‘স্বর্গাদপি গরীয়সী তুমি মা, বীরপ্রসবিনী জননী, বাজুক নিত্য কালের চিত্তে তোমারই জয়ধ্বনি, জয় হিন্দ, জয় হিন্দ!
আজ রোমন্থন করব এক মারাঠাবীরের কাহিনি যিনি স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
তিনি হলেন ভারতের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের জনক বালগঙ্গাধর তিলক। এককথায় তাঁকে বিশেষিত করা দুঃসাধ্য। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজসংস্কারক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয় নেতা আবার অন্যদিকে ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃত, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও হিন্দুদর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। বালগঙ্গাধর তিলককে বলা হয় লোকমান্য তিলক। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার এবং আমরা তা অর্জন করবই’। তিলকের এই উক্তি উদ্বুদ্ধ করেছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে।
১৮৫৬ সালের ২৩শে জুলাই মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে চিতপাবন ব্রাহ্মণ বংশে তিলকের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং গণিতে তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি অন্যায় অবিচার একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। সত্যের প্রতি ছিলেন অবিচল। তিলক ছিলেন ভারতের যুবকদের মধ্যে প্রথম প্রজন্ম যাঁরা আধুনিক কলেজ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। তিলক গণিতে প্রথম শ্রেণির স্নাতক হন এবং তারপর আইন পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন । তিলকের কর্মজীবন শুরু হয় গণিতের শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তিনি সাংবাদিকতার কাজ গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধার ভাব তাঁকে পীড়া দিত এবং এ কারণেই তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবল সমালোচনা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘ডেকান এডুকেশন সোসাইটি’ ভারতীয় যুবকদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য। এর পরের বছরই তিনি দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতে শুরু করলেন – ‘কেশরী’ যেটি মারাঠি ভাষায় মুদ্রিত হত এবং ‘মারাঠা’ যার ভাষা ছিল ইংরেজী। তাঁর পত্রিকায় তিনি দেশের মানুষের প্রকৃত দুরবস্থার স্পষ্ট চিত্র এঁকেছিলেন। জ্বালাময়ী ভাষায় তিনি ঘুমন্ত ভারতবাসীদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দুটি পত্রিকাই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
বালগঙ্গাধর তিলকের রাজনৈতিক জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন ১৮৯০ সালে। এছাড়াও তিনি পুণে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং বম্বে বিধানমণ্ডলের সদস্য ছিলেন এবং তিনি বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ নির্বাচিত হন। সমাজসংস্কারমূলক কাজেও তাঁর মহৎ ভূমিকা ছিল। তিনি বাল্যবিবাহের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন। গণপতি উৎসব এবং শিবাজীর জন্মোৎসব পালনের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে একত্র করতে চেয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলার বিপ্লব আন্দোলনে সরলা দেবী চৌধুরাণীর প্রবর্তিত শিবাজী উৎসব, দুর্গাপুজোয় বীরাষ্টমী উৎসব, লাঠি খেলা, অসি চালনা প্রভৃতি মারাঠাদেরই অবদান। কারণ, সরলা দেবীর মামা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বোম্বাই প্রদেশে জেলা জজ তখন তিনি তাঁর মামার কাছে গিয়েছিলেন এবং সম্ভবত ১৮৯২ সালে মারাঠাদের নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংস্পর্শে এসেছিলেন।
যাই হোক, যা বলছিলাম – মারাঠা সিংহ তিলকের সম্বন্ধে। ১৮৯৭ সালে তিলকের বিরুদ্ধে বৃটিশ সরকার অভিযোগ আনে যে তিনি জনগণের মধ্যে বৃটিশ সরকারের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব জাগিয়ে তুলছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এবং আইন ও শান্তি ভঙ্গ করছেন। এই অভিযোগে তিনি জেলবন্দী হন দেড় বছরের জন্য। ১৮৯৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিলক স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন। সংবাদপত্র এবং বক্তৃতার মাধ্যমে তিলক মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে স্বদেশী আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন এমনকি তাঁর বাড়ির সামনে স্বদেশী জিনিসের বাজারও খোলা হয়।
ভারতের জাতীয় রাজনীতিও এই সময় থেকেই অন্য দিকে বাঁক নেয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় – নরমপন্থী এবং চরমপন্থী এই দুই মতবাদে। এতদিন যেখানে নরমপন্থী নেতৃত্বগণ ইংরেজ সরকারের প্রতি আবেদন-নিবেদন নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন, সেখানে চরমপন্থীদের দাবী হল স্ব-শাসন। বলা বাহুল্য, চরমপন্থীদের নেতৃত্ব দেন বাল গঙ্গাধর তিলক। ১৯০৬ সালে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। ছয় বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর বার্মার মান্দালয় জেলে। এই দীর্ঘ সময় তিনি জেলের ভেতর লেখাপড়াতেই অতিবাহিত করেন। ‘গীতা-রহস্য’ তাঁর এই সময়ের রচিত গ্রন্থ। ১৯১৪ সালের ৮ই জুন তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। তিলক কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী মতবাদকে একত্রীভূত করতে চেষ্টা করলেও সে চেষ্টা সফল হয় নি। অবশেষে তিনি একটি পৃথক সংগঠন স্থাপন করেন – ‘হোমরুল লীগ’। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বরাজ। বালগঙ্গাধর তিলক গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বরাজের অর্থ আপামর ভারতবাসীর মনে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শরিক করতে চেয়েছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। ‘হোমরুল লীগ’ এর কার্যপদ্ধতি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সকলকে বুঝিয়ে তাদের হৃদয়ে স্বাধীন ভারতের চিত্র অঙ্কন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় ক্রমাগত ভ্রমণ করে গেছেন মানুষকে সংঘটিত করার জন্য। মানুষের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য বাল গঙ্গাধর তিলকের এই আত্মত্যাগ তাঁকে মহীয়ান করে তুলেছে। ১৯২০ সালে ১ অগস্ট মৃত্যু হয় মহাপ্রাণের।
সূত্র – আনন্দ বাজার পত্রিকা