‘মা খু চিহল পঞ্জম হস্তম’ …..! এই একটা বাক্য দিয়েই বাঙালির আফগান ভাষা ‘পুস্তু’ র সাথে পরিচয়। তার আগে অবশ্য রবিঠাকুর রহমত নামে এক কাবুলির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই আফগান সমাজের মেয়েদের জীবন নিয়ে একটি কথাও বলেননি। অর্ধ শতাব্দী পরে সে দেশের মেয়েদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা সামনে নিয়ে এলেন এক বঙ্গললনা। পুরস্কার ও পেলেন হাতেনাতে, নৃশংস অত্যাচারের পর কালাশনিকভ রাইফেলের একঝাঁক বুলেট। নেমে এলো গোরস্থানের নিস্তব্ধতা!
৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৩। আফগানিস্তানের পাকতিকায় বেশ ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে। ঘরে হাত পা বাঁধা জাঁবাজ চিৎকার শুনছেন। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে গোঙানি। বার বার ডাকছেন, সাঈদা….. সাঈদা …সাঈদা । ওরা যা বলছে মেনে নাও… । পাশের ঘরে বছর পঞ্চাশের সাঈদা শুনবে কি করে? মাথায় পাগড়ি পরা দাড়িওয়ালা ৫-৬ জন নরপশু তখন টানা অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে টেনে মাথার চুল পর্যন্ত উপড়ে নিয়েছে ওরা। রাইফেলের বাট দিয়ে মারছে, লাথি-ঘুসি চলছে। খুলে নিয়েছে পরণের পোষাক। তবুও ওরা যেমনটা বলছে তার সঙ্গে একমত হননি তিনি। একসময় গর্জে উঠলো তাদের কালাশনিকভ, চিরশান্তিতে চলে গেলেন কলকাতা থেকে এক কাবুলিওয়ালাকে বিয়ে করে আসা বাঙালি মেয়ে সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওদেশে যার নামকরণ হয়েছিল সাঈদা কামাল!
আফগানিস্তানের মহিলারা কী ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করেন, সুস্মিতা লেখার আগে তা কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। তাঁর চোখ দিয়ে দুনিয়া প্রথম দেখলো ধর্মের দোহাই দিয়ে তালিবানদের অবাধ যৌনাচার, নির্লজ্জ বহুগামিতা। মাঝে দেশে ফিরে পরিচিতদের বলতেন, ‘আমি একদিন গিয়ে তাঁদের মুক্ত করব।’ মুক্ত আর করা হল না। নিজেই তার আগে পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন।🥀🥀
জুলাই ১৯৮৮, কলকাতা। চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে লম্বা সুপুরুষ আফগান যুবক জাঁবাজ খান-কে বিয়ে করেন সুস্মিতা। বাড়িতে বাবা-মায়ের প্রবল আপত্তি, ব্রাহ্মণ হয়ে ভিনদেশী এক মুসলমানকে বিয়ে করা মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে চলে যান তারা শহর ছেড়ে। কয়েক হাজার মাইল পেরিয়ে সুস্মিতাও জাঁবাজের সঙ্গে চলে আসেন শ্বশুরবাড়ির মুলুক আফগানিস্তানে।
বাঙালি মেয়ের রঙিন স্বপ্ন স্থায়ী হলো না। যে মানুষটিকে বিশ্বাস করে তিনি ঘর পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে বিদেশে এক কথায় চলে এসেছিলেন, সেই জাঁবাজ মিথ্যে বলেছিল। প্রথম স্ত্রী গুলগুটি থাকা সত্ত্বেও সুস্মিতাকে বিয়ে করে জাঁবাজ। শুধু স্ত্রী নয়, এক সন্তানও ছিলো। আফগানিস্তানে গিয়ে এ সব জানতে পেরে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন সুস্মিতা। নিজের কষ্ট ভুলতে চেয়েছিলেন সেখানকার দুর্দশাগ্রস্ত মেয়েদের সাহায্য করে। নার্সিং এবং ফার্স্ট এডের শিক্ষা ছিল তাঁর। তাই দিয়েই মেয়েদের চিকিৎসা শুরু করলেন। নিজে মা হতে পারবেন না জেনে আপন করে নিয়েছিলেন সৎ মেয়ে তিন্নিকে!
