জুলাই মাসের ৩১ তারিখ আজকে। বারাণসী জেলার লমহী গ্রামে ১৮৮০ সালে আজকের দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন হিন্দি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীরূপে গণ্য মুন্সী প্রেমচাঁদ। প্রথম জীবনে অধ্যাপনা করতেন প্রেমচাঁদ , এবং পরে বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে উন্নীত হন। প্রেমচাঁদের সাহিত্য জীবন শুরু হয় ‘নবাব রায়’ ছদ্মনামে উর্দুতে লেখালেখি দিয়ে। ১৯০৭ সালে ওঁর লেখা ‘সোজে ওয়াতন’ গ্রন্থটি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। পরে উনি মুন্সী প্রেমচাঁদ ছদ্মনামে হিন্দিতে লেখা শুরু করেন। মুন্সী প্রেমচাঁদের প্রসিদ্ধ উপন্যাস, ‘নির্মলা’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘বরদান’, ‘গবন’, ‘গোদান’ ইত্যাদি। উনি ‘মর্য্যাদা’, ‘জাগরণ’ এবং ‘মাধুরী’ নাম কয়েকটি পত্রিকায় সম্পাদনা করেছিলেন। প্রেমচাঁদের সহজ, সরল, প্রচলিত ভাষাশৈলী ওঁর রচনাবলীকে এক অনুপম সৌন্দর্য্য প্রদান করেছে।
আজ ওঁর জন্মদিবস উপলক্ষ্যে বন্ধুদের জন্য দিলাম ওঁর লেখা একটি গল্প। নাম – ‘পরীক্ষা’ — অনুবাদ করেছেন শ্রী শ্যামলকৃষ্ণ বসু….
নাদির শাহের সৈন্যদল দিল্লি নগরীকে হত্যা নগরী করে তুলেছে। মহল্লায় মহল্লায় বইছে রক্তনদী। দিকে দিকে শুধুই ক্রন্দন আর হাহাকার। বাজার বন্ধ। দিল্লিবাসী ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কারোরই বুঝি প্রাণ আর বাঁচে না।
কোথাও কোনো ঘর আগুনে জ্বলছে। কোথাও কোনো বাজার লুট হয়ে যাচ্ছে। কেউ নেই নালিশ শোনার। রইস আদমির মহল থেকে বেগমদের খুঁজে খুঁজে বের করে এনে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হচ্ছে। ইরানী সিপাহিদের রক্তপিপাসা যেন কোনোভাবেই মিটতে চাচ্ছে না। মানবহৃদয়ের ক্রুরতা , কঠোরতা এবং পৈশাচিকতা উন্মত্ত রূপ ধারণ করেছে।
এমনই এক সময়ে নাদির শাহ বাদশাহী মহলে প্রবেশ করলেন। ঐ সময়ে দিল্লি ছিল ভোগ বিলাসের অন্যতম কেন্দ্র। সাজসজ্জা আর বিলাস-ব্যসনের জিনিসে ধনী ব্যক্তিদের ভবন থাকত পরিপূর্ন। স্ত্রীলোকদের রূপসজ্জা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না। রাজনীতির বদলে লোকে শেরশায়েরি নিয়ে মেতে থাকত। সমস্ত প্রান্ত থেকে যত ধনদৌলত দিল্লিতে এসে জমা হতো , তা আবার তেমনই জলের মতো খরচ করে ফেলা হতো। রমরমা ছিল বারাঙ্গনাদের। কোথাও পায়রা ওড়ানো হতো , কোথাও বুলবুলির লড়াই জমে উঠতো। সারা শহর মগ্ন ছিল ভোগবিলাসে।
নাদির শাহ শাহীমহলে পৌঁছে , শাহীমহলের জাঁকজমক, সেখানে রাখা বিলাসসামগ্রী দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। নাদির শাহর জন্ম হয়েছিল দরিদ্র ঘরে। সারাজীবন যুদ্ধক্ষেত্রেই কেটেছে। ভোগবিলাসের স্বাদ পাননি জীবনে।কোথায় রণক্ষেত্রের কষ্টের জীবন, আর কোথায় এমন সুখের সাম্রাজ্য। যেদিকে তাকান, সেদিকেই প্রাচুর্য , বৈভব। চোখ ফেরাতে পারছিলেন না নাদির শাহ।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। নাদির শাহ নিজের সরদারদের সঙ্গে নিয়ে মহলের ভেতর ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দের অনেক জিনিস সংগ্রহ করলেন। পরে সেগুলো নিজের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য বন্দোবস্ত করে সরদারদের চলে যেতে হুকুম দিলেন। তারপর দিওয়ানি খাস – এ ঢুকে রত্নখচিত সিংহাসনের উপর বসে পড়লেন।
নিজের সব হাতিয়ার খুলে রেখে দিলেন সামনে রাখা পাথরের টেবিলের উপরে এবং মহলের দারোগাকে ডেকে হুকুম দিলেন , ‘ম্যায় শাহী বেগমোকা নাচ দেখনা চাহতা হুঁ ‘ — আমি শাহী বেগমদের নাচ দেখতে চাই। তুমি এক্ষুনি তাঁদের সুন্দর বস্ত্র -আভূষণে সাজিয়ে আমার সামনে নিয়ে এসো। খবরদার !! যেন একটুও দেরি না হয়। আমি কোনো অজুহাত শুনবো না।
