মাধ্যমিকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একটু বেশি নাম্বার পেয়েছে বলে যারা দাঁত বের করে খিক্ খিক্ হাসছেন তারা হয়তো জানেন না ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার হাত ধরে আগামী দিনে কত বড়ো বিপদ আসতে চলেছে আমাদের অজ্ঞানতার আড়ালে। খুব সহজে বোঝাবো, একটু ধৈর্য ধরে পড়বেন।
১৯৫১ সালে কল্পবিজ্ঞানের লেখক আইজ্যাক আসিমভ একটি বই লিখেছিলেন ‘দ্য ফান দ্যে হ্যাড’। এই কাহিনিতে রয়েছেএকটি বাচ্চা মেয়ে মার্গি জোন্স। যে বাড়িতে বসে অনলাইনে যা মেটিরিয়াল পাওয়া যায় সেই সব নিয়ে পড়াশোনা করে। তার কোনো বন্ধু নেই, খেলার মাঠ নেই। সে তার ঠাকুরদার কাছে অবাক হয়ে পুরানো দিনের গল্প শোনে। একসময় নাকি স্কুল নামের প্রতিষ্ঠান ছিল, সেখানে মানুষ প্রজাতির মাস্টারমশাইরা বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাত, তখন খেলার মাঠ ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ছিল। মার্গি যত শোনে ততই অবাক হয়ে যায়। সে তো রোবট টিচারের কাছে পড়ে। সে তো খেলতে যায় না।
২০২১ এ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী আয়োগ যে ৪০ পাতার অনলাইন বা ব্লেন্ডেড মোড লেখাপড়ার খসড়া প্রকাশ করেছে তাতে পরিষ্কার হয়ে যায় ভারত আগামী দিনে আমাদের ছেলেমেয়েদের মার্গি জোন্স বানাতে চলেছে। কিছুদিন আগে বেঙ্গালুরুর ইন্দাস ইন্টারন্যাশানাল স্কুল ইসারা.২০ নামের একটি রোবট দিয়ে ক্লাস নিয়েছিল দেখেছেন হয়তো। এটাকে বলা যায় শুরুয়াত। কোভিডের আড়ালে কি বড়ো কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে আমাদের সমস্ত সিস্টেমের?
আমরা যারা কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি ভালো করেই জানি কতরকম অসুবিধার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয় অনলাইন ক্লাসে। অনেক ছাত্র ক্লাসেই আসে না, অনেক ছাত্র ক্লাসে জয়েন করে অন্য কাজে চলে যায়। ছাত্রদের কাছ থেকে ফিডব্যাক তো দূর তাদের সঙ্গে কোনো মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার চাচ্ছেন আগামী দিনের শিক্ষা হবে বেশিরভাগটা অনলাইন বেসিস, আর কিছুটা হবে অফলাইনে, অর্থাৎ ক্লাসরুমে। অবশ্য এর মধ্যেও রয়েছে নানান রকমের গোলমাল। যেমন—
১. মাস্টারমশাইদের সংজ্ঞা বদলে যাবে, মাস্টারমশাইরা হবেন মেন্টর। অর্থাৎ ক্লাস শুরুর আগে সমস্ত স্টাডি মেটিরিয়াল অনলাইনে দিয়ে দেওয়া হবে, ছাত্ররা পড়ে আসবে, টিচার ক্লাসে গিয়ে শুধু তাদের মধ্যে আলাপআলোচনার মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবেন।
২. একজন ছাত্র কি বিষয়ে পড়বে সেই সিদ্ধান্ত একজন ছাত্র নেবে, ,মানে একটা বিষয়ের খিচুড়ি পাকানো হবে। মানে কেউ ফিজিক্সের সঙ্গে নিতে পারবে বাংলা কবিতা। শুধু তাই নয়, একজন ছাত্র কোন টিচারের কাছে পড়বে সেটাও ঠিক করবে ছাত্ররাই। অনেকে ভাবছেন ভালোই তো, অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা হল, কিছু বিষয় চিরকালের মতো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, টিচারের কোনো গুরুত্ব থাকবে না, যে বিষয়ে ভালো নাম্বার পাওয়া যাবে সেই বিষয়ই শুধু ছাত্ররা নিতে থকবে।
