ইঙ্গ-বাঙালি(রাঢ়)যুদ্ধ সমূহের ইতিহাস

অনেকে মনে করেন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমেই বাঙলার অধিকার সম্পূর্ণ ইংরেজদের করায়ত্ত হয়। এক্ষেত্রে যে প্রতিরোধগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্বতন্ত্র রাজ্যগুলির দ্বারা সংঘঠিত হয়েছিল সেগুলোকে একরকম অগ্রাহ্য করা হয়।
আমাদের বাঙলার বুকেই ছিল সিপাহী বিদ্রোহের মতো একটি প্রভাবশালী বিদ্রোহের ইতিহাস।
পাইক বা চূয়াড় বিদ্রোহকে বাঙলার সিপাহী বিদ্রোহ বললে অত্যুক্তি হয় না।
আজ আমরা পলাশীর পরবর্তী যুদ্ধগুলোর ইতিহাস জানব এবং পলাশীর মাধ্যমে বাঙলার ক্ষমতার হস্তান্তরের মিথ ভাঙব এবং পশ্চিম রাঢ় কিভাবে ব্রিটিশ অধীনস্থ হল তাও জানব।
1.মল্লভূমের যুদ্ধ(১৭৬০): পলাশীর যুদ্ধের পরেও মল্লভূম স্বাধীন রাজ্য হিসেবে টিকে ছিল ১৭৬০ পর্যন্ত। যথাক্রমে মির্জাফরের ভাড়াটে বাহিনীর সহায়তায় দামোদর সিংহ বনবিষ্ণুপুর আক্রমণ করে। চৈতন্য সিংহ প্রথমবার প্রতিরোধে সফল হলেও পরের বার পারেন নি। বনবিষ্ণুপুর নবাব মীর জাফরের অধীনে চলে যায়।
মারাঠা আক্রমণের পরবর্তীতে বিষ্ণুপুর নবাবদের কর দেওয়া বন্ধ করে ।চৈতন্য সিংহ 1745 তে অভিষিক্ত হন তিনিও ধার্মিক রাজা ছিলেন। কিন্তু তাকেও প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
যথাক্রমে বর্ধমান রাজাদের সাথে দন্দ্ব,শোভা সিংহের বিদ্রোহ , মারাঠা আক্রমণের ফলে বিষ্ণুপুর রাজ্য খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে।
তাঁর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দামোদর সিংহ নামে তার এক জ্ঞাতিভাই ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন।ি দামোদর সিংহকে ব্যর্থ ও বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে গিয়ে মুর্শিদাবাদ রাজদরবারে আশ্রয় নেন।
তিনি মুর্শিদাবাদের দরবারে সমর্থন আদায়ে সমর্থ হন।। প্রথমে সিরাজদ্দৌলা তাকে নিজ বাহিনী ধার দেন। দামোদর সিংহ অজয় নদ টপকে দামোদর সিংহ উত্তরাংশ দিয়ে রাজ্যে প্রবেশ করে। সাঙ্ঘাটগোলাতে চৈতন্য সিংহের বাহিনীর সাথে নবাবের বাহিনীর সঙ্ঘর্ষ হয়।
দামোদর সিংহ কোনক্রমে বেঁচে যান সেবার।
কিন্তু চৈতন্য সিংহ নবাবের বাহিনীকে পরাজিত করেন।
চৈতন্য সিংহ সিরাজদ্দৌলার এই কপটতার বদলা নিয়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে বিষ্ণুপুর নিস্পৃহই ছিল।
ইংরেজদের হাতে সিরাজের পরাজয়ের পর ।1760 তে দামোদর সিংহ পুণরায় মীর জাফরের সহায়তা লাভে সমর্থ হন। দামোদর সিংহকে আরও শক্তিশালী বাহিনী ধার দেন মীরজাফর। এইবার তিনি বিষ্ণুপুর দখল করতে সমর্থ হন 10000 ভাড়াটে পদাতিক বাহিনীর সহায়তায় । স্বাধীন রাজ্য বিষ্ণুপুরের স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়।
চৈতন্য সিংহ মদন গোপালের বিগ্রহ নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে আসেন। এরপর রাজ্যের মালিকানা ও সেই বিগ্রহটি নিয়ে বহুদিন মামলা মোকদ্দমা চলে। এই মামলা চালাতে গিয়ে বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারের পতন সম্পূর্ণ হয়। শেষে ১৮০৬ সালে রাজস্ব বাকি রাখার দায়ে রাজ্য বিক্রি হয়ে যায় এবং বর্ধমানের রাজা সমগ্র এস্টেটটি কিনে নেন।
চূয়াড় বিদ্রোহ
জমিদারেরা নিজেদের জমিদারীর শান্তিরক্ষা,দুষ্কৃতিদমন ইত্যাদির জন্য পাইক রাখতেন।তারা সব দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল। বাগদি ও বাউরি জাতির লোকেরাই পাইক হোত এদের জমিদারীর মধ্যেই নিষ্কর জমি দেওয়া থাকত।এই নিষ্কর জমিই পাইকান জমি।এর বদলে এরা জমিদারের অনুগত থাকতো। কিন্তু ইংরেজদের দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজরা বর্ধিত খাজনার দায় চাপিয়ে দিল জমিদারদের ঘাড়ে এবং সাথে সাথে বতিল করলো পাইকানদের নিষ্কর জমি।অস্থিরতা শুরু হল শান্ত মেদিনীপুর চাকলার বুকে।