দারোগা এমন নাদির শাহী হুকুম শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ে। যে স্ত্রীলোকদের ওপর সূর্যের দৃষ্টিও কোনোদিন পড়েনি , তারা কেমন করে একজন পরপুরুষের সামনে এই মজলিশে এসে দাঁড়াবে ? নাচতে বলা তো অনেক দূর অস্ত ব্যাপার। শাহী বেগমদের এমন অপমান কখনো হয়নি। ওরে নরপিশাচ !! দিল্লিবাসীর রক্তে হোলি খেলে তোর চিত্ত এখনো শান্ত হয়নি !! কিন্তু নাদির শাহর সামনে একটি শব্দও মুখ থেকে বের করা সাক্ষাৎ আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার সামিল। মাথা ঝুঁকিয়ে ‘যথা আজ্ঞা’ বলে দারোগা রানীমহলে গিয়ে সব রানীদের নাদির শাহের হুকুম শুনিয়ে দিলো। সেই সঙ্গে এ কথাও জানিয়ে দিল, একটুও যেন দেরি না হয়। নাদির শাহ কোনো অজুহাত বা আপত্তি শুনবে না। শাহী খানদানের ওপর এতো বড় বিপত্তি কখনো পড়েনি। কিন্তু এই সময় বিজয়ী বাদশাহের আজ্ঞা শিরোধার্য করা ছাড়া প্রাণরক্ষার আর কোনো উপায় ছিল না।
বেগমরা এমন আদেশ শুনে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। সমস্ত রানীমহলে যেন এক শোকের ছায়া নেমে আসে। সকলে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। শতেক হৃদয় হতে এমন এক অত্যাচারীর প্রতি অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকে। কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভগবানকে ডাকে , কেউ আল্লারসুলের স্মরণ করে। কিন্তু এমন একজন স্ত্রীলোকও সেখানে ছিল না, যার দৃষ্টি কোনো অস্ত্র বা তলোয়ারের দিকে গিয়ে পড়ে। যদিও এদের মধ্যে অনেক বেগমেরই ধমনীতে রাজপুতানীর রক্ত প্রবাহিত ছিল। কিন্তু এদের ইন্দ্রিয়লিপ্সার আগুনে সেই জহরব্রতর আগুন ঠান্ডা হয়ে গেছে। সুখভোগের লালসা তাদের আত্মসম্মানের সর্বনাশ করে দিয়েছে। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে আত্মমর্যার রক্ষার কোনো উপায়ও তাদের চিন্তায় আসে না। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের ভাগ্যকে এক কঠিন পরীক্ষার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
হতাশাগ্রস্ত ললনারা অবশেষে পাপী নাদির শাহর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হয়। চোখে তাদের জল , হৃদয়ে তাদের আর্তি , তথাপি তারা রত্নখচিত আভূষণ অঙ্গে তুলে নেয়। অশ্রুসজল নয়নে সুরমা লাগায়। শোকব্যথিত হৃদয়ে লেপন করে আতরের সুগন্ধ। কেউ কেশসজ্জা করে , কেউ কপালে মোতির মালা স্থাপন করে। এমন একজনও নির্ভয়া স্ত্রীলোক ছিল না , যে কিনা ঈশ্বরের মুখ চেয়ে , নিজের সাহসে এমন দুরাত্মার আদেশ লঙ্ঘন করার সাহস দেখতে পারে।
একঘন্টাও পার হয়নি। ঝলমলে আভূষণে সজ্জিতা শাহী মহলের বেগমেরা ভীরু পায়ে আতরের সুবাস ছড়িয়ে, ছমছম মল বাজিয়ে, দিওয়ান – এ – খাস – এ নাদির শাহর সামনে এসে দাঁড়ায়।
নাদির শাহ আলস্যমদির চোখে একবার অপাঙ্গে দেখলেন সুন্দরীদের দিকে। পরক্ষনে সিংহাসনের গায়ে হেলান দিয়ে এলিয়ে পড়লেন গভীর ঘুমে। সামনের টেবিলে উন্মুক্তভাবে পড়ে আছে ধারালো অস্ত্রাদি। বেগমের নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে স্থাণুবৎ। আধঘন্টা ধরে একই অবস্থায় শুয়ে থাকেন নাদির শাহ। দু-একটি স্ত্রীলোক ঘোমটার আড়াল থেকে নাদির শাহকে দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে, কি ভয়ঙ্কর দেখতে মানুষটা !! কেমন জল্লাদের মতো চোখ!! কী ভারী শরীর!! যেন বিশমণ ওজন!! মানুষ না দানব!!
