নিকিতা – নফিসা – নিকিতা

কিছুদিন আগে একটা ভিডিও দেখেছিলাম ফেসবুকে| নিকিতা নামের এক যুবতী তার সাথে ঘটে যাওয়া লাভ জিহাদের কথা কোনো এক সাংবাদিককে বলছিল| স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর নিকিতা তার জীবনে “সোশাল সিকিউরিটি” ফিরে পেতে চাইছিল| সে জীবনে কিছু করে দেখাতে চাইছিল| একাকিত্ব আর সুরক্ষাহীনতার শিকার নিকিতার সাথে পরিচয় হয় আব্দুলের| আব্দুল তাকে বলে যে সে এক্কেবারেই কট্টর মুসলিম নয়| সেকুলারবাদের জমজমে ডুব দিয়ে সে আর তার পরিবার ধর্মনিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠেছে| তারা একলা “হিন্দু” মেয়েদের আশ্রয় দেয়, আদর করে, আপ্পায়ন করে| নিকিতারও আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল, নিকিতারও নিজের স্বপ্ন পুরো করার তাগিদ ছিল, নিকিতারও “সোশাল সিকিউরিটি”র প্রয়োজন ছিল| আর নিকিতার মনে হচ্ছিল এই আব্দুল অন্য আব্দুলদের মত নয় – আমার আব্দুল অন্যরকম| আব্দুলের প্রতি নিকিতার বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে “সোশাল সিকিউরিটি” -র খেলা শুরু হলো| আব্দুল নিকিতাকে নিয়ে শাহারণপুর যায়| সেখানে তাদের নিকাহ হয়| আর সেদিনের পর থেকেই নিকিতার নতুন নাম হয় নফিসা| নফিসা আব্দুল সংসার শুরু করে| কালো তাঁবুর নতুন সোশালি সিকিওরড পোশাকে নিকিতা, সরি নফিসাকে নাকি খুব সুন্দর লাগে, সেরকমই আব্দুল বলে তাকে| বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর একদিন নফিসার শ্বশুর নফিসাকে আরো একটু বেশি সিকিউরিটি দিয়ে ফেলে| তাই সেই বিষয়ে একটা পারিবারিক মিটিং বসে| মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে এর পর নফিসাকে আব্দুল আর সিকিউরিটি দেবে না| বদলে তার আব্বা দেবে| তাই নফিসাকে বলা হয় এখনও পর্যন্ত যে শ্বশুর, তাকে নিকাহ করতে হবে

| আব্দুল তাকে তলাকও দিয়ে দেয়| আসলে আব্দুল হয়তো ততদিনে অন্য কোনো হিন্দু মেয়েকে তার সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল| তাই আব্বার কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে আব্দুল নফিসাকে তার আব্বার হাতে তুলে দেয়| এই সব গল্প নিকিতা, মানে নফিসা, কেঁদেকেটে কোনো এক চ্যানেলের এক সাংবাদিককে বলছিল|

যখনই এরকম কোনো লাভজিহাদের ঘটনা সামনে আসে তখনই বহু লোকের মনে হয় এরকম আবার হয় নাকি !! অনেকের মনে হয় প্রেম কি আর অতশত দেখে হয় ? হয়ে গেছিল, প্রেমে অন্ধ হয়ে মানুষ চিনতে ভুল হয়েছে| অনেকে ভাবে ওই ছেলেটাই বদমাশ ছিল, ছেলেরা বদমাশই হয়, সব ছেলেরা এক রকম| একটা ঘটনা দেখে “সব ছেলেরা একরকম” বলা যায়, দু একজন দুর্নীতিপরায়ন নেতাকে দেখে “সব পলিটিশিয়ান চোর” বলা যায়| কিন্তু হাজার হাজার লাভজি হাদের ঘটনা দেখার পরেও “মুহলমানরা হিন্দু মেয়েদের সাথে এরকমই করে” বলা যায় না, ভাবাও যায় না| দুনিয়ার ৯৫% আতঙ্কবাদের ঘটনা মুসলিমদের দ্বারা ঘটানো হওয়ার পরও “মুহলমানরা আতঙ্কবাদী হয়” বলা যায় না| সব ক্ষেত্রে মেজরিটি উইনস হলেও, এসব ক্ষেত্রে ‘সেকুলারিজম উইনস’ হয়|