2.ধলভূমের যুদ্ধ (১৭৬৯) :
বক্সারের যুদ্ধ সমাপ্ত,ভারতের ইতিহাসের গতিপথের পরিবর্তন পুরোপুরি নিশ্চিত।মানদন্ড ক্রমে রাজদন্ডে পরিবর্তনের পথ ক্রমশ প্রশস্ত হচ্ছে।দিল্লীর মসনদে দুর্বল সম্রাট শাহ আলম,মসনদ রক্ষার উপহারস্বরূপ ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে কোম্পানীকে দিলেন বাংলা,বিহার, ওড়িশার দেওয়ানি বাৎসরিক ছাব্বিশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। ১৭৬৬ খৃষ্টাব্দে জমিদারদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হল বর্ধিত খাজনার দায়।বাতিল করা হল পাইকান প্রজাদের নিষ্কর জমি।
জঙ্গলমহলের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন, সাতপাট্টা দেমুশন্যা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক সজলকান্তি মণ্ডল। তাঁর কথায়, সহায়তায়১৭৬০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরকাশিমের সঙ্গে একটি চুক্তি করে।
ওই চুক্তিবলে ১৭৬৭ সালে লেফটেন্যান্ট ফাগুর্সন জঙ্গলমহলের কয়েকটি অঞ্চল দেখাশোনার দায়িত্ব পান এবং ওই অঞ্চলকে শাসনাধীনে আনতে অভিযান প্রেরণ শুরু করেন। ওই অঞ্চলে সুপুর, ফুলকুসমা, অম্বিকানগরের সঙ্গে রাইপুরের রাজত্বও ছিল।
বক্সারের যুদ্ধের পরে মেদিনীপুর ও বর্ধমান বিভাগের দায়িত্ব ফার্গুসনের হাতে পড়ে। এবং ফার্গুসন লক্ষ্য করেন বর্গী আক্রমণের সুযোগে ১৭৪৪ র পর থেকে অসংখ্য ছোট-বড় সামন্ত রাজা স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালাচ্ছেন। ইনাদের কেউই আর নবাবের অধীনস্থ নন এবং তারা বাৎসরিক খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন বহু পূর্বে।
তৎপরবর্তীতে এই অঞ্চলে কোম্পানি অভিযান প্রেরণ করতে শুরু করে। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম ধল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চুয়াড়রা এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়।
১৭৬৭ খৃষ্টাব্দে ইংরেজরা পাইকান জমি বাতিল ঘোষণা করতে চূয়াড় বিদ্রোহের সূচনা হল।ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম বিদ্রোহ ঘোষনা করলেন।বিদ্রোহের আঁচ ছড়িয়ে পড়ল সারা জঙ্গলমহল জুড়ে।চূয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিলেন জমিদারেরা।স্থানীয় ভাবে বিভিন্ন জমিদারের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো ধলভূম থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে পুরো জঙ্গল মহলে।ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষনা করলেন।
তরুণ দেব ভট্টাচার্যের পুরুলিয়া গ্রন্থে। আমরা দেখতে পাই জগন্নাথ সিং ধল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এসমস্ত সত্ত্বেও জগন্নাথ সিং ধলের পরাজয় ঘটে তিনি লড়াইয়ে সম্ভবত গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। অবশেষে কোম্পানি জগন্নাথ সিংহের ভ্রাতুষ্পুত্রকে জমিদারি ফিরিয়ে দেয় ।

  1. মেদনীপুরের ধাদকা গ্রামের বিদ্রোহ(১৭৭১):
    বাংলায় বিভিন্ন পর্যায়ে চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহ ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে বিভিন্ন নেতার হাত ধরে। ১৭৭১ সালে ধাদকা গ্রামের শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও ব্যর্থ হয়।
  2. গড় রায়পুরের যুদ্ধ (১৭৯৮):
    প্রথম পর্বের বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও চুয়াড়দের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে । এই আগুন ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে চুয়াড়দের দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের সময় দাবানলের চেহারা নেয় ।
