গত ১৪ জুলাই রাজ্য বিজেপির মিডিয়া গ্রুপে ৩৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপিং আপলোড করা হয়েছিল। তাতে দেখা গেল, সদ্য কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়া শান্তনু ঠাকুর প্রথমবার তাঁর দফতরের চেয়ারে বসার আগে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের ছবি অফিসের দেওয়ালে টাঙাচ্ছেন। এরপরই শান্তনু একটি টুইট করেন। তাতে লেখেন, আমার খুবই দুঃখ যে আজ প্রধানমন্ত্রী আমাকে ভারতের সংসদে মন্ত্রী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। বিরোধীদের হট্টগোলের জন্য সব ভেস্তে গেল। আসলে নরেন্দ্র মোদী তফশিলি জাতি, উপজাতি, ওসিবি এবং মহিলাদের মন্ত্রিসভায় যেভাবে সম্মানজনক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করেছেন, বিরোধীরা তা মেনে নিতে পারছেন না।
শান্তনুর ওই টুইট বিজেপির বেশ কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী-সমর্থক রি-টুইট করেছেন। মোদীর মন্ত্রিসভা সাম্প্রতিক সম্প্রসারণের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে বিজেপি নেতা মন্ত্রী কর্মীদের টুইটগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রায় নব্বই ভাগই নতুন মন্ত্রিসভায় দলিত, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া বর্গের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে। মন্ত্রিসভার ৭৭ জন সদস্যের মধ্যে ১২জন তফশিলি জাতি, আটজন তফসিলি উপজাতি এবং ২৭ জন অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণি অর্থাৎ ওবিসি সম্প্রদায়ের। শান্তনু তাঁদেরই একজন।
বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই। দিল্লিতে ভারত সরকারের মন্ত্রীর অফিস চেম্বারে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের ছবি স্থান পাওয়াটা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বছর কয়েক আগেও মতুয়া সম্প্রদায় এবং তাদের পথ-প্রদর্শক হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ সম্পর্কে এই বাংলাতেই বা ক’জন জানতেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম জমানায় শেষ প্রান্তে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে দারুন সম্পর্ক তৈরি করে ফেললেন এবং সেখান থেকেই বঙ্গ রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করল। তা আরও বাঁক নেয় বিজেপি মতুয়াদের সম্পর্কে সমান আগ্রহী হয়ে ওঠায়। মতুয়া ভোটের তাগিদে তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের মতো নরেন্দ্র মোদীও বড়মা বীণাপানি দেবীর পা ছুঁয়ে প্রণাম ঠুকে এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত শান্তনু ২০১৯-এ বিজেপির টিকিটে এমপি এবং দু’বছরের মাথায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্থান পেলেন। যদিও মতুয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে ঠাকুরবাড়ির বউমাকে তৃণমূল নেত্রীই প্রথম ভারতের সংসদে পাঠিয়েছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে মন্ত্রিসভায় এবার আরও যে তিনজন স্থান পেয়েছেন, তাঁদেরও জাতিগত পরিচয়টি রাজনীতিতে অনালোচিত থাকতে পারে না। কোচবিহারের নিশীথ প্রামাণিকের নাগরিকত্ব বিরাট প্রশ্নের মুখে। তিনি জাতিতে রাজবংশী। এই প্রথম একজন রাজবংশী ভারত সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদীর সৌজন্যে। একইভাবে আলিপুরদুয়ারের জন বার্লা, যিনি বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার পরপরই উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য করার ডাক দিয়ে শোরগোল ফেলে দিলেন, দল তাঁর বক্তব্য খারিজ করে দিলেও তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সুভাষ সরকার মন্ত্রী হয়েছেন পিছিয়ে থাকা জেলা বাঁকুড়া থেকে। মোদীর লক্ষ্য ২০২৪-এর আগে বাংলার আদিবাসী সমাজকে বার্তা দেওয়া।
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, কেন্দ্রের সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভায় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব খতিয়ে দেখলে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের ভাবনার একটি সূত্র লক্ষ্য করা যায়, যা আসলে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর তাঁদের নতুন স্লোগানের বাস্তবায়ন। ‘সবকা সাথ-সবকা বিকাশ’ স্লোগানের সঙ্গে সেবার যোগ করেন ‘সবকা বিশওয়াস’। অর্থাৎ সকলের আস্থা অর্জন। সেই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন এবারের মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণে দেখা গিয়েছে নানা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে।
যেমন উত্তরদেশ। আগামী বছর মার্চে সেখানে বিধানসভার ভোট। ওই রাজ্য থেকে এবার নতুন যে সাতজনকে মন্ত্রী করা হল, তাঁদের একজন ব্রাহ্মণ। বাকিদের ছয়জনের তিন জন তফসিলি জাতি এবং তিন জন ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত। একইভাবে কর্নাটকে প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত এবং ভোক্কালিঙ্গা সম্প্রদায় থেকে বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রী করেছেন মোদী, যাঁরা দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। ত্রিপুরা থেকে এই প্রথম একজন মন্ত্রী হলেন এবং তিনি মহিলা। মন্ত্রিসভায় মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা যথেষ্ট না হলেও আগের তুলনায় বেশি। নির্মলা সিতারামনকে প্রথমে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পরে অর্থমন্ত্রী করেছেন মোদী। স্মৃতি ইরানিকে মন্ত্রিসভা থেকে না সরিয়ে তাঁর গুরুত্ব বজায় রাখা হয়েছে। পরিবর্তে বেশ কিছু নতুন মুখ আনা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের নারায়ণ রানেকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে মোদী শিবসেনার অস্তিত্ব ধরে টান মারার রাস্তা খুললেন। রানে ওই রাজ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। মহারাষ্ট্র থেকে আরও যাঁদের এবার মন্ত্রী করা হয়েছে তাঁরা সকলেই তফসিলি জাতি সম্প্রদায়ের মানুষ।