এসমস্ত ক্ষেত্রে ওদের তরফ থেকে প্রেম দূরদুরন্ত পর্যন্ত থাকে না| সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিতভাবে, মিশন পুরো করার সাবজেক্ট হিসাবে হিন্দু মেয়েদের টার্গেট করা হয়| সাবজেক্টদের টার্গেট করার অনেকগুলো লেভেল থাকে| এটা একটা সাইকোলজিকাল গেম| সাবজেক্টের মানসিক অবস্থা কি, সে কি ভাবছে, তার কোন অভাব আছে কি না, সমাজের প্রতি কোনো অভিযোগ আছে কি না, কোনো ক্ষেত্রে সে কারোর সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে কি না, তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে গেলে তাকে কি রকমভাবে ভাবতে হবে, তার জন্য কি রকম রূপ ধারণ করতে হবে এসবই খুব প্ল্যান মাফিক চালানো হয়| এই প্ল্যানেরই কয়েকটা বিশেষ লেভেল নিয়ে আজকের পোস্ট|

আসলের আমাদের মস্তিস্ক এনার্জি বাঁচানোর জন্য আর চটজলদি সিদ্ধান্ত গ্রহনের সুবিধার জন্য কিছু শর্টকাট বানিয়ে রাখে| এগুলো সবার জন্যে আলাদা হলেও কিছু শর্টকাট সব মানুষের জন্য একরকম হয় এমনও আছে| এগুলোকে সাইকোলজির ভাষায় ট্রিগার পয়েন্ট বলে| মানে আমার মস্তিস্কের বিশেষ ট্রিগার পয়েন্টে চাপ পড়লেই আমি কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারি নিজের অজান্তেই| আজ দুনিয়াতে অনেক বড় বড় বিজ্ঞাপন এজেন্সি এই ট্রিগার পয়েন্টে চাপ দিয়েই তাদের অনেক কিছু জিনিস কিনিয়ে দেয় আমাকে আপনাকে দিয়ে|

এরকম একটা ট্রিগার পয়েন্ট হলো “অভাব”| মানে কোনো জিনিসের যদি অভাব হয় তাহলে সেটাকে বেশি বেশি করে চাইতে শুরু করে আমাদের মন| যখন সিগারেট খেতাম সেসময় এক শীতের রাত সাড়ে এগারোটার সময় খেয়াল হয় যে আমার কাছে আর মাত্র দুটো সিগারেট পড়ে আছে| তখনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে বিশাখাপাত্তনমের সিন্ধিয়া থেকে গাজুয়াকা পর্যন্ত চলে গেছিলাম সিগারেটের খোঁজে| হয়ত আমার দুটোর বেশি লাগত না সকাল হওয়ার আগে, কিন্তু প্রয়োজন হলে কি করব ? কয়েকবছর আগে দেশের একটা মিথ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে নুন পাওয়া যাচ্ছে না| ব্যাস সবাই এত বেশি বেশি করে নুন কিনতে শুরু করে দিল যে সত্যি সত্যিই নুন আর পাওয়া যাচ্ছিল না| এইজন্য়েই বিজ্ঞাপন এজেন্সি কোনো আকর্ষনীয় অফারের সাথে ‘লিমিটেড অফার পিরিয়ড’ লিখে দেয়| আজই কিনে নাও, নাহলে আর পাবে না| সাবজেক্টের মনে হয় এই অফার হাতছাড়া হয়ে গেলে এত ভালো আব্দুল আর পাব না, আব্দুল ছাড়া আমি বাঁচব কেমনে ?যদি জীবনে আব্দুলই না থাকে তাহলে ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবার সব ফালতু| আব্দুল থাকলে সব থাকবে| মানে সাবজেক্ট তার অভাবের শিকার হয়ে গেছে|