    জঙ্গলমহল-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চুয়াড় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে ।
    ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বকেয়া খাজনা মেটাতে ব্যর্থ হন রাজা দুর্জন সিংহ।
    রাজা মহারাজাদের স্মৃতি বিজড়িত গড় রাইপুর এক সময় ছিল বাংলার বিপ্লবীদের অন্যতম ডেরা।গড় রাইপুর সেই সময় বর্ধমান পরগনার অন্তর্ভূক্ত ছিল।
    ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই রাইপুর। ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে চুয়াড় বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল জঙ্গলমহলের এই জনপদে।১৭৯৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সরকারি এক নির্দেশে রাইপুর, শ্যামসুন্দরপুর-সহ ৬টি জঙ্গলমহাল তদানীন্তন মেদিনীপুর জেলায় স্থানান্তরিত হয়। আর ৫৭টি গ্রামকে নিয়ে রাইপুর জমিদারি নিলামে ডাকার বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু তাতে দমে যাননি দুর্জন সিংহ।
    ১৭৯৩ সালের ১৯ জুলাই দুর্জন সিংহ নিজেকে রাইপুরের স্বাধীন তালুকদার বলে ঘোষণা করেন। এর পরেই কোম্পানি ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্জন সিংহকে বন্দি করার নির্দেশ দেয়।
    ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে আবার দুর্জন সিংহ নিজেকে স্বাধীন তালুকদার ঘোষণা করেন ও কোম্পানির খাজনা দিতে অস্বীকার করেন ফলত তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয় সরকার। ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে রাইপুর পরগনায় শুরু হয় চুয়াড় বিদ্রোহ। ক্রমে তা অম্বিকানগর, সুপুর, বাঁকুড়ার দক্ষিণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ সবচেয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল ।
  3. বীরভূমের সঙ্ঘর্ষ:
    বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন গোবর্ধন দিকপতি, মোহনলাল ও লাল সিং । বীরভূমের সীমান্তে লাল সিং -এর নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ জন কৃষক ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নেয় । দুর্জন সিং -এর নেতৃত্বে কমপক্ষে ৩০টি গ্রামের সর্দার ও পাইক সম্প্রদায় দলবদ্ধভাবে লুটপাট ও হত্যালীলা চালায় । রায়পুর, বাসুদেবপুর, বলরামপুর, তমলুক, রামগড়, শালবনি প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহীরা লড়াই শুরু করে ।
    ১৭৯৮ সালের মার্চ মাসে রাইপুর পরগনায় শুরু হয় চুয়াড় বিদ্রোহ। সেই সময়ে দুর্জন সিংহ ওই বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দেড় হাজার চুয়াড় সেনা নিয়ে তিনি রাইপুর পরগনার ৩০টি গ্রামের উপর নিজের দখলদারি কায়েম করেন।
    পরে তিনি এই সশস্ত্র আন্দোলনকে বগড়ির চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গে সামিল করেছিলেন।
    দুর্জন সিংহের হাত ধরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল অম্বিকানগর,সুপুর।ইংরেজরা শক্তহাতে বিদ্রোহ দমন করে এবং ধলভুমের জমিদারী দখল নেয়।বিদ্রোহী প্রজাদের ইংরেজরা নানাভাবে অত্যাচার করে,জনমানসে ভীতির সঞ্চারের জন্য জঙ্গলের গাছের ডালে বেশ কিছু জনকে ফাঁসি দেয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়।কিন্তু স্বাধীনচেতা এই অঞ্চলের মনের গভীরে বিদ্রোহের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতেই থাকে।পুরোপুরি বিদ্রোহ দমনের আগেই আবার রাণী শিরোমণির নেতৃত্বে শুরু হয় তৃতীয় দফায় চূয়াড় বিদ্রোহ।
    6.কর্ণগড়ের যুদ্ধ (১৭৯৯):
    আমরা লক্ষ্মীবাইকে মনে রেখেছি, ভুলে গিয়েছি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনীকে ?
