একজন কবি জীবনে কয়েকটা কবিতা লিখে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেলেন এবং তারপরে আর কোন কবিতা লিখলেন না l এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কিন্তু বাঙালী বিশ্বাস করে যে আরবদুনিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি করে, তারপর গবেষণা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিল l যে শুন্যের উপর আধুনিক গণিত, পদার্থবিদ্যা থেকে অর্থনীতির ভিত্তি দাড়িয়ে, সেই শুন্য আবিষ্কারের পর আরব কার্যতঃ আর কোন গবেষণাই করেনি l

“পৃথিবী শুন্য পেয়েছে আরব দুনিয়া থেকে”, এই মিথ্যা বলতে শ্লাঘা বোধ করতেন আলিমুদ্দিন থেকে চাকরি পাওয়া আশি ও নব্বইয়ের দশকে চাকরিতে যোগ দেয়া অধিকাংশ গণিত শাস্ত্রের শিক্ষক l একটা ডাকাত পরিবার থেকে হঠাৎ একজন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করলে, সেটা বলতে যেমন ওই ডাকাত পরিবারের বন্ধুবান্ধব আত্মীয়সজন কিংবা তাঁর পৃষ্ঠপোষকরা আনন্দ পান, ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই l

সত্যটা হল ভারতবর্ষের মুনিঋষিরা যে শুন্য নিয়ে ব্রহ্মগুপ্তেরও অনেক আগে থেকে কাজ করে এসেছেন, সেই শুন্য আর আরবের মূসা আল খোয়ারিজমীর শুন্য সম্পূর্ণ আলাদা বস্তু l প্রথমটি একটি সংখ্যা ( Number) এবং দ্বিতীয়টি স্থানগ্রাহক ( Placeholder ) l

শুন্যকে সংখ্যা হিসেবে ভাবতে গেলে প্রথম দরকার ঋণাত্মক সংখ্যার উপস্থিতিকে মেনে নেয়া l কিন্তু খোয়ারিজমীর গণিত সেই তত্বের ধরে কাছে যায়নি l তিনি শুন্য তো বটেই এককেও সংখ্যা হিসেবে ধরেন নি l এমনকি ফিবোনচিও ঋণাত্মক সংখ্যার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন l ব্রহ্মগুপ্তের 1000 বছর পরেও আরব বা পশ্চিমী দুনিয়া শুন্য সম্পর্কে অবহিত ছিল না l তারা শুন্যকে ব্যাবহার করতো স্থানগ্রহক হিসেবে এবং আজকের দিনে পাশ্চাত্য দুনিয়ার তৈরি কম্পিউটারও শুন্যকে নয়ের পরেই রাখে l কারণ শুন্যকে সংখ্যা মেনে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও, তাঁদের পুরোনো চিন্তায় শুন্য যে স্থানগ্রাহক, সেই জায়গা থেকে সম্ভবতঃ তারা এখনো সরে আসতে পারেনি l.

নালন্দা, তক্ষশীলা সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ধংসের পর আমাদের কাছে যে ইতিহাস অবশিষ্ট আছে, তাতে, ব্রহ্মগুপ্তেই আবিষ্কার করেন শুন্য বা লিপিবদ্ধা করেন । যদিও তাঁর আগেও এই শুন্য ব্যাবহার করতেন ভারতীয় মুনি ঋষিরা l কিন্তু তাঁর কোন সূত্র বা লিখিত প্রমান নেই l তিনি সবার প্রথম শুন্য এর সংজ্ঞা দেন এভাবে যে, কোনো সংখ্যাকে তার নিজের থেকে বিয়োগ করলে শুন্য পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, কোনো সংখ্যার সাথে শুন্য যোগ করলে ঐ সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয় না এবং কোনো সংখ্যাকে শুন্য দিয়ে গুণ করলে শুন্য পাওয়া যায়। ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রথম বইগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে ধনাত্মক সংখ্যা, ঋণাত্মক সংখ্যা ও শুন্য পাওয়া যায়। এর আগে ব্যাবিলোনিয়ান ও রোমান গণিতবিদগণ শুন্য কে কোনো আলাদা সংখ্যা হিসাবে বিবেচনা করতেন না। ব্রহ্মগুপ্তই প্রথম সবাইকে আলাদা সংখ্যা হিসাবে এর সথে পরিচয় করিয়ে দেন।

ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর এ বইয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো দেন, তা এরকম:
১। দুটো ধনাত্মক সংখ্যার যোগফল ধনাত্মক ।
২। দুটো ঋণাত্মক সংখ্যার যোগফল ঋণাত্মক ।
৩। শুন্য ও একটি ঋণাত্মক সংখ্যার যোগফল ঋণাত্মক ।
৪। শুন্য ও একটি ধনাত্মক সংখ্যার যোগফল ধনাত্মক ।
৫। শুন্য ও শুন্য এর যোগফল শুন্য ।
৬। দুটো ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যার যোগফল আসলে তাদের বিয়োগফল। আর যদি তারা সমান হয়, তাহলে যোগফল শুন্য ।
৭। দুটো ধনাত্মক সংখ্যার বিয়োগের ক্ষেত্রে বড় থেকে ছোট বাদ দিতে হবে।
৮। দুটো ঋণাত্মক সংখ্যার বিয়োগের ক্ষেত্রে বড় থেকে ছোট বাদ দিতে হবে।
৯। যদি ছোট থেকে বড় সংখ্যা বিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে বিয়োগফল উল্টে যাবে।
১০। যদি ঋণাত্মক সংখ্যা থেকে ধনাত্মক সংখ্যা বিযোগ করতে হয় বা ধনাত্মক থেকে ঋণাত্মকসংখ্যা বিয়োগ করতে হয়, তাহলে আসলে তাদের যোগ করতে হবে।
১১। একটি ঋণাত্মক ও একটি ধনাত্মক নাম্বারের গুনফল ঋণাত্মক ।
১২। দুটো ঋণাত্মক সংখ্যার গুনফল ধনাত্মক ।
১৩। দুটো ধনাত্মক সংখ্যার গুনফল ধনাত্মক ।
১৪। দুটো ধনাত্মক সংখ্যার ভাগফল এবং দুটো ঋণাত্মক সংখ্যার ভাগফল উভয়ই ধনাত্মক ।
১৫। ধনাত্মক নাম্বারকে ঋণাত্মক সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ঋণাত্মক পাওয়া যাবে, আবার ঋণাত্মক ধনাত্মক দিয়ে ভাগ দিলেও ঋণাত্মক পাওয়া যাবে।
১৬। ধনাত্মক বা ঋণাত্মক সংখ্যাকে শুন্য দিয়ে ভাগ করলে শুন্য হর বিশিষ্ট ভগ্নাংশ পাওয়া যাবে।
১৭। শুন্য কে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দিয়ে ভাগ করলে শুন্য ই পাওয়া যাবে l
১৮। শুন্য কে শুন্য দিয়ে ভাগ করলে শুন্য পাওয়া যাবে।

পূর্বে অনেক সভ্যতায় গণিতের মূল চারটা অপারেশন (যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ) পরিচিত থাকলেও, আমরা এখন যেভাবে এই অপারেশনগুলো করি, তা মূলত হিন্দু সংখ্যা পদ্ধতির আবিষ্কার, যা প্রথম পাওয়া যায় ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তে। অবশ্য ভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী সুমেরীয়রা পদ্ধতিগুলো প্রথম আবিষ্কার করে প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তে গুণকে বলা হয়েছে গোমূত্রিকা। বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ের গণনা নামক অনুচ্ছেদে ব্রহ্মগুপ্ত ভগ্নাংশের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। এখানে তিনি বর্গ, বর্গমূল, ঘণ ও ঘণমূল নিয়েও আলোচনা করেন।

এবার আসি আরব এবং পশ্চিমী দুনিয়ার সংখ্যাতত্বে l আল খোয়ারিজমীর সংখ্যা তত্বে ঋণাত্মক সংখ্যা নেই l তিনি শুন্যর কথা তো বলেনই নি, 1 কেও উনি সংখ্যা হিসেবে ধরেন নি l উনি ছোট সংখ্যার থেকে বড় সংখ্যা বিয়োগের তত্ব একবারের জন্যও বলেননি l সাধারণত পাটিগণিতের পর বীজগণিত করা হয় l আল খোয়ারিজমীর প্রথমে বীজগণিতের বই লিখে পরে হিন্দু গণিতের উপর বই লেখেন l এবং সেখানে তাঁর ২00 বছর আগে লেখা ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তের অষ্টাদশ অধ্যায়ের তত্বে সঙ্গে কোন মিল নেই l