এরকমই আরও একটা ট্রিগার পয়েন্ট হলো কমিটমেন্ট আর কনসিস্টেন্সি: কোরিয়ান যুদ্ধের সময় এই ট্রিগার পয়েন্টের ব্যবহার করেছিল চিনী সেনা| ধরা পড়া আমেরিকান সেনাদের অনেক অত্যাচার করেও তারা যখন আমেরিকার কোনো গুপ্ত খবর তাদের থেকে বের করতে অসফল হয়, তখন চিনী সেনা ওই আমেরিকান সেনাদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা সহজ উপায় বলে দেয়| তাদের একটা ডায়েরি দিয়ে তাতে আমেরিকা সম্মন্ধে তাদের যা যা খারাপ লাগা আছে সেগুলো লিখতে বলে| প্রথমে আমেরিকান সেনা তাতে আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ -এর বিষয়ে লেখে, তারপর আরো কিছু, তারপর অন্য কিছু| লিখতে লিখতে তারা মনে মনে যে কখন আমেরিকা বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিল, তারা নিজেরাও বোঝেনি| সেই সময় তাদের আরো একটা ডায়েরি দেওয়া হয়| তাতে বামপন্থা সম্মন্ধে তাদের কি কি ভালো লাগা আছে সেটা লিখতে বলা হয়| এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই সেই আমেরিকান সেনারা আমেরিকার বিরুদ্ধে চীনের হয়ে কাজ করতে রাজি হয়ে যায়| ঠিক এরকমই এখানেও করা হয়| একেবারে শুরুতেই টার্গেটের ওপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হয় না| বরং, তাদের সামনে সেকুলারের ভেক ধরে, আগাপাসতলা সেকুলারিজমের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার হয়ে যায় ওরা| লিবারেল, সেকুলার আব্দুল তখন মোল্লা আর মৌলবীর কথার ভুল ধরে| তাদের কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করে| আতঙ্কবাদ আর আতঙ্কবাদীদের গালাগালি দেয়| নিজেদের ভেজিটেরিয়ান বলে| সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের নীতি কথা শোনায়| একই বোঁটায় দুটো ফুল উপহার দেয় | বন্ধুত্বের ভীত একটু শক্ত হলে টার্গেটের সামনে তার ধর্মের বিরুদ্ধেও দু একটা কথা ছুঁড়ে দিয়ে দেখা হয়, জল কতটা| কিছুদিন পর টার্গেটকে দিয়েই তার ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু কথা বলানো হয়| নিকিতার জন্যে সে পুরো দুনিয়ার সাথে লড়ে যেতে পারে বোঝানোর জন্য অনেক কসরত করে দেখায় আব্দুল| আমির খান রিনা দত্তকে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছিল| রিনার মনে হয়েছিল এর থেকে কেউ বেশি ভালবাসবে না তাকে| এরকমভাবে, নিজের ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ আর আব্দুলের ধর্মের ভালো ভালো কথা শুনতে শুনতে, তার প্রতি আব্দুলের ভালোবাসার কথা চিন্তা করতে করতে নিকিতা যে কখন নফিসা হয়ে যায় নিজেও বোঝে না|

আর একটা ট্রিগার হলো লাইকিং এন্ড ইফেক্ট : নিকিতা যাকে পছন্দ করে তার সবকিছুই তার ভালো লাগে| এটাই স্বাভাবিক| আব্দুল নিকিতার সাথে মন্দিরে যায়, হাতের নিচে হাত রেখে প্রসাদ নেয়, ডানহাতে তাগা বাঁধে| মাঝে মাঝে তো মাথায় তিলকও কেটে নেয়| ও ওসব ধর্মটর্মের বাঁধন মানে না| আমার আব্দুল ওরকম নয়, ও খুব ভালো – এটা বন্ধুবান্ধব কে বার বার বলতে নিকিতা আব্দুলকে সত্যি সত্যিই ভালো লাগিয়ে ফেলে| আমাদের যাকে ভালোলাগে আমরা তার মত হতে চাই| বিরাট কোহলিকে ভালো লাগে বলে তার মত করে দাড়ি কাটে – এরকম কত কোহলিকে আপনি আপানর আশেপাশে ঘুরতে দেখবেন| বাংলা সিরিয়ালের বাহা বা রাশির মত হওয়ার জন্যে কত মহিলা বাহা শাড়ি, রাশির মত শাড়ি গয়না পড়েছে| তাই মনে আব্দুল ধরলে, আব্দুলের সাজও ভালো লাগে| গোঁফ ছাড়া দাড়ি, মাথায় আধখানা ব্রা, ঝিকিমিকি পাঞ্জাবি ভালো লাগে| আব্দুলের পছন্দের কালো তাঁবুও ভালো লাগতে শুরু করে| এ তো গেল পছন্দের কথা|