    পরিখা ঘেরা প্রাসাদের ভিতরেই ছিল আস্ত একটা জনপদ! পারাং নদীর কুল ঘেঁষা টিলার উপর সেই প্রাসাদে বাস করতেন রানি শিরোমণি। ইতিহাসে যিনি চূয়াড় বিদ্রোহের নেত্রী। রানির বীরগাথা এখনও কর্ণগড়বাসীর মুখে মুখে ফেরে। ঐতিহ্যের সেই প্রাসাদ এখন ধ্বংসস্তূপ।
    মেদিনীপুর শহর পেরিয়ে উত্তরমুখে কিছুটা এগিয়ে গেলেই শাল সেগুনের জঙ্গল।এন এইচ ১৪ রাণীগঞ্জ রোড ধরে ভাদুতলা পেরিয়ে গোদাপিয়াশালের ঠিক আগেটাতে হাই ওয়ের গা বেয়ে একটা সরু পথ ডান দিকে বেমক্কা জঙ্গলের দিকে বাঁক নিয়েছে।সেই সরু পথ দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটারের মতো জঙ্গলের পথ বেয়ে এঁকেবেকে এগোলে বিশাল এক মন্দির,রাণী শিরোমণির মহামায়া মন্দির,কর্ণগড়ের মন্দির।
    কর্ণগড়—এই গড়ের সীমানা ছিল প্রায় ১২০ বিঘা। মেদিনীপুর হইতে ৬ মাইল উত্তরে শালবনি থানায় অবস্থিত কর্ণগড় একটি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ স্থান। এখানে সিংহ উপাধিধারী এক রাজবংশের রাজধানী ছিল। এই বংশীয় রাজা মহাবীর সিংহের নিৰ্ম্মিত একটি দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। এই দুর্গের মধ্যে একটি সরোবর ও তন্মধ্যস্থ একটি প্রস্তর নিৰ্ম্মিত প্রাসাদ এখানকার দ্রষ্টব্য বস্তু। প্রবাদ, কর্ণগড়ে দাতাকর্ণের বাট ও ভোজরাজার রাজধানী ছিল। কেহ কেহ অনুমান করেন যে উৎকলাধিপতি কর্ণকেশরী এখানে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী প্রণীত “ রামচরিতম্” নামক সংস্কৃত কাব্যে কর্ণকেশরীর উল্লেখ আছে। বিখ্যাত “শিবায়ন ” প্রণেতা রামেশ্বর ভট্টাচাৰ্য্য বরদা ঘাটালের রাজা শোভাসিংহের মোগলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণার পর স্বীয় জন্মভূমি যদুপুর গ্রাম ত্যাগ করিয়া কর্ণগড়ে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই গড়টি প্রায় দুই মাইলব্যাপী ছিল এবং সদর ও অন্দর দুই মহালে বিভক্ত ছিল। গড়ের তিন দিকে জঙ্গল এবং পূবর্বদিকে কৃষিক্ষেত্র। জঙ্গল হইতে একটি নদী বাহির হইয়া গড়ের দুইদিক দিয়া প্রবাহিত হইয়া পুনরায় একত্র হইয়াছে । ইহাতে গড়ের একটি স্বাভাবিক পরিখার স্বষ্টি হইয়াছে
    অনাড়ম্বর মন্দিরটি যেন ছোটখাটো গড়।উঁচু পাথুরে প্রাচীরে ঘেরা মন্দিরটিতে সূক্ষ্ম স্থাপত্যের নিদর্শন হয়তো নেই,কিন্তু অদ্ভুত এক রহস্যময়তা,প্রাচীনতার সাথে আটপৌরে শিল্পের হার্দিক মেলবন্ধন এবং অপরাজেয় ইতিহাস,—সবে মিলে মন্দিরটি ভীষণই স্বতন্ত্র।
    ভারতবর্ষের প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহ চূয়াড় বিদ্রোহের বীরাঙ্গনা নেত্রী রাণী শিরোমণির খাসতালুক এই কর্ণগড়। রাণী শিরোমণির আরাধ্যা দেবী মন্দিরে পূজিতা মা মহামায়া।কে এই রাণী শিরোমণি? কী তার পরিচয়?কী এমন তাঁর বীরত্ব যে সারা জঙ্গলমহল তার নাম শুনলে এখনও শ্রদ্ধায় মাথা নত করে।মেদিনীপুর যে কত বিপ্লবের সাক্ষী! এই জেলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্রোহের ইতিহাস,দামাল ছেলেদের আত্মবলীদানের ইতিহাস।কিন্তু এই বিদ্রোহের ইতিহাসের সূচনা আড়াইশো বছর আগে কর্ণগড়ের রাণী শিরেমণির সময় থেকে।চলুন আজ আমরা পিছিয়ে যাই আড়াইশো বছর আগের কোম্পানীর শাসনের সময়ে।
    এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কেউ বলেন কেশরীবংশীয় রাজা কর্ণকেশরী, কেউ বলেন রাজা মহাবীর সিংহ
    আবার অনেকে বলেন লক্ষণ সিংহ। এই বংশের উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন যশোবন্ত সিংহ। শৌর্য আর প্রজাবাৎসল্যের কারণে তাঁর নাম ও যশ প্রচারিত এবং প্রসারিত হয়েছিল। তবুও কর্ণগড় যাঁর জন্য জনপ্রিয় হয়েছিল তিনি হলেন মেদিনীপুরের ‘লক্ষ্মীবাঈ’ রানি শিরোমণি। অজিত সিংহের মৃত্যুর পর (১৭৬০) তাঁর হাতে সিংহাসনের দায়িত্ব আসে আর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। এই দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর রাজ্যশাসন, প্রজাপালন এবং ব্রিটিশদমনে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ আমলে কর্ণগড় ছিল বিদ্রোহের পীঠস্থান।
    বাদশাহী আমলে মেদিনীপুর অঞ্চলের নাম ছিল মেদিনীপুর চাকলা,বেশীর ভাগ অঞ্চলটাই ছিল সবুজ জঙ্গল।কাঁসাই নদীর দক্ষিণ তীর থেকে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত ছিল হিজলী চাকলা।মেদিনীপুর চাকলা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে।কর্ণগড়,আনন্দপুর,শালবনী,ধাদিকা,চন্দ্রকোনা, শিলদা,নয়াবসান,বলরামপুর,নারায়নগড়,বগড়ী,গড়বেতা ইত্যাদি ছোট ছোট জমিদারদের জমিদারী। প্রত্যেক জমিদারই নিজ নিজ ভূখন্ডে শাসন চালাতেন।এই ভূখন্ড তাদের রাজ্য,আর জমিদারেরা হলেন সেই সব রাজ্যের রাজা।স্থানীয় উপজাতির প্রজাদের নিয়ে গঠিত পাইক বাহিনী জমিদারের শক্তি।শাল -সেগুন বনানীতে ঘেরা এই জঙ্গল মহলের বেশ কিছুটা অংশ কর্ণগড়ের রাজা অজিত সিংহের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।লোধা,মাঝি,বাগদি,কুড়মী,ভঞ্জ,কোবা,গোপ, সদগোপ, তেলি মাহিষ্য প্রভৃতি জনগোষ্ঠী প্রধাণ অঞ্চল এই জঙ্গলমহল।জমিদারের পাইক বাহিনীর প্রধান ছিল তারাই।বনজ সম্পদ এবং জমিদারের দেওয়া নিষ্কর জমি,–এই দুয়েই তাদের সহজ সাদাসিধে জীবন সুন্দর ভাবে কেটে যেত।কর্ণগড়েররাজা যশোবন্ত সিংহ আরাধ্যা দেবী মা মহামায়া,জঙ্গলমহলের প্রতিটি মানুষের আশা ভরসার স্থল।এই যশোবন্ত সিংহের পুত্রই হলেন রাজা অজিত সিংহ।জঙ্গলের মধ্যেই গড়ের আকারে তৈরী মন্দির,সুরক্ষা বলয় যথেষ্ট মজবুত।অজিত সিংহের দুই রাণী,রাণী ভবানী ও রাণী শিরোমণি।নিঃসন্তান রাজা অজিত সিংহ অকালে দেহত্যাগ করলে দুই বিধবা রাণী হন জমিদারীর কর্ত্রী।রাণী শিরোমণি নিপূণ বিচক্ষনতার কারণে এবং প্রজা হৈতষী বিবিধ পরিকল্পনার কারণে প্রজাদের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন।মহামায়ার মন্দির কেন্দ্র করে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী তৈরী করেছিলেন।প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন স্বয়ং মহামায়র প্রতিভূ।এরপর ১৭৬০ খৃষ্টাব্দে প্রয়াত হন রাণী ভবানী।ইংরেজরা আইনের দোহাই দিয়ে রাণী ভবানীর অংশ গ্রাস করল।প্রজাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিল,বিদেশী প্রভু মেনে নিতে চাইলো না উপজাতি প্রধাণ জনগোষ্ঠীর প্রজারা।রাণী শিরোমণি নিজের অংশের জমিদারী ত্রিলোচন খানের সাহায্যে চালাতে লাগলেন।
