করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ শেষ হতে না হতেই শিয়রে দাঁড়িয়ে তৃতীয় ঢেউ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তো ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে, তৃতীয় ঢেউয়ের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে আমরা। অর্থাৎ ফের আংশিক লকডাউনের (Lockdown) পথে হাঁটতে পারে দেশ। এই পরিস্থিতিতে আরও একবার মাথাচাড়া দিচ্ছে বেকারত্ব। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়া ইকনমি (সিএমআইই)-র (CMIE) রিপোর্ট বলছে গত মার্চ-এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে একধাক্কায় দেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১১.৯০ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ৭.৯৭ শতাংশ। আর জুনে দাঁড়িয়েছে ৯.১৭ শতাংশ। এই মুহূর্তে দেশে মোট বেকারত্ব ৭.৬ শতাংশ। শহরে ৮.৪ শতাংশ এবং গ্রামে ৭.২ শতাংশ। আশার আলো, চলতি মাসে ৮ শতাংশের নীচে বেকারত্বের হার রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ হাঁটছে উল্টো পথে। গত দুই মাসে নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে বেকারত্ব।
দেশে বাংলার স্থান কোথায়?
অতিমারির জেরে বিধ্বস্ত অর্থনীতি। গত মার্চ ও জুলাইয়ের মাঝামাঝি সর্বোচ্চ হয় করোনা সংক্রমণ। কার্যত বাধ্য হয়েই লকডাউনের পথে হাঁটতে হয় অধিকাংশ রাজ্যকে। ভয়াবহ হয়ে ওঠে মহারাষ্ট্র, দিল্লির পরিস্থিতি। স্বাস্থ্যক্ষেত্র ছাড়া বাকি প্রায় সব সেক্টরের উত্পাদন স্তব্ধ থাকে। স্বাভাবিক কারণেই গত এক বছরে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ হয় মে মাসে। সংক্রমণের সঙ্গে বেকারত্বের হারও একটু কমে জুন মাসে। রাজ্যগুলির মধ্যে পুদুচেরির বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। ৪৭.১ শতাংশ। উল্লেখ্য, এপ্রিল মাসে বেকারত্বের হার ছিল মাত্র ২.৭ শতাংশ। এরপর হরিয়ানা ২৭.৯ শতাংশ, রাজস্থান ২৬.২ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গ ২২.১ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের মতো ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া রাজ্য বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে যথাক্রমে বেকারত্বের হার ১০.৫ শতাংশ ও ১২.৮ শতাংশ। গুজরাটে ১.৮ শতাংশ বেকারত্বের হার। একমাত্র সিকিমে বেকারত্বের হার শূন্য।
বেকারত্বে ‘এগিয়ে বাংলা’
গত মে মাসের ১৬ তারিখ লকডাউন (কড়াকড়ি বিধিনিষেধ) ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। সিএমআইই-র রিপোর্ট বলছে, মে মাসে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়ে যায়। জুন মাসে বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ভোট পর্ব থাকায় লকডাউনের পথে হাঁটেনি রাজ্য। এপ্রিলের পর থেকে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি হতে থাকে। এরপর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় সংক্রমণ। বাধ্য হয়েই মে মাসের মাঝামাঝি লকডাউন ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকে। স্বাভাবিকভাবেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ হারান প্রচুর মানুষ। গত লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্য ফিরে আসার পর এখানে স্থায়ীভাবে কাজ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সিএমআইই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি মাসে বেকারত্বের হার ছিল ৫.২ শতাংশ। বিহার, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানার থেকে অনেক নীচে ছিল পশ্চিমবঙ্গের স্থান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রাজ্যেই কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। লকডাউন ঘোষণার পর গণপরিবহণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিদারুণ প্রভাব পড়েছে তাঁদের জীবনযাত্রায়।
বেকারত্ব বাড়ল কেন?
গত ফেব্রুয়ারিতে লোকসভায় কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক থেকে জানানো হয়, ১.২৩ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক নিজেদের রাজ্যে ফিরে গিয়েছে। যার মধ্যে ৫০ শতাংশ (৬১, ৩৪, ৯৪৩ জন) উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ। প্রায় ১৪ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক চলে আসে পশ্চিমবঙ্গে। গত এক বছরে বেকারত্বের ধারাবাহিক হার ৪ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে ঘোরাঘুরি করেছে। এর মধ্যে দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন এবং করোনার প্রথম ঢেউ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বেকারত্বে অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধির হার লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু গত দু’মাসে বেকারত্বের হার যে জায়গা পৌঁছেছে, স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে। আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে আসছে, মে মাসের শেষের দিকে যশ ঘূর্ণি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ। প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বাংলায়। রাজ্য সরকার এক হাজার কোটি টাকার ‘দুয়ারে ত্রাণ’ প্রকল্প ঘোষণা করেছে। গত ১৫ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, ইতিমধ্যেই টাকা দেওয়া হয়েছে ১৯ লক্ষ ১০ হাজার মানুষকে। ১ জুলাই থেকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা ঢুকে যাচ্ছে। এর জন্য প্রায় ৩৬৪ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ:
বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য জানান, যে সরকার নিয়োগ ঠিকঠাক করতে পারে না, সেখানে বেকারত্ব তো বাড়বেই। বারবার আদালতে ঠক্কর খাচ্ছে। সরকারের উচিত, যে সব জায়গায় ভ্যাকেন্সি রয়েছে দ্রুত নিয়োগ করা। তবে, তৃণমূল এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। তৃণমূল নেতা তাপস রায়ের বক্তব্য, আমরা অভূতপূর্ব সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এই বেকারত্ব মোকাবিলায় সরকার নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সফলভাবে কার্যকরও হয়েছে। বিশ্বব্যাপী যে করোনার প্রভাব পড়েছে, তার আঁচ বাংলায় পড়বে স্বাভাবিক। তবে প্রতিনিয়ত সরকার তার পদক্ষেপ করে চলেছে।