একবার আমেরিকার এক ক্যান্সার হাসপাতালে একটা এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল| ক্যান্সার রোগ আর রোগীদের জন্যে অর্থদানে অনিচ্ছুক কিছু ব্যক্তির ওপর| তাদের কিছুদিন ক্যান্সার রোগীদের পোশাক পরে হাসপাতালের বিশেষ ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল| অন্য রোগীর সংস্পর্শে না এনে তাদের আলাদাভাবে শুধু পোশাক পরিয়ে হাসপাতালের ঘরে থাকতে বলা হয়| কিছুদিন ওইভাবে থাকার পর ওই অর্থদানে অনিচ্ছুক ব্যক্তিরা শুধু যে অর্থ দিতে রাজি হয়েছিল তাই নয়, তারা অন্যদেরকেও অর্থদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল আর ক্যান্সারের জন্য অর্থ ছাড়াও অন্যান্য অনেক রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল| তাই তাঁবুতে থাকতে থাকতে, গোঁফ ছাড়া দাড়ি, মাথায় আধখানা ব্রা, ঝিকিমিকি পাঞ্জাবি দেখতে দেখতে নফিসারাও ওদের মতোই হয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে|

কমপ্লিমেন্ট : এই একটা জিনিসে কোনো মেয়ের কোনদিন কোনভাবে অরুচি নেই| দিনকে রাত করা, ছয় কে নয় বলা কমপ্লিমেন্ট পেলেও মেয়েরা খুব খুশি হয়| কাজলকেও যদি শাহরুখ “গোরি” বলে তাহলে কাজল নাচে| তাই পাইকারী দরে কমপ্লিমেন্ট দেয় আব্দুলরা| তাদের সেই কমপ্লিমেন্ট-এ মিশে থাকে জন্নত, নুর, হুর, পর্দানশী আরও কত কিছু| পর্দানশী কে বেপর্দা করার আকাঙ্খা প্রকাশ হয়| কোনো হিজাব পরা আরবের সেলিব্রিটির ছবি দেখিয়ে, তাকে কেন এত সুন্দর লাগে নিকিতাকে বলে আব্দুল| প্রেমের আবদারে একবারের জন্য পর্দানশী হয়ে দেখানোর আবদার আসে| নিকিতারাও তাঁবুতে ঢুকে আব্দুলের কমপ্লিমেন্ট চায়| আব্দুল আজ পর্যন্ত দেওয়া সব কমপ্লিমেন্টের বাঁধ খুলে দেয়| সেই কমপ্লিমেন্টের জোয়ার ঠেলে তাঁবু ছেড়ে আর বেরোতে পারে না নিকিতা| তাঁবুর মধ্যে নফিসা হয়ে থেকে যায়|

এসবের মোহ যদি অসময়ে ভাঙ্গে, তাহলে নফিসা কোনো জঙ্গল, নর্দমা, ক্ষেতের মাঝে গলা কাটা বা আধজ্বলা অবস্থায় পড়ে থাকে| একটু দেরিতে ভাঙলে ততদিনে নফিসা বেশ কয়েকটা ছোট আব্দুলের মা হয়ে যায়, আব্দুল, আব্দুলের আব্বা, মৌলানাদের মধ্যে পিংপং বল হয়ে থেকে যায়| কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে অজানার জীবন ব্যতীত করে, বেঁচে থাকে| তবে নিকিতা থেকে নফিসা আর নফিসা থেকে আবার নিকিতা হতে পারার সৌভাগ্য খুব কম মেয়েরই হয়|

অনিন্দ্য নন্দী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.