    রাণী শিরোমণি ছিলেন মহামায়ার একনিষ্ঠ ভক্ত,এবং জঙ্গলমহলের প্রজারা রাণীর মুখ নিঃসৃত প্রতিটি বাক্য মহামায়ার আদেশ রূপে শিরোধার্য করতো। প্রজাদের চোখে আরাধ্যা দেবী মহামায়া এবং তাদের প্রিয় রাণী যেন একই।
    ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে রাণীর কিছু খাজনা বাকি পড়ে,আগে থেকেই রাণী ইংরেজ চোখে শত্রু ছিলেন,এই সুযোগে কোম্পানী রাণীর নানাকর জমি দখল করে।নানাকর হল এমন জমি যার খাজনামুক্ত।ক্রোধান্বিতা রাণী তার সন্তানতুল্য প্রজাদের একত্রীত করে সৈন্যদল প্রস্তুত করতে লাগলেন।লাঠি,তীর-ধনুক,টাঙ্গী,বল্লম,বর্শা,বাঁটুলে সজ্জিত রাণীর সৈন্যদল।রাণীর নেতৃত্বে সৈন্যরা জঙ্গলের পথে গেরিলা যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে লাগলো। রাণীর বিশ্বাসী কর্মচারী চুনীলাক খান মেদিনীপুর শহরের আবাসগড়ের দুর্গ থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করতে লাগলেন।বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো ক্ষীরপাই,আনন্দপুর,চন্দ্রকোনাতেও।
    গোবর্ধন দিকপতির নেতৃত্বে ১৭৯৮ খৃষ্টাব্দে চারশো চূয়াড় বাহিনী চন্দ্রকোনার সরকারি অফিস লুট করে।রাণী ফরমান জারি করলেন যে সব প্রজা ইংরেজ বাহিনীকে জঙ্গলে খাদ্য ও পানীয় জল দিয়ে সাহায্য করবে তাকে তিনি মৃত্যু দন্ড দেবেন।
    জঙ্গলে বিশেষ সুবিধাজনক চোরাগোপ্তা আক্রমণ, চাষী মজুরের দল তীর ধনুক,টাঙ্গী সম্বল করে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে লাগলো।প্রজাদের কাছে রাণীর নির্দেশ ছিল অলঙ্ঘ্য,সাক্ষাৎ মহামায়ার নির্দেশ।
    রাণীর কাছে খবর এলো ইংরেজরা কোলকাতা থেকে প্রচুর সৈন্য মেদিনীপুরে আনছে।জঙ্গলমহল নিজেদের পূর্ণ শাসনে আনার জন্য ইংরেজরা মরিয়া। রাণী পরিকল্পন করলেন ইংরেজ সৈন্যদের মেদিনীপুরে আসা ঠেকাতে। তিনি ইংরেজদের কাছে পরিকল্পনা মতো খবর পাঠালেন পাইকদের অত্যাচারে তিনি বিব্রত,তিনি ইংরেজদের সাথে সন্ধি করতে চান।ভেতরে ভেতরে ইংরেজ মরণ কামড় দেওয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত হতে লাগলেন।কিন্তি বিধি বাম।দেওয়ান যুগলচরণের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজদের কাছে ফাঁস হয়ে গেল রাণীর পরিকল্পনা। জমিদারির লোভে যুগলচরণ স্বজাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।রাণীরও দৃষ্টি সর্বত্র,তিনিও বুঝলেন এই বিশ্বাসঘাতকতা। তার জমিদারি থেকে বহিষ্কার করলেন বিশ্বাসঘাতক কে।বিদ্রোহের মাথা চুনীলালকে করলেন নতুন দেওয়ান।
    ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুমে আবাসগড় ঘিরে ফেললো ইংরেজ সেনা।চুনীলালকে বন্দী করা হল।রাণীর অপর বিশ্বস্ত কর্মচারী নর নারায়ন বক্সীর নামে আনা হল গ্রেফতারী পরোয়ানা।রাণী কর্ণগড় দূর্গে আশ্রয় নিলেন।বিশাল ইংরেজ সৈন্যদের হাতে জঙ্গলের সন্তানরা পরাজিত হলেন,মৃত্যু বরণ করলেন বহু যোদ্ধা। রাণী গড় মধ্যে হলেন অবরুদ্ধ। এরপরের ইতিহাস রহস্যাবৃত।বেশীর ভাগ ঐতিহাসিকদের মতে গড় মধ্যেই রাণীকে গুমখুন করা হয়।কারণ ইংরেজরা জানতো রাণীকে বাঁচিয়ে রাখা মানেই আবার সাধারণ প্রজারা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।অনেক ঐতিহাসিকদের ধারণা রাণীকে মেদিনীপুর শহরের উপকন্ঠে আবাসগড়ে নজরবন্দী রাখা হয়েছিল,১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে ৬ই এপ্রিল রাণী ওখানেই মৃত্যু বরণ করেন।
    নাড়াজল রাজা আনন্দলাল খানের মধ্যস্থতায় ঠিক হলো, তিনি গৃহবন্দি থাকবেন আবাসগড়ে। চাইলে ‌কর্ণগড় দেখে আসতে পারতেন। তবু কখনও যাননি তিনি। সব লুঠ হয়ে গিয়েছে। সাজানো রাজ্য, সাধের রাজধানী, প্রাসাদ সব শেষ। এ শ্মশান দেখতে চাননি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক বন্দি। থেকে ছিলেন সেই আবাসগড়ে। যেখানে স্বামীর সঙ্গে মুহূর্ত কাটাতে আসতেন।
    শোনা যায়, রানীকে ভালোবাসতেন স্থানীয় যুবক জনার্দন। অবশ্য সেই ভালোবাসা ছিল একতরফা। রানীর বিয়ে হয়ে গেলে জনার্দন সাধু হয়ে যান। তিনিই পরবর্তীকালে প্রতিশোধ নিতে ইংরেজদের চর হয়েছিলেন। ছল করে রানীর সঙ্গে দেখা করে সুড়ঙ্গের গোপন রাস্তা দেখে নেন। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে আত্মগোপন করার সময়ই ধরা পড়ে যান রানী।
    অনেকে বলেন রানি আত্মাহুতি দিয়ে নিজের সম্ভ্রম বাঁচান আর চুয়াড়রা টুকরো হয়ে যায় ইংরেজদের গোলাবারুদের সামনে।
    বর্তমানে রাণী শিরোমণির গড়টি সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে,ইতি উতি পাথরের টুকরো,মহলের চূড়া ছাড়া সবই মাটিতে মিশে গেছে।তবে কর্ণগড়ে মহামায়ার মন্দিরটি এখনও স্ব মহিমায় উজ্জ্বল।
    চারটি মন্দির পাশাপাশি নিয়ে পুরো মন্দিরটি।মহামায়ার মন্দিরে
    মা মহামায়া সাথী অভয়াকে সাথে নিয়ে একই বেদীতে উপবিষ্টা।সামনেই পঞ্চমুন্ডীর আসন।গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে হাড়িকাঠ।তারপাশেই দন্ডেশ্বর শিবের মন্দির।মহামায়া মন্দিরের পেছনে যোগমায়ার মন্দির,সেখানেও হাড়িকাঠ।শিবের মন্দির পেরিয়ে হনুমানজীর মন্দির।মন্দির গুলো সব পাথরের তৈরী।চারিদিক পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।প্রাচীরের ওপর দিয়ে অনায়াসে হেঁটে চলা যায়।মহামায়ার মন্দিরটি দীর্ঘদিন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছিল।ঝাড়খন্ডের জামসেদপুর থেকে আগত মাতৃসাধক রঘুবাবা এই মন্দিরটিকে আবার জনমানসে ফিরিয়ে আনেন,এবং বর্তমানে মন্দিরটির প্রভূত সংস্কার হয়েছে।তবে ইংরেজদের বিরূদ্ধে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রো চূয়াড় বিদ্রোহ এবং চূয়াড় বিদ্রোহের নেত্রী রাণী শিরোমণির স্মৃতি বিজোড়িত এই মন্দিরে এখনও যেন সময় আটকে আছে সেই রাণীর সময়ে,প্রতিটি পাথরে চাপা পড়ে আছে বীরত্বের ইতিহাস।
