উপমহাদেশের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচাঁদ

সকালের মিঠে রোদে মহাবীর খাটিয়ায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। কোমরের কাছে ধুতিখানি আলগা হয়ে আলতোভাবে লেপ্টে আছে। উরু অব্দি নগ্ন নিলাজ পা দুখানি যেন বাকল ছাড়ানো দুটি তাগড়া কলা গাছ। ধবধবে ফর্সা পিঠের বামপাশে কালো জড়ুলটিকে দেখলে কালো ভোমরা বলে ভ্রম হয়।

রোগা প্যাংলা অল্পবয়েসী একটি ছোকরা থেকে থেকে পেতলের বাটি থেকে তিলের তেল দুই হাতে জবজবে মেখে বাবুর গায়ে, পায়ে, পিঠে মালিশ করছে। এটি হল বাবুর অতি বশংবদ চাকর দীননাথ। বাবুর বাড়ির চাষেরই তিল। কলুর বাড়ি থেকে কালই মাড়াই করে এনেছে দীননাথ নিজে।

মহাবীর এ গাঁয়ের সবচাইতে ধনী মানুষ। বিঘের পর বিঘে চাষের জমি তাঁর। আখ, গম, তিল, সরষে – কি চাষ হয় না! অবশ্য এই চাষবাস আদৌ মহাবীরের জীবিকা নয়। কায়েত আবার চাষী হল কবে! চাষীরা চাষ করে, জমি মহাবীরের। মহাবীর একরকম জমিদার মানুষ বলা যায়। মহাবীরের আসল ব্যবসা হল সুদের। এই দলাই মলাই পর্ব শেষ হলে, স্নানে যাবেন উনি। স্নান টান সেরে পর পূজা পাঠ, তারপর নাস্তা করে উনি বসবেন দাদনদারি নিয়ে। মেলা কাজ। তবে এই সকালের দলাই মলাইটা ঠিক ঠাক না হলে শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করে। মেজাজ ঠিক বশে থাকে না, হিসেবে গোলমাল হয়ে যায়।

হালকা পায়ের শব্দে মহাবীর মাথাটা ঈষৎ ডাইনে ঘুরিয়ে চোখটি সরু করে খুললেন।

“এ নবাবজাদা, কোথায় চললি সুড় সুড় করে, এ্যাঁ! বলি বগলে ওগুলো কি র‍্যা!”

ছোকরা হকচকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। পাতলুনের গিঁট ডানহাতে ওপরে টেনে ভয় ভয় মুখ করে কাছে এসে দাঁড়ায়। এমনিতে খ্যাংরা কাঠি মার্কা চেহারা, পিরেনখানি ঢল ঢল করছে, যেন হ্যাঙারে ঝোলানো রয়েছে খালি খালি।

“কাকা, এই বইগুলো বানোয়ারীলালের বই দোকান থেকে নিয়ে এসেছিলাম। ফেরত দিতে যাবো। এখুনি ফিরে আসব।”

“তোর আর কোনও কাজ কাম নাই র‍্যা? সারাদিন শুধু ঐ বই বই বই? গাঁয়ের আর পাঁচটা ছেলেকে দ্যাখ, কোন ছেলেটা তোর মতো ঐ আজব আজব কাহানী, কিতাব নিয়ে পড়ে আছে সারাদিন। আর শুনলাম তুই নাকি বানোয়ারীর দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করিস! তাক থেকে বই টই নামিয়ে দিস, গঞ্জ থেকে ওর দোকানে নতুন বইয়ের বান্ডিল গরুর গাড়িতে করে এনে দিস! কি দীননাথ, ঠিক বলছি তো? বলি, ‘মহাবীর রাইয়ের ভাতিজা কিনা কিতাব বিক্রি করে’, এই কথাটা আমাকে শুনতে হবে কেন? বলি, তুই ভেবেছিসটা কি? আমার মানসম্মান সব ধূলায় লুটাবি!”