আসলে মোদী-অমিত শাহদের মিশন ২০২৪ নিয়ে এখন থেকেই ভাবতে হচ্ছে। গেরুয়া শিবির বেশ বুঝতে পারছে, হিন্দুত্বের তাস দিয়ে ভারত বিজয় আর সম্ভব নয়। তাছাড়া, বিজেপি তার জন্মের পর বিগত ৪২ বছর যে ইস্যুগুলিকে হাতিয়ার করে এতদূর এসেছে সেগুলির বেশিরভাগই চূড়ান্ত প্রয়োগ হয়ে গিয়েছে। যেমন ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় শ্রীরাম’ বলে হিন্দুত্ববাদীরা যতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্যক্ত করার চেষ্টা করুক না কেন, রাম মন্দিরের শিলান্যাস এবং নির্বিঘ্নে মন্দির নির্মাণের কাজ চলায় এবং মুসলিম সমাজ প্রায় মুখে কুলুট এঁটে থাকায় মন্দির-মসজিদ রাজনীতি অদূর ভবিষ্যতে খুব একটা কাজে আসবে না।
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার মধ্য দিয়ে বিজেপির আর একটি ইস্যু খরচ হয়ে গিয়েছে। রইল বাকি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর। সেটা কতটা কঠিন গেরুয়া শিবির তা জানে। তার থেকেও কঠিন বিষয়টি মানুষকে গেলানো। তাছাড়া তালাক বিরোধী আইন কার্যকর করাতেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকরের দাবিটি খানিক ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। অতএব বিজেপিকে নতুন ইস্যুর সন্ধান করতে হচ্ছে। যেমন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, লাভ জিহাদ, গো-মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তারা সামনের সারিতে আনতে চাইছে।
কিন্তু ২০২৪-এর আগে ভোট আরও নানা কৌশলে সুসংগত করা তাদের কাছে অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সবাই জানে সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। টানা রাম রাম করার পরিনতি কী, সবাই জানে। তাই বিজেপির এমন ইস্যু আনা দরকার যা মানুষকে দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখবে।
রাজ্যে রাজ্যে দুর্বল হতে হতেও ১৮টি রাজ্যে কংগ্রেসের সাংসদ আছে। হতে পারে তাঁরা সম্মিলিতভাবে সংখ্যায় মাত্র ৫৪। কিন্তু বিজেপির এখন পয়লা নম্বর টার্গেট আঞ্চলিক দলগুলি, যাদের জন্ম ও বিকাশ স্থানীয় মানুষের প্রত্যাশা পূরণের সংকল্প রক্ষার শপথের মধ্য দিয়ে। সেই পথে তারা এখন বিপুল ভোট ব্যাঙ্কের মালিক, সেখানে বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র, দুই জনগোষ্ঠীরই প্রতিনিধিত্ব আছে। জাতপাতের রাজনীতির চেনা মডেল না হলেও তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কের মূল আমানত কিন্তু বাংলার পিছিয়ে পড়া বর্গ। বিহার, উত্তরপ্রদেশে লালুপ্রসাদ, নীতীশকুমার, মুলায়ম সিং যাদব, মায়াবতী, অখিলেশ প্রমুখের রাজনীতির ভিতও সকলের জানা। ওড়িশায় নবীন পট্টনায়েক আবার উৎকল জাতীয়তাকেই হাতিয়ার করেছেন। দক্ষিণের আঞ্চলিক দলগুলিও তাই।
বিজেপির টার্গেট এই ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরানো। এই ভোট ব্যাংকের সিংহভাগ একটা সময় পর্যন্ত ছিল কংগ্রেসের দখলে। এবার আর একটি সর্বভারতীয় দলের ছাতার তলায় সেই ভোটকে ফেরানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। মাথার উপর ছাতাটির শুধু রং আলাদা।
সেই লক্ষ্যে বিজেপি একদিকে যেমন দল ও সরকারে প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব বাড়াচ্ছে অন্যদিকে, রাজ্যে রাজ্যে জীবিত ও প্রয়াত বিশিষ্ট মানুষদের সমাদর করে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নয়া মডেল তৈরির কাজে লেগে পড়েছে। এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোদী-অমিত শাহ থেকে দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহারা যেমন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বুকে ব্যথার খবরে বলতে গেলে হাসপাতালে রাত জাগার কথা ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন, কেউ আবার ছুটছিলেন বুম্মাদা অর্থাৎ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বামপন্থী নাট্য ব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীদের বাড়িতে। তেমনই ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে স্মরণ করেছেন উনিশ শতকের কবি, নাট্যকার ও সাংবাদিক মনোমোহন বসুকে। অমিত শাহ একই সফরে গিয়েছেন শান্তিনিকেতন, ক্ষুদিরাম, অরবিন্দর বাড়ি।
বিশিষ্ট বাঙালি বলতে গেরুয়া শিবিরের বরাবর শ্রদ্ধা ভক্তি পেয়ে এসেছেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র এবং বিজেপির গর্ভ হিন্দু মহাসভা ও জনসংঘের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সেই তালিকাটি এখন এতটাই লম্বা যে তাতে রাজ্যের দ্বিতীয় কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের নামও জ্বলজ্বল করছে, যাঁকে বাংলার রূপকার বলা হয়। আর এবার ভোটে বিজেপির পয়লা নম্বর প্রতিশ্রুতি ছিল ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ঘোষণা।