রেষারেষি দীর্ঘজীবি হোক

বাঙালির সব গেছে। একরাতে ভিটে গেছে, মাটি গেছে, গোল্লাছুটের মাঠ গেছে। কলকাতা থেকে রাজধানী গেছে, নৈহাটি থেকে জুটমিল গেছে। সিঙ্গুর থেকে টাটা গেছে, লালবাড়ি থেকে প্রশাসন গেছে। বাঙালি সব হারিয়েছে। এবার কি বাঙালি ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের রেষারেষিটাও আজীবনের জন্য হারাবে?

ভাবুন তো পাকিস্তানের কোন ভারত প্রতিবেশী হিসেবে নেই কিংবা গব্বরের কোন ঠাকুর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নেই। ভাবুন তো, মগনলালের ফেলুদা নেই আর সিপিএম এর মমতা বন্দোপাধ্যায় নেই। ভাবুন তো রামের রাবণ নেই, সাপের নেউলে নেই, বাহুবলীর ভল্লালদেব নেই, বুনো ওলের বাঘা তেঁতুল নেই৷

ভাবুন তো মোহনবাগানের ইস্টবেঙ্গল নেই। মাচার উল্টোদিকের গ্যালারিতে লোটা নেই। প্যাঁক নেই, টিটকিরি নেই, লজেন্স দিদি নেই, ভেঁপু কাকু নেই, টুটু বসু নেই, নিতু সরকার নেই। ভাবুন তো গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে সবুজ মেরুনের জন্য লাল হলুদ নেই। ধ্যাৎ!

ভাবুন তো, প্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বীসমীপেষু লিখে তারপর বাছা বাছা চার অক্ষর দিয়ে চিঠি ভরিয়ে পোস্ট করা নেই ময়দানের ডাকবাক্সে। ভাবুন তো চিডির ভাই বলে কাউকে ডাকার নেই, চা নেই। চিনি নেই, দুধ নেই। আধা কর্তা, সিকি কর্তা, আনি কর্তা নেই, অঞ্জন, স্বপন বল, পল্টু দাসের উত্তরসূরি নেই। ভাবুন তো জাতীয় ক্লাব বললেই ফ্যাক করে হেসে ফেলা নেই। ভাবুন তো ‘আমাগো গ্রামের বাড়িতে চুয়াল্লিশটা সুপুরি গাছ ছিল’ বললেই মস্করা নেই।

বারাসাত, বিরাটি, মোহনবাগান রো, যাদবপুর বা আজাদগড় কলোনির এঁদো গলি থেকে ম্যাটাডর করে যুবভারতী যাওয়া নেই, ফটজল, পেপসি, বুড়ির চুল থেকে পাইল করা রাম নেই, ডার্বির রোববারে ম্যাটাডর থেকে বাঁধানো খিস্তি নেই।

বাঙালির সব গেল। কতো রক ভেঙে রাস্তা চওড়া হলো, লাহাবাড়ির পেনাল্টিজ্যাঠা আমেরিকা চলে গেল। মল্লিকরা কবেই মুম্বাইয়ে বসে খেলা দেখে আর ফোন করে ঝগড়া করে প্রতি ম্যাচের শেষে সাহা বাড়ির ন’মামার সাথে। ওদের দালান ভেঙে বিচ্ছিরি ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে। আর কেউ পাড়ার মাঠে আসেনা। ঘটিগরম কাকুও না।

আজন্মের চুলোচুলি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভালো। এই দ্বন্দ্ব না থাকলে, রেষারেষি না লাগলেই যেন খারাপ লাগে। যেভাবে শ্যামবাজারে বিরাট একটা জমিদারের কাচারির উপরে মাল্টিস্টোরেড উঠলে লাগে, পাড়ার মিষ্ঠু আর মাগুর মুম্বাই চাকরি নিয়ে চলে গেলে লাগে, দত্তপুকুরের চশমাকাকু স্টেডিয়ামে না গেলে লাগে, সেকরম একটা খালি খালি লাগে ইস্ট বেঙ্গল আর মোহনবাগান ডার্বি না দেখতে পেলে।

আইএসএল এ মোটা স্পন্সরশিপ নিয়ে প্রথম ঢোকার অহং নিয়ে চলুক মোহন। ফের ৫-০ হারিয়ে খিল্লি করুক ইস্টবেঙ্গল। কেউ হুইলচেয়ার, কেউ পুত্রকে চিতায় তুলে, কেউ কেমো নিয়ে ফের ময়দানে দু’দলের ফাইট দেখতে আসুক। কেউ একদিন হেরে গিয়ে হাউহাউ করে কাঁদুক, কেউ আরেকদিন জামা খুলে নাচুক। কিন্তু ময়দানের ফুটবলটা জিতুক। বাঙালির এই আবেগটা অক্ষয় থাক।

এই ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান বাঁচলেই বাঙালির ইলিশ আর চিংড়ি, ঝগড়া করা, গুলতানি মারা, ছক্কা মারতে গিয়ে কাঁচ ভেঙে ফেলা, শিল্ড জিতে বেম্বোদার বারান্দায় চকলেট বোম মারা, একসাথে প্রথম সুখটান, মমতা কুলকার্নির বলিউডি গান, ম্যাচের শেষে ঘেমে-নেয়ে বাড়ি ফেরার সময় চোখাচোখি বিনুনি আর স্কার্ট, কোন অষ্টাদশীর জানালা থেকে প্রেমপত্র ছুঁড়ে দেওয়া- সব বেঁচে থাকবে।

ইস্টবেঙ্গলকে শেষ করতে দেওয়া যাবে না। মুছে ফেলা যাবে না এর নাম। বাঙালি বহুবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওপার থেকে এসে এপারে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যতবার দেশভাগের ক্ষত, পিঠের কাঁটাতারের দাগ মনে করিয়ে দিয়েছে নিজের ছিন্নমূল আমিকে, ততবার লাল-হলুদ প্রলেপ লাগিয়েছে ক্ষততে। ক্লাব কি কেবল ম্যানেজমেন্টের? ক্লাব তো রক্তমাংসের, ক্লাব ওপারের এক মুঠো মাটি এপারে নিয়ে আসার, একরাতের নোটিশে ওপারের পাড়ার মাঠ ছেড়ে এপারের রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ার। এই লেগাসি শেষ কইরা ফেলুম? হতাশ হওয়ার কোনো জায়গা নাই। কোমর বাঁধুন। জোর লড়াই। সকলে মিলে ঠিক সামাল দিয়া দিমু। দাবায় রাখতে পারবা না। জয় ইষ্ট বেঙ্গল!

©—– ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

EastBengal #MohunBagan #KolkataDerby

MayukhRanjanGhosh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.