এখানেই শেষ নয়। ছাত্ররা পরীক্ষার পর নাম্বার পাবে না। তাদের ক্রেডিট ব্যাংক তৈরি হবে। অর্থাৎ একটি ছাত্র বিভিন্ন বিষয় পড়ে ক্রেডিট ব্যাঙ্ক তৈরি করবে। পড়াশোনার কোনো টাইম বাঊন্ড থাকবে না, পড়তে পড়তে সে যে কোনো দিন তা ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে পারে, আবার বছর চার পর সেখান থেকে শুরু করতে পারবে।
এবার ভাবুন ভারতবর্ষের যে সব গ্রামে ইন্টারনেটের টাওয়ার পেতে গাছের ডালে উঠতে হয়, সেসব প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় পৌঁছাবে! আউটকাম বেস এই এডুকেশন পলিসি ভারতবর্ষের চিরাচরিত গুরু-শিস্য পরম্পরা, অধ্যাবসায় ভিত্তিক পড়াশোনার মূলে আঘাত হেনেছে। দুদিন পর স্কুল কলেজ উঠে যাবে, মাস্টারের চাকরি উঠে যাবে। যে স্বপ্ন স্যাম পিত্রোদা ২০০৫ সালে দেখেছিলেন যে একটি কম্পিউটার ও পাঁচজন ভালো শিক্ষক থাকলে স্কুল কলেজের কি দরকার সেই স্বপ্ন যেন বাস্তব হতে চলেছে আগামী দিনে।
অনলাইন ক্লাস ছিল আমাদের কাছে দায়ের বিষয়, কিন্তু আজ প্রায় দেড় বছর স্কুল কলেজ বন্ধ করে ঘটতে চলেছে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনা হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে জিওর মতো কোম্পানি, কারণ লোক ডেটা কিনবে। সুন্দর পিচাই তো পরিসংখ্যান দিয়েছেন ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ইন্টারনেট ব্যবহার হয়েছে ১৬ গুণ বেশি। ভাবুন এবার আমাদের পয়সাগুলো কোথায় যাচ্ছে ! সত্যি কি আর ভাবার সময় আছে আমাদের।
এই ব্লেন্ডেড মোড বিদেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেই ‘স্যান জোস বিশ্ববিদ্যালয়ের’ শিক্ষকরাও এখন প্রতিবাদপত্র লিখে বলেছেন এই ব্লেন্ডেড মোড সিস্টেম হল ‘সিসিয়াস সোশ্যাল ইনজাস্টিস’। অথচ আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারকরা কিসের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন ভাবার বিষয়! ব্লেন্ডেড মোড এই সিস্টেম চালু করার প্রচেষ্টা যথারীতি শুরু হয়ে গেছে, কলেজ টিচারদের রিফ্রেসার্শ কোর্স বা NAAC এর স্কোরিং পদ্ধতিতে ব্লেন্ডেড মোড নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাস্টাররা বসে বসে মাইনে পায় বলে যাদের গায়ে ফোস্কা পড়ছে তাদের তো খুব আমোদ। কারণ মাস্টারি পেশাটাই থাকবে না। লেকচারগুলো রেকর্ড করে বাজানো হবে অনলাইন ক্লাসে। তাতে তো অনেক মঙ্গল। শিক্ষা খাতের টাকা বাঁচিয়ে আরও বড় বড় স্ট্যাচু বানান যাবে। বাবা মায়েদের চিন্তা নেই আর । ছেলে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাবার দরকার নেই। রোবট টিচাররে কাছে বাড়িতে বসেই মোবাইলে পড়াশোনা চলবে। তারাও আগামী ভবিষ্যতে গল্প শুনবে এক সময় স্কুল কলেজ নামে কিছু ঘরবাড়ি ছিল, মাস্টারমশাই নামের কিছু অযোগ্য জীবরা ক্লাস নিত। আর আগামী দিনের মার্গি জোন্সরা যত শুনবে ততই অবাক হয়ে যাবে।
© নীল রায়