“ওঁ ইতি ব্ৰহ্মং। ওঁ ইতি ইদং সর্বং।।”

পরমাত্মার শ্রেষ্ঠ নাম “ॐ” এবং আমাদের অবহেলা
সৃষ্টির পর থেকে দিন যত গড়িয়েছে, সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমূহ বিদ্যুৎ গতীতে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক অনেক মুনি ঋষি নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে শাস্ত্র রচনা করেছেন। এতে সনাতন ধর্মের জ্ঞান ভাণ্ডার যেমন পরিপূর্ণ হয়েছে, তেমনি এত এত শাস্ত্রগ্রন্থ অশিক্ষিত মানুষের হাতে গিয়ে খুব বাজে ভাবে নিজের স্বরূপ হারিয়ে বিকৃতিও হয়েছে। আর এই কারণেই আজ ঈশ্বরের নাম নিয়েও চলছে বিভেদ। আমি এই আর্টিকেলে সনাতন ধর্মীয় প্রধান শাস্ত্র (বেদ, উপনিষদ, গীতা) সমূহ থেকে ঈশ্বরের নামের বর্ণনা দিতে চেষ্ঠা করব। বাস্তবে ঈশ্বরের নামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার শক্তি আমার নেই। এমন কোন শাস্ত্রও নেই যা ঈশ্বরের নামের মাহাত্ম্য বলে শেষ করতে পারে। এই লিখাটি ঈশ্বরে চরণে (রূপক অর্থে নিবেদন মূলক ভাবে ‘চরণ’ শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে) আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
“ওঁ ইতি ব্ৰহ্মং। ওঁ ইতি ইদং সর্বং।। অর্থাৎ ওঁ ই ব্ৰহ্ম, ওঁ ই অনন্ত, ওঁ ই এই সমস্ত কিছু।” তৈত্তিরীয় উপনিষদের এই আপ্তবাণীটিই যথেষ্ট ওঁ এর গুরুত্ব বােঝানাের জন্য। ওঁ বা ও-কার (অপর বানানে ওঙ্কার) বা প্রণব বা এ্যক্ষর সনাতন বৈদিকধর্মের পবিত্রতম ও সর্বোচ্চ প্রতীক। এটি বৈদিক দর্শনে ঈশ্বর তথা ব্রহ্মবাচক। সনাতন ধর্মের সকল শাস্ত্র, সিন্ধু হতে হিমালয় পর্যন্ত সকল মহামানব, সাধক, ঋষিগণ একে পরম লক্ষ্য ও সকলের উপাস্য বলে গণ্য করেছেন।
যজুবের্দ (৪০ অধ্যায়/১৭ নাম্বার মন্ত্র) সরাসরি ঘোষণা করছে, এই ওঙ্কার-ই স্বয়ং ব্রহ্ম, পরমাত্মা; জগতের রক্ষক।
যজুর্বেদ: ৪০/১৭; তুলসীরাম ভাষ্য
ঋগ্বেদ (১ম মণ্ডল/১৬৪ সুক্ত/৪৬ নাম্বার মন্ত্র) বলছে, ঈশ্বর এক। এক সত্ত্বা পরমব্রহ্মকে জ্ঞানীরা ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য, সুপর্ণ, গরুত্মান, যম, মাতরিশ্বা -আদি বহু নামে অভিহিত করেন।
ঋগ্বেদ: ১/১৬৪/৪৬; তুলসীরাম ভাষ্য
অর্থাৎ এক ব্রহ্মকেই আমরা বিভিন্ন নামে ডাকি। আর যজুর্বেদ অনুসারে ওঙ্কার-ই স্বয়ং ব্রহ্ম। সুতরাং সহজ ভাবে বলা যায় যে ওঙ্কারই স্বয়ং ব্রহ্ম এবং ইহাই নামবাচক। এটা নিয়ে বিস্তারিত আরেকটি আর্টিকেল দিব।
এই ওঙ্কারের উপাসনা করাই আমাদের বিধেয়। এবং অন্তিম মূহুর্তেও এই নামের উচ্চারণ করতে বলা হয়েছে বেদ, উপনিষদ এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়।
যজুর্বেদ: ৪০তম অধ্যায়/১৫তম মন্ত্র; তুলসীরাম ভাষ্য