দীননাথের হাত থেমে গেছে। মহাবীর ধমকে ওঠে। দীননাথ কেঁপে ওঠে। হাত ফের চালু হয়।

ওদিকে সে ছোকরা, কাকা যাকে ‘নবাব’ বলে ডাকেন, বাম বগলে বই চেপে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। বুড়ো আঙুল দিয়ে লালচে মাটি খোঁটাতে খোঁটাতে ও ভাবতে থাকে। এ জগতে সত্যিই আর কেউ নেই যে তাকে একটুখানি হলেও বোঝে, ভালোবাসে! একজন ছিল, আজ আর নেই। চোখের কোণাটায় জল চিকচিকিয়ে আসে। থুতনির কাছটা থরথর করে কেঁপে উঠতে চায়। মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
মা গো, তুমি কেন ছেড়ে চলে গেলে!
বুক থেকে দলা পাকানো কান্নাটা গলার কাছে এসে থমকে আটকে যায়। গলা বুঁজে আসে। এই কান্না তাকে কাঁদতে নেই। এই কান্না চাপতে চাপতেই তার গলাটা বোধহয় ক্রমশ লম্বা আর সরু হয়ে যাচ্ছে।
সৎমা যখন নিজের হাতে খেতে দিত না তাকে, ডাকত না একবারটিও, না খেয়ে ও নিজের ঘরে বালিশ আঁকড়ে পড়ে থাকত, কখন যে ঘুমিয়ে যেত তার খেয়াল থাকত না, তখন ঘুমের মধ্যে ওর মা আসত। ওর চুলে আঙুল ডুবিয়ে বিলি কেটে দিত, মিহি সুরে লোরি শোনাত, ঘুম ভেঙে যেত। ওর তখন একটুও খিদে পেত না, একটুও দুঃখ হত না, কষ্টও হত না, বাবার ওপর আর রাগ হত না একটুও।

এখনও যেমন আর রাগ হচ্ছে না কাকার ওপর। মায়ের কথা মনে পড়লেই ওর সব রাগ গলে জল হয়ে যায়। সব ভুলে যায় ও।
আচ্ছা এই বই ছাড়া ওর আপন আর কে আছে এখন, এ দুনিয়ায়! সৎমার ভয়ে পালিয়ে এসেছে কাকার কাছে। কিন্তু কাকাটাও তো কিচ্ছু বোঝে না যে! বই ছাড়া বাঁচা যায় নাকি!
বইয়ের টানেই তো বইয়ের দোকানে দৌড়ে দৌড়ে যায় ও। একটু আধটু সাহায্য করেও দেয় বানোয়ারীলালকে। না হলে কি আর বই ঘরে আনতে দিত! অত বই ও কিনতেও তো আর পারে না! অত পয়সা কোথায়!
ধুর, কাকা দু কথা দুদিন শোনাবে, তার বেশি কিছু তো নয়! বলুক, বকুক। যে যা করে খুশি হয় হোক।
ও বরং তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, দীননাথের রোগা কালো কালো হাত দুটো। লম্বা, পাকানো দড়ির মতো আঙুল গুলো। কাকার ফর্সা গায়ে কেমন তীব্র বৈপরীত্য তৈরি করেছে ওর চাষাড়ে আঙুলগুলি! আঙুলের চাপে লাল হয়ে যাচ্ছে কাকার পিঠ কোমর। জমিদারের পিঠে চাকরের হাতের চাবুক! না, কই তা তো নয়! ও ভাবতে থাকে, ভাবনায় ডুবে যেতে থাকে ও। কাকার ঠোঁটদুটো নড়ছে, ওর কানে আর কিছুই ঢুকছে না। আশ্চর্য!

*
*
*

আজ ধনপত রাই শ্রীবাস্তবের পূণ্য জন্মদিবস। মুন্সী প্রেমচাঁদ, এই ছদ্মনামেই বরং যিনি জগদ্বিখ্যাত।
এই উপমহাদেশের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচাঁদ বেনারসের কাছে লমহি গাঁয়ে আঠেরশো আশি সালে আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন। মূলত উর্দু ও হিন্দিতে লেখা প্রেমচাঁদের অজস্র ছোট গল্প ও উপন্যাস বহুকাল ধরে পরবর্তী যুগের সৃজনশীল মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। তাঁর অমর সৃষ্টিগুলির সফল চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে বহুবার, বিভিন্ন ভাষায় সেগুলি অনুদিতও হয়েছে। সঙ্গে দেওয়া ছবিখানি যতই মলিন, দারিদ্র্যলাঞ্ছিতই হোক না কেন, মুন্সী প্রেমচাঁদের সাহিত্য ভাণ্ডার সত্যিই অমূল্য সব মণিমুক্তোয় ভরা। নবপ্রজন্মের পাঠককুলের সামনে সেই রত্নভাণ্ডারের দোর খুলে দেওয়ার দায় কিছুটা আমাদের ওপরেও বর্তায়।

জন্মদিবসে মহান প্রতিভাধর কালজয়ী মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাই।

সুপ্রীতি সান্থাল মাইতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.