তবে বছর খানেকের মধ্যেই তালিবানি শাসন শুরু হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তানে। মনগড়া শরিয়তি আইন দেখিয়ে নারী জাতিকে কী ভাবে দিনের পর দিন বে-ইজ্জ়ত করা হয়েছে তা দেখেছেন নিজের চোখে। মেয়েদের তখন একা বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। বেরুতে গেলে পুরুষ সঙ্গী থাকা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গী আবার রক্তের সম্পর্কের হওয়া চাই। বহুবার রুখে দাঁড়িয়েছেন সুস্মিতা, এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে। শুধু নিজের জন্যে নয়, সেইসব আফগান মহিলাদের জন্য যাঁরা নিজের হয়ে কথা বলতে পারতো না। তারজন্য তাঁকে মারধরও খেতে হয়েছে। এসত্বেও শুধু জাঁবাজের মুখ চেয়ে পড়ে ছিলেন ওদেশে।
জাঁবাজ একদিন কিছু না জানিয়ে ফিরে যান ভারতে। একা পড়ে থাকেন সুস্মিতা। শুরু হয় শ্বশুরবাড়িতে তাঁর তালিবানপন্থী দেওরদের অত্যাচার। এখানেই শেষ নয়, সুস্মিতার প্রতিবাদী চরিত্র দেখে বাড়িতে একরকম ঘরবন্দী করে রাখে। সেখান থেকে দুবার পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ে যান। এরমধ্যেও গোপনে মেয়েদের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালিয়ে যেতে থাকেন । তালিবানিরা জানতে পেরে একদিন আচমকা এসে সুস্মিতাকে প্রচণ্ড মারধর করে। ভেঙে ফেলে সমস্ত চিকিৎসার সরঞ্জাম। হিজাব না পরে বাইরে বেরুনোর জন্য ১৯৯৫ সালে তাঁকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে তালিবানি জঙ্গিরা। জেদি সুস্মিতা কোনক্রমে পালিয়ে আসেন কাবুল। ভারতীয় দূতাবাসের সাহায্যে একদিন চেপে বসেন দিল্লিগামী বিমানে।
ফিরে এসে তাঁর সমস্ত অভিজ্ঞতা বই আকারে প্রকাশ করেন। “কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ”
(১৯৯৮) জায়গা করে নেয় বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায়। ২০০৩ সালে তাঁর কাহিনি নিয়ে সিনেমা তৈরি হয় বলিউডে, Escape from Taliban, পেয়ে যান আন্তর্জাতিক পরিচিতি। থাকতেন হাইল্যান্ড পার্কের কাছে একটি ফ্ল্যাটে, সেখানে মাঝে মাঝে আসতেন জাঁবাজ-ও। তবে টাকাপয়সার টানাটানিতে ফ্ল্যাট বিক্রি করে নাগেরবাজারে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের ওপরে বেশ কয়েকটি বই লেখেন। ২০১৩ সাল নাগাদ ফের একবার আফগানিস্তানে ফেরার কথা ভাবেন। শুভাকাঙ্খী থেকে শুরু করে অনেকেই তাঁকে বারণ করেন। কিন্তু আফগান নারীদের উদ্ধার করার স্বপ্ন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল ঐ মৃত্যু উপত্যকায়। সেই আসাই শেষ আসা। পায়ে পায়ে মৃত্যু তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পেস্তা আঙুর, আখরোট তরমুজের ক্ষেতে ভরা সেই গ্রামে, যেখানে পরম যত্নে আফগান মহিলাদের আগলে রাখতেন সুস্মিতা।
তালিবানদের ফতোয়া অগ্রাহ্য করে সোয়াট উপত্যকায় গুলি খেয়েছে মালালা ইউসুফজাই। চিকিৎসার জন্য ধনী বাবা নিয়ে যায় ইংল্যান্ড, স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে প্রচারের আলো। তবে জন্মভূমিতে আর ফিরে আসার সাহস দেখায়নি সেই বীরাঙ্গনা, বৃটেনের নিরাপদ আশ্রয়ে বসেই পেলেন নোবেল পুরস্কার। কিন্তু সুস্মিতা….?
মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আবার ছুটে গেছিলেন সেই ভিনদেশে। বেঘোরে মারা যান সভ্যতা থেকে অনেক দূরে, যেখানে আজও পৌঁছায়নি প্রচারের আলো। নোবেল তো দূর , যোগ্য সম্মানটুকুও কেউ দেয়নি। হয়তো বা বাঙালি বলেই!
সংকলনে ✍🏻 স্বপন সেন 🌲
তথ্য কৃতজ্ঞতা: টাইমস অব ইন্ডিয়া