হাড়োযায় তিন দিন হাসপাতালে ঠায়ে বসে এক বৃদ্ধ প্রতিবন্ধী তার নিজের রিকশাভ্যানে । তখনো ভ্যাকসিন পাননি ।
ডোমজুড়ের এক যুবক গত কাল রাত থেকে কলকাতার এক হাসপাতালে লাইন দিয়েছেন ভ্যাকসিন নিতে ।
ক দিন আগে ভ্যাকসিন নিতে বরাহনগরে স্টেট জেনারেল হাসপাতালে তিন দিন ধরে মানুষের লাইন ।
আর পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূলের পার্টি অফিস থেকে সমর্থক দেখে দেখে ভ্যাকসিনের কুপন বিলি । আমরা ওরা, ওরা আমরা !
এসবই কোন কাল্পনিক কাহিনী নয়, সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া মানুষের প্রতিদিনের জীবন যন্ত্রণার কথা । তিনটি ঘটনার কথা বললাম । খুঁজলে তিন লক্ষ এরকম ঘটনা পাওয়া যাবে ।
প্রতিবাদ ? কোথায় ? কে করছেন ? কেন করছেন না ? কি কারণে করছেন না ? প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এ নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ ? ভুলে গেছেন তাঁরা ?
আর যিনি বিহিত করতে পারতেন তিনি তো দিল্লীতে মন দিয়েছেন । প্রধানমন্ত্রী হবেন ঘরের লোককে রাজ্যপাট দিয়ে ।
এস এস কে এমে কয়েক শো নার্স তিন দিন ধরে প্রতিবাদে পথে বসে । সরকারের বিকার আছে ? যিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রী তিনি কোথায় ? যে মানুষগুলো মানুষের প্রাণ বাঁচায় তাঁরাই আজ পথে বসে ? ক টা সংবাদ মাধ্যম এঁদের কথা বলছে ? লিখছে ? লিখবে কি করে ? এঁরাই তো দিল্লীতে নেত্রীর সফর সঙ্গী । রাণীর অতিথি । রাণী রেগে যাবেন, তা হয় ?
এস এল এস টি, স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েট লিস্টেড উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা বিধাননগরে ৬ মাস ধরে ফুটপাথে বসে । ইতিহাস বলছে ২০১৯ এর ২৭ মার্চ, লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে উত্তীর্ণ, বঞ্চিত এইসব চাকরি প্রার্থীরা যখন ধর্মতলায় আন্দোলনে বসেছিলেন তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ মমতাকে সঙ্গে করে স্পটে যান । মমতা কথা দেন প্রকাশ্যে ( ভিডিও আছে ) – ইলেকশন যাক, এখনও আদর্শ আচরণ বিধি লাগু, নির্বাচন মিটলেই জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই মিটিয়ে দেব সব সমস্যা ।
তারপর ২০১৯ এর জুন গেছে, ২০২০, ২০২১ এর জুন চলে গেল । উচ্চ শিক্ষিত ছেলে মেয়ে গুলো ত্রিপল খাটিয়ে অন্ধকারে রাতের পর রাত ঝড় বৃষ্টিতে এখন রাত কাটাচ্ছে । শুধু ন্যায্য প্রাপ্যটুকু চাইতে ও পেতে । কেউ কথা রাখলনা ওদের । আজও ওরা অন্ধকারে বিকাশ ভবনের উল্টোদিকে সেন্ট্রাল পার্কের ৫ নম্বর গেটের পাশে ১৮০ দিন ধরে বসে । শুধু পড়াশুনা করার প্রায়শ্চিত্ত করছে বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান কিম্বা স্বামীকে ফেলে রেখে ।
আর ঐ বিকাশ ভবনের অধুনা নতুন হওয়া এক মালিক ব্রাত্য বসু ত্রিপুরা ভ্রমণে গেছেন আই প্যাকের জন্য ওকালতি করতে । তিন দিন ধরে ও রাজ্যে বসে রয়েছেন । একবার পারতেন না এই অসহায়, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত উত্তীর্ণ শিক্ষিত ছেলে মেয়ে গুলোর কাছে গিয়ে তাঁদের যন্ত্রণার কথা মাথা নিচু করে শুনতে ? একটু একবার যুক্তিবোধ দিয়ে সুরাহার চেষ্টা করতে ?
কে বলবে ? কে বোঝাবে এই ক্ষমতাসীন জ্ঞানপাপী নির্বোধদের ?
সংবাদমাধ্যম কিন্তু পারতো শাসককে সতর্ক করতে । করলনা । বিজ্ঞাপনের লোভ । বড্ড বেশী লোভ কেড়ে নিয়েছে তাঁদের কথা বলা, দু লাইন লেখার, জনমত গড়ার নৈতিক দায়িত্বটাকে ।
কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার তাঁরা পারতেন না ? মহাশ্বেতা দেবী বেঁচে নেই, অপর্ণা সেনরাতো আছেন ? কৌশিক সেন, সুবোধ সরকার, নৃসিংহ প্রসাদ, শ্রীজাতদের কাছে সমাজের কোন প্রত্যাশা নেই । সবাই চিনে গেছেন, জেনে গেছেন এঁদের, এঁরা কি কারণে নীরব থাকেন ।
তাহলে ? শুধুই অন্ধকার ? শুধুই নীরবতা ? শুধুই শুন্যতা ? এস এস কে এমের নার্স থেকে সেন্ট্রাল পার্কের পাশে বসে থাকা ঐ হতভাগ্য মানুষগুলো আরো কত রাত জাগবেন ? কেউ ভাববেন না ? তাঁরা তো আমাদেরই পরিজন । এই সমাজের । যে সমাজ শুধুই, শুধুই একতরফা স্বার্থপরতা শেখাবে ? শাসকের স্পর্ধার কাছে ভালো থাকার বোধ নিয়ে ?
কে জানে ? কি উত্তর, এই অন্ধকারের শেষ কোথায়, কে জানে ?
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় (৯৮৩০৪২৬০৭৮)