এরও ১00 বছর পর, আল উক্লিডিসি, সংখ্যা তত্বে শুন্যের তত্ব বলেন l উনি গ্রিক সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলতেন l কিন্তু শুন্য এখানেও স্থানগ্রাহক l উনিও কোন ঋণাত্মক সংখ্যার কথা উল্লেখ করেন নি l ঋণাত্মক সংখ্যা না থাকলে শুন্যকে সংখ্যা হিসেবে কিভাবে মেনেছেন তিনি? আসলে মানেন নি l

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফিবোনচি তাঁর বিখ্যাত বই লিবের আবেকাতেও ঋণাত্মক সংখ্যার উল্লেখ করেন নি, যদিও তিনি দাবী করেন তিনি হিন্দু গণিত পাশ্চাত্যে নিয়ে এসেছেন, আরবীয় বণিকদের মাধ্যমে l

পরের শতকে ইংরেজি ভাষায় প্রথম পাটিগণিত বই ছাপা হয় এবং সেখানেও শুন্য সেই স্থানগ্রাহক এবং ঋণাত্মক সংখ্যার কোন জায়গা নেই l

ষোড়শ শতকে লেখা মাইকেল স্টেফেলএর এরিথমেটিকা ইন্টেগ্রা ( ১৫৪৪ ) বইতে নেগেটিভ সংখ্যাকে ‘এবসার্ড’ বলা হয়েছে l অর্থাৎ ব্রহ্মগুপ্ত যখন ঋণাত্মক সংখ্যাকে নিয়ে খেলা করেছেন, তাঁর ১000 বছর পরের ইউরোপ একে মানতই না l ১৫৮৫ তে সিমন স্টিভেন ১ কে সংখ্যা হিসেবে মানেন l ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী তথা গণিতজ্ঞ ব্রহ্মগুপ্ত ঋণাত্মক সংখ্যাকে নিয়ে যখন তাঁর বইয়ে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করেন, তাঁর এক হাজার বছর পর নিউটন তাঁর গতিবিদ্যাতে ঋণাত্মক সংখ্যা ও শুন্যের সংখ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় l কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যাও একই স্বীকৃতি দেয় l

আর আজকের দুনিয়া? কম্পিউটারের key board এ শুন্য আসে নয়ের পর, একের আগে নয় l অর্থাৎ পশ্চিমী দুনিয়া এখনো সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি যে শুন্য (-)1 এবং (+) 1 এর মধ্যবর্তী একটি সংখ্যা l অথচ, হিন্দু গণিতশাস্ত্র প্রথম থেকেই সত্য, যুক্তিযুক্ত, সামঞ্জস্যপূর্ণ অথচ সহজবোধ্য l

আজকের আধুনিক যুগের বিজ্ঞানচর্চা থেকে শেয়ারবাজার থেকে আলুর বন্ড সব কিছুই দাড়িয়ে আছে এই সত্যের উপর, যে শুন্য একটি সংখ্যা, শুধুমাত্র স্থানগ্রাহক নয় l আর বামপন্থীরা দাবী করছেন, এর আবিস্কর্তা আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ঠিক পরেই l আর সেই কারণেই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্ম তাঁদের এবং হিন্দু ধর্ম নাকি কিছুই সংস্কার ও কুসংস্কারের সমন্বয় l এই পৃথিবীর যত আবিষ্কার হয়েছে তাঁর কত শতাংশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই জনগোষ্ঠীর? শুন্যতেই শুরু আর সেখানেই শেষ?

শেষ করি এক কবির জীবনীর কিছু ঘটনা নিয়ে l বলিউডের এক মহানায়কের বাবা এবং দিল্লির অন্যতম ক্ষমতাশালী লুটিয়ান ম্যাডামের স্বামীর পরিচয় ছিল কবি হিসেবে l বিখ্যাত এই কবি জীবনের ১৫ বছর কবিতা লিখে কবিতা লেখা বন্ধ করে দেন l এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালী অধ্যাপক প্রশ্ন করেন, একজন কবি মাঝবয়সে হঠাৎ কবিতা লেখা শুরু করে হঠাৎই বন্ধ কিভাবে করে দেন? নিন্দুকেরা বলে কবিতা অন্য কেউ লিখতেন l সেই ভদ্রলোক মারা যাবার পর কবির কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে যায় l

সুদীপ্ত গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.