সহসা নাদির শাহর চোখ খুলে যায়। নাদির শাহকে জগতে দেখে বেগমেরা ভেড়ার দলের মতো একে অপরের সঙ্গে মিশে দাঁড়ায়। সবাই শঙ্কিত হয়ে পড়ে এই ভেবে, যদি এখন এই অত্যাচারী মানুষটি ‘নাচিতে আদেশ করে বসে, তাহলে কী হবে !! পরপুরুষের সামনে নৃত্য !! তার থেকে মৃত্যুও ভালো।
সহসা নাদির শাহ কঠোর বাক্যে বলে ওঠেন, ‘হে খোদার বাঁদিগণ, আমি তোমাদের পরীক্ষা করতে এখানে ডাকিয়েছিলাম। দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমাদের সম্বন্ধে আমার যে ধারণা ছিল , তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে দেখতে পাচ্ছি। যদি কোনো মানুষের স্ত্রীর মধ্যে আত্মবল না থাকে, তাহলে সেই মানুষ মৃতের সমান। দেখতে চেয়েছিলাম তোমাদের মধ্যে সেই আত্মবল বাকি আছে কি নেই !! আমি তোমাদের কোনো অন্যায়-অপমান করতে চাই না। আমার শুধু তোমাদের পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা ছিল। আমার এই দেখে সত্যি আশ্চর্য লাগছে যে, তোমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদার লেশমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। এটা কি খুবই অসম্ভব ছিল যে তোমরা এই দিওয়ান – এ – খাস – এ না এসে আমার হুকুম অবজ্ঞা করতে !! যখন তোমরা এখানে এসেই গেলে , তখন আমি তোমাদের আরো একটা সুযোগ দিলাম। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। তখনও কি তোমাদের মধ্যে কোনো বীরাঙ্গনা ছিল না, যে এখানে রাখা আমার তলোয়ার আমারই হৃদয়ে আমূল বিদ্ধ করে দিতে পারতো !! আমি কসম খেয়ে বলছি , তোমাদের মধ্যে যদি কেউ এই অস্ত্র তুলে নিয়ে আমাকে প্রহার করতে উদ্যত হতে , তাহলে আমি বেহদ খুশি হতাম। আমি আমি ঐ নাজুক হাতের উদ্যত অস্ত্রের সামনে আমার গলা বাড়িয়ে দিতাম। কিন্তু আপসোস এই যে , আজ তৈমুর খানদানের কোনো কন্যার মধ্যেই আমি সেই ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ স্পৃহা দেখতে পেলাম না।, যে তার অত্যাচারীর প্রতি হাত ওঠাতে পারে। এখন আর এই সাম্রাজ্য বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে না। এর গৌরব অস্তমিত। এই সাম্রাজ্য খুব শীঘ্রই দুনিয়া থেকে মুছে যাবে। এখন তোমরা যাও, আর হ্যাঁ , সম্ভব হলে যদি পারো এই সাম্রাজ্যকে বাঁচাও। নয়তো এইরকমভাবে কোনো শয়তানের গুলামি করতে করতে এই দুনিয়া থেকে তোমরাও হারিয়ে যাবে !!’ (সমাপ্ত)
যাওয়ার আগে , দু-কলি শিবের গীত গেয়ে রাখি। ‘উপন্যাস সম্রাট’ প্রেমচাঁদ বলতে চেয়েছিলেন যে অত্যাচারীর কাছে মাথা নত করার আগে অন্তত একটি বার প্রতিরোধের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা যে কোনো মানুষেরই আশু কর্তব্য। আজকের দিনে সর্বত্র অন্যায় অত্যাচার দেখেও গা-সওয়া করে নেওয়া আমাদের ধাতের মধ্যে পড়ে গেছে।
বিশেষ করে হিন্দু বাঙালির তো বটেই !!
ভালো থাকুন।
প্রীতম চট্টোপাধ্যায়