরে বললেন‚ আপনাকে সেকথা একলা একদিন বলব | ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে এবার তাঁর অন্তরকথা‚তাঁর নিজস্ব ভাবটি বলার জন্য গান ধরলেন—-

কে জানে কালী কেমন?
ষড়দর্শনে না পায় দরশন |
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন|
কালী পদ্মবনে হংস সনে‚হংসী রূপে করে রমণ | |
আত্মরাগের আত্মাকালী প্রমাণ প্রণবের মতন |
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন | |
মায়ের উদরে ব্রক্ষাণ্ডভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জান কেমন |
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম অন্য কে বা জানে তেমন |
প্রসাদ ভাসে লোকে হাসে‚সন্তরণে সিন্ধু তরন |
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না ধরবে শশী হয়ে বামন |

গান শেষ করে শুধু একটি কথা বললেন শ্রীরামকৃষ্ণ‚ষড়দর্শনে না পায় দর্শন‚পাণ্ডিত্যে তাঁকে পাওয়া যায় না গো | এরপর ঠাকুর কিছুক্ষণ সমাধিস্থ | চেতনায় ফিরে এসে জিগ্যেস করলেন‚কটা বাজে গো ? বিদ্যাসাগর বললেন‚ রাত ৯টা। এবার যে উঠতে হবে | ফিরতে হবে সেই দক্ষিণেশ্বরে। শ্রীরামকৃষ্ণকে বিদায় দিতে মন চাইছে না বিদ্যাসাগরের | কেন তাঁর এমন হল ? ঠাকুর লাবণ্যময় কণ্ঠে বিদ্যাসাগরকে বললেন‚একবার বাগান দেখতে যেও | রাসমণির বাগান | ভারী চমৎকার জায়গা |

বিদ্যাসাগর-যাবো বৈ কি ! আপনি এলেন আর আমি যাব না ?
শ্রীরামকৃষ্ণ -আমার কাছে ! ছি…ছি !
বিদ্যাসাগর- সে কী ! এমন কথা বললেন কেন ? আমার বুঝিয়ে দিন |
শ্রীরামকৃষ্ণ(সহাস্যে)-আমরা জেলেডিঙ্গি | খালবিল‚ আবার বড় নদীতেও যেতে পারি | কিন্তু তুমি তো জাহাজ গো | কী জানি যেতে গিয়ে চড়ায় পাছে লেগে যায় | বিদ্যাসাগর চুপ | উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না|শ্রীরামকৃষ্ণই এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগরকে উদ্ধার করতে | বললেন‚তবে এই সময়ে জাহাজও যেতে পারে | বিদ্যাসাগর ইঙ্গিতটি ধরতে পারলেন | হেসে বললেন‚হ্যাঁ‚এটা বর্ষাকাল বটে | মহেন্দ্রগুপ্ত টিপ্পনি কাটলেন‚এতো নবানুরাগের বর্ষা | নবানুরাগের সময় মান-অপমান বোধ থাকে না বটে |

শ্রীরামকৃষ্ণ ইতিমধ্যে উঠে পড়েছেন | তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামছেন | একজন ভক্তের হাত ধরে আছেন | বিদ্যাসাগর আগে আগে চলেছেন | বাতি হাতে পথ দেখাচ্ছেন তিনি |
শ্রাবণকৃষ্ণাষষ্ঠী | এখনও চাঁদ ওঠেনি | দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে | বাতাস ভিজে ভিজে‚মিঠে | বাতাসে ভেজা ঘাস-পাতা-মাটির সুবাস | তমসাবৃত উদ্যানভূমির মধ্যে দিয়ে চলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ | বাতির ক্ষীণালোক বহন করে ফটকের সামনে বিদ্যাসাগর | শ্রীরামকৃষ্ণ ফটকে পৌঁছতেই সামনে এসে দাঁড়াল এক গৌরবর্ণ‚শ্মশ্রুধারী‚বাঙালি পোশাক-পরা যুবক | যুবক শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করল |
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন‚বলরাম ! তুমি এখানে এত রাতে ?
বলরাম-আমি অনেক্ষণ এসেছি | এখানেই দাঁড়িয়েছিলাম |
শ্রীরামকৃষ্ণ- ভেতরে যাওনি কেন ?
বলরাম-আজ্ঞে‚সকলে আপনার কথাবার্তা শুনছেন‚সেখানে গিয়ে বিরক্ত করিনি |

শ্রীরামকৃষ্ণ এবার তার ভাড়া করা ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়লেন | বিদ্যাসাগর প্রায় চুপি চুপি মহেন্দ্রকে জিগ্যেস করলেন‚ভাড়া কি দেব ?
মহেন্দ্র বললেন ‚আজ্ঞে না | ও হয়ে গেছে | বিদ্যাসাগর ঘোড়ার গাড়ির দরজায় এগিয়ে গেলেন | তাঁর হাতে বাতিটি ধরা | বাতির ক্ষীণালোকে ঠাকুরের মুখটি দেখলেন | তাঁর সমস্ত অন্তর লুটিয়ে পড়ল শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীচরণে এক দীর্ঘায়িত প্রণামে |
শ্রীরামকৃষ্ণের গাড়ি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বিদ্যাসাগরের দৃষ্টি থেকে | তিনি একা ঠাকুরের প্রস্থানের পথের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন |
তাঁর মনে হল‚ ভগবান এসেছিলেন | এক ঝলক দেখা দিয়ে চলে গেলেন | তারই আশীর্বাদ হয়ে যেন স্বর্গ থেকে নেমে এল ঝিরঝিরে বৃষ্টি ! বৃষ্টির জলে নিভে গেল বিদ্যাসাগরের হাতের বাতিটি | অন্ধকারে একা বিদ্যাসাগর |
রামকৃষ্ণ-ধারায় কতদিন পরে এমনভাবে প্রাণ জুড়াচ্ছে তাঁর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.