    বিদ্রোহীদের আক্রমণে ব্রিটিশ শাসকের নিযুক্ত জমিদার, নায়েব, গোমস্তারা এবং থানার দারোগা-সহ পুলিশ কর্মীরা প্রাণভয়ে রাইপুর ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে এই পরিস্থিতি স্থায়ী হয়নি শীঘ্রই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহী জমিদার ও চুয়াড়দের পরাজিত করে । রানি শিরোমনিকে রাজনৈতিক বন্দী ও দুর্জন সিংকে গ্রেপ্তার করা হয় । এর ফলে বিদ্রোহ থেমে যায় । পরে সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের হটিয়ে পুনরায় রাইপুর দখল করে।কোম্পানির সেনাদল নির্মম অত্যাচার করে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল। নৃসংশভাবে বিদ্রোহীদের হত্যা করে তারা। গাছের ডালে তাদের ফাঁসি দিয়ে মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে ত্রাস সৃষ্টি করে গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যে।
    7.গড়বেতার বিদ্রোহ (১৮০৬) :
    এটিকে অনেকে বাগড়ী নায়েক বিদ্রোহও বলেন।১৮০৬ সালে বাগড়ী নায়েক বিদ্রোহের সূচনা হয়, বহু প্রাণ নষ্ট করেও সরকার এই আন্দোলন দমন করতে পারেনি।
    গড়বেতা থানার বাগড়ী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গজপতি সিংহের উত্তারাধিকারী ছত্র সিংহের আত্মীয়া অচলসিংহ। অচলসিংহের নেতৃত্বে হাজার হাজার পাইক নায়েক সৈন্য নিয়ে ছত্র সিংহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে (১৮০৬-১৮১৬) সাল ১০ বছর ধরে লড়াই করেছিলেন।
    শালবনীর জঙ্গল থেকে নির্ভুল লক্ষ্যে ইংরেজদের তীরবিদ্ধ করতে পারত পাইকরা সহজেই, শেষে ওকেলী সাহেব গড়বেতার গনগনি ডাঙ্গার চারপাশে কামান বসিয়ে রাতের অন্ধকারে মাইলের পর মাইল জঙ্গল পুড়িয়ে লোককে হত্যা করে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটায় । ছত্র সিংহের জন্যই অচলসিংহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন কিন্তু সেই ছত্র সিংহই ১৮১৬ সালে অচলসিংহ সহ তাঁর অনুগ্রামীদের ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেয় । ইংরেজ সৈনিকরা গুলি করে তাঁকে হত্যা করেন।ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছুদিন অবস্থা শান্ত হলেও মেদিনীপুরের শালবনী অঞ্চলে ১৮৩১ সালে আবার এই বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল।
    বিদ্রোহের শেষে চুয়াড়দের কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্রিটিশ সরকার চুয়াড় অধ্যুষিত এলাকায় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায় । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে ‘জঙ্গলমহল’ নামে একটি বিশেষ জেলা গড়ে তোলা হয় । চুয়াড়দের একাংশকে বিশেষত পুলিশের কাজে নেওয়া হয় । পাইকদের নিষ্কর জমি ফেরত দেওয়া হয় । নতুন ব্যবস্থায় বলা হয় পাইকরা খুব কম হারে রাজস্ব দেবে এবং তাদের জমি কোনোভাবেই খাসজমি করে নেওয়া হবে না । চুয়াড় বিদ্রোহের প্রকৃতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ লিখেছেন—”চুয়াড়দের এই বিদ্রোহ ছিল নিম্নশ্রেণির লোকের স্বতঃস্ফুর্ত অথচ ব্যাপক এক বিদ্রোহ”। Courtesy: Gaudiya Warriors in Face Book.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.