হিন্দু সমাজে প্রচলিত অগণিত ব্রত উৎসবের মধ্যে গুরুপূর্ণিমা স্বকীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে গুরুপূর্ণিমা উৎসব আচরিত হয়। ঘটনাচক্রে এই তিথিতেই মহর্ষি বেদব্যাসের জন্ম। বেদের শ্রেণীবিন্যাস, পুরাণ রচনা, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক উপদিষ্ট শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সঙ্কলন, বেদের জ্ঞানকাণ্ডের স্বরূপ নির্ণয়াত্মক ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি হিন্দু সমাজে দীর্ঘকাল সংরক্ষিত জ্ঞানপরম্পরাকে পুনর্ব্যবস্থিত করেছেন। পরবর্তী কালে গৌতম বুদ্ধ এই তিথিতেই সারনাথে শিষ্যদেরকে ধর্মচক্রপ্রবর্তন সূত্র নামে প্রসিদ্ধ ধর্মোপদেশ প্রদান করেন।
সুপ্রাচীন হিন্দু সমাজের সমস্ত উন্নতির ভিত্তি ছিল সুব্যবস্থিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় আত্মনির্ভর গ্রামকুল এবং সমাজে সর্বজনীন, নিঃশুল্ক, সমাজোপযোগী ও জীবনোপযোগী শিক্ষার সুবন্দোবস্ত। গুরুকুল ও তপোবনে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ যোগ্যতা অনুসারে যথাযথ শিক্ষা লাভ করত। গুরুকুল এবং তপোবনগুলির আবাসিক সমস্ত ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সমস্ত ঐহিক প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব সমাজ স্বস্কন্ধে ধারণ করেছিল। গুরুপূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে প্রত্যেক গৃহস্থ বা উপার্জনশীল ব্যক্তি নিজ গুরুকুলের উন্নতিকল্পে নিঃস্বার্থ ভাবে দান করত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয়তার অভাবে এই পরম্পরা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য কমেনি। হিন্দু সমাজে গুরুর গুরুত্ব প্রবল। যে কোন বিদ্যা গুরু কর্তৃক উপদিষ্ট হলে তবেই সফল ও সার্থক হয়— এমনটাই হিন্দুদের বিশ্বাস। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি অবতারপুরুষরাও নিজেদের জীবন সাধনা গুরুদের মার্গনির্দেশেই করেছেন এমনটাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য প্রমুখ ঋষিরাও নিজেদের জ্ঞানসাধনায় গুরুকেই পথিকৃৎ রূপে বরণ করেছেন। গুরু শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ উপদেশকর্তা। নির্বচনগত অর্থ— যিনি অন্ধকার থেকে প্রকাশে নিয়ে আসেন তিনি।
হিন্দু পরম্পরায় জ্ঞানকে অনাদি মনে করা হয়। জ্ঞানই সম্পূর্ণ জগতের প্রতিষ্ঠা। মানব সভ্যতার যাত্রা হল অজ্ঞান থেকে জ্ঞানের উদ্দেশে যাত্রা। উপনিষদ বলেছেন, সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তং ব্রহ্ম— সচ্চিদানন্দ পরমেশ্বর সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, অনন্ত। সেই জ্ঞানস্বরূপ পরমেশ্বরের উপলব্ধিই মনুষ্যজীবনের লক্ষ্য। জ্ঞানস্বরূপ পরমেশ্বরের বিস্মৃতিই বন্ধন। এই বিস্মৃতি বা অজ্ঞানরূপী বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মাকে আবিষ্কার করার নামই মোক্ষ।