যজুর্বেদের ৪০ তম অধ্যায়ের ১৫ তম মন্ত্রে বলা হয়েছে “শরীর ত্যাগের সময় পরমাত্মার নাম ওঙ্কার স্মরণ করো।
বই: ওঙ্কার মাহাত্ম্য; প্রথম সংস্করণ; পৃষ্ঠা: ১৬
ঈশোপনিষদে ১৭ নাম্বার মন্ত্রে বলা হয়েছে, দেহান্তের সময় ওঁ অর্থাৎ ব্রহ্মের স্মরণ করো।
ঈশ উপনিষদ: ১৭ তম মন্ত্র; অতুল সেন ভাষ্য
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ৮ম অধ্যায়ের ১৩ নাম্বার শ্লোকেও একই কথা বলা হয়েছে। দেহত্যাগের সময় ওঙ্কার জপ করা প্রয়োজন।
যথার্থ গীতা: ৮ম অধ্যায়/১৩ নাম্বার শ্লোক; স্বামী অড়গড়ানন্দ ভাষ্য
কঠোপনিষদেও পমাত্মার মাহাত্ম্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, “চার বেদ যাঁরর স্বরূপের বর্ণনা করে এবং সকল তপস্যা যাঁর বর্ণনা করে, সেই পদ সংক্ষেপে ওম্।”
কঠ উপনিষদ: ১ম অধ্যায়/২য় বল্লী/১৫ নাম্বার মন্ত্র; অতুল সেন ভাষ্য;
কঠোপনিষদ পুনরায় বলছে, ব্রহ্মকে লাভ করার যত উপায় আছে, তার মধ্য ওঙ্কার-ই শ্রেষ্ঠ। এটিই ব্রহ্মের প্রকৃত পরিচয়।
কঠ উপনিষদ: ১ম অধ্যায়/২য় বল্লী/১৭ নাম্বার মন্ত্র; অতুল সেন ভাষ্য
মুণ্ডক উপনিষদ বলছে, এই ওঙ্কারকে অবলম্বণ করেই আত্মার (ওঙ্কারের) ধ্যান করো।
মুণ্ডক উপনিষদ: ২য় মুণ্ডক/২য় খণ্ড/ ৬ষ্ঠ মন্ত্র; অতুল সেন ভাষ্য
মাণ্ডুক্য উপনিষদের প্রথম মন্ত্রেই বলা হচ্ছে, ওঙ্কার দিয়েই সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত (নিরাকার ব্রহ্ম সর্বব্যাপী)। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎও এই ওঙ্কার।
মাণ্ডুক্য উপনিষদ: ১ম মন্ত্র; অতুল সেন ভাষ্য
ওঙ্কার মাহাত্ম্য: ৩৪ পৃষ্ঠা; ১ম সংস্করণ
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে, ওঁ পরমাত্মার অবিনাশী নাম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ নাম, যা আমি শুরুতেই বললাম।
ওঙ্কার মাহাত্ম্য: ৩৭ পৃষ্ঠা; ১ম সংস্করণ
সুতরাং ওঙ্কার সর্ব বেদের প্রাণ এবং প্রধান। তার অমৃত সুধা পান করাই আমাদের উদ্দেশ্য। পরমাত্মা আমাদের এই জ্ঞান দিয়েছেন যেন জাগতিক সকল রহস্যকে উদঘাটক করে তাঁর সমীপে প্রস্থান করা যায়। কিন্তু কিছু মহাপণ্ডিতের কারণে অনেক পুরুষ এবং স্ত্রীলোক এই ওঙ্কার জপ বা ধ্যান করতে পারেনা। কালের বিবর্তনে এখন এই ওঙ্কার কেবলই এক প্রতিক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমি সনাতন ধর্মের সর্বোচ্ছ শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত থেকেই প্রমান দিলাম যে, এই নাম (ওঁ) সকল মানুষের জন্য। সকলেরই পরমাত্মার অমৃত গ্রহণের অধিকার রয়েছে। এখানে কোন ভেদাভেদ নেই। ঈশ্বরের কাছে আমরা সকলেই সমান।
কপি পেস্ট করে সেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.