জ্ঞানযাত্রার গুরুত্ব আরোপের জন্য সংসারের ব্যাবহারিক যাপনকে হিন্দু সভ্যতায় অস্বীকার করা হয়নি। সেজন্য জ্ঞানপরম্পরাকে দুইটি ধারায় বিভক্ত করা হয়েছে— মোক্ষসাধক পরা বিদ্যা এবং ব্যাবহারিক উৎকর্ষের সাধক অপরা বিদ্যা। উপনিষদ বলেছেন, দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে পরা চৈবাপরা চ— দুইটি বিদ্যার অধ্যয়ন করতে হবে, পরা এবং অপরা। এবং পূর্বোক্ত প্রকারে, সমস্ত বিদ্যাই গুরু কর্তৃক উপদিষ্ট হয়েই সার্থক হয়।
সেজন্য জ্ঞানপরম্পরাতে গুরুর মাহাত্ম্য অনস্বীকার্য। সেই সঙ্গে এটাও প্রণিধানযোগ্য যে সমস্ত জ্ঞানপরম্পরাতেই— পরা কিংবা অপরা— পরমেশ্বরকেই প্রথম গুরু রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
মহর্ষি পতঞ্জলি বিরচিত যোগদর্শনের প্রথম পাদে মুক্তিলাভের উপায়ের মধ্যে একটি উপায় নির্দেশ করা হয়েছে— ঈশ্বরোপাসনা। প্রসঙ্গতঃ, ঈশ্বরের স্বরূপ নিরূপণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে তিনি নিরতিশয় সর্বজ্ঞ— সমস্ত জ্ঞানের আধার। এবং “স পূর্বেষাম্ অপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ” (যোগসূত্র ১/২৬) তিনি পূর্ব পূর্ব গুরুদেরও গুরু, কারণ, তিনি কালে পরিসীমিত নন। সৃষ্টির পরে যত ব্যক্তি জ্ঞান পরম্পরায় জ্ঞানোপদেশ করেছেন তাঁরা সকলেই কালের সীমায় আবদ্ধ। তাঁরা প্রত্যেকেই মরণধর্মা। অথচ জ্ঞানপরম্পরা নিত্য প্রবহমান। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পূর্বে, ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংসের পরেও জ্ঞান বিদ্যমান। সেই জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মা কালে আবদ্ধ নন। সেজন্যই তিনি সমস্ত গুরুরই গুরু। সেই সর্বজ্ঞ, সর্বাতিশায়ী শক্তির আধার, সমস্ত জ্ঞানের উপদেষ্টা পরমেশ্বরই নানা নাম ও রূপে নিজেকে বিকশিত করে দৃশ্যমান সৃষ্টি রূপে প্রকট হয়েছেন। সৃষ্টির প্রতি কণায় তিনি নিত্য বিরাজমান। এই সত্যের অন্বেষণই সাধনা।
জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মাই নিজেকে জগৎরূপে বিকশিত করে তাতে ওতপ্রোত— সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম।
সৃষ্টির নামরূপাত্মক স্বরূপটি অনিত্য, সারভূত পরমাত্মাই নিত্য— ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা। (মিথ্যা শব্দের অর্থ অনিত্য)
আমি সহ এই সম্পূর্ণ সৃষ্টিই তাঁরই অংশমাত্র— জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।
এই সৃষ্টিতে সমস্তই এক সূত্রে গাঁথা। সকলেই একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সর্বত্র এক চেতনের বিস্তার। সৃষ্টির একাত্মতার বোধ জাগ্রত করাই আমাদের জীবনলক্ষ্য। গুরু সেই লক্ষ্য পূরণে আমাদের সহায়ক হন। গুরুর মাধ্যমেই পরমেশ্বর আমাদেরকে সেই বোধে উন্নীত করেন। তিনিই আমাদের শক্তির উৎস, তিনিই আমাদের মার্গদর্শক— এই ধারণার চিন্তন-মননের মাধ্যমে সমস্ত নৈরাশ্য ও অবসাদকে জীর্ণ করে নিজেদের আদর্শের প্রতি সমর্পণের ভাবনাকে সুদৃঢ় করে নতুন উৎসাহে হিন্দু সংস্কৃতিতে প্রোথিত একাত্মতার ভাবনাকে সমগ্র জগতে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজকে নতুন গতি প্রদান করি আমরা।
রাকেশ দাশ