মাননীয়া,
মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়া সমীপেষু,
আপনাকে এই খোলা চিঠি লিখিবার উদ্দেশ্য হইল আপনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা। ধন্যবাদ মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, দীর্ঘ ৮ বছর পরে আপনার কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভাঙিয়াছে (সম্ভবত তোষামোদীদের পক্ষ হইতে আপনার নাসিকায় সরিষার তৈলের সরবরাহের স্বল্পতায়)। দ্বিতীয় কারণ, দেরিতে হইলেও, আপনি দীর্ঘ ঘুমের ঘোর কাটাইয়া কিছু কিছু বিষয় স্পষ্ট দেখিতেছেন।
যেমন, আপনি রাজ্যের বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার প্রবীণ মন্ত্রী শ্রদ্ধেয় বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরীর পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া দেখিতে পাইয়াছেন—আপনার দলের প্রিয় ভাইসকল কাটমানি খাইয়া লাল হইয়া গিয়াছেন। অর্থাৎ বামফ্রন্টের লাল জমানার দিনগুলির মতোই দলীয় কর্মীরা রাজ্যের বিবিধ প্রকল্প হইতে ‘নিজস্ব কমিশন’ খাইতে খাইতে এমন পর্যায়ে পৌঁছাইয়া গিয়াছেন যে আপনাকে নিজ মুখে বলিতে হইতেছে, যাহারা কাটমানি খাইয়াছেন, অবিলম্বে তাহা ফেরত দিন। এবং দেখা যাইতেছে সেই কাটমানি ভোজনরসিকদের মধ্যে আপনার অতি প্রিয়পাত্র ডাঃ শান্তনু সেনও অভিযুক্ত হইয়াছেন। শোনা যাইতেছে, তাহার নামে বেনামে এখন নগদ এবং সম্পত্তিতে আর্থিকমালিকানার পরিমাণ সহস্র কোটি বা প্রায় সহস্র কোটি। এবং আপনার মুখনিঃসৃত কাটমানি তথ্য জনসমক্ষে প্রতিভাত হইতে না হইতেই এরাজ্যের তৃণমূলি রাজনীতির খোঁয়াড়ে শোরগোল পড়িয়া গিয়াছে। প্রায় প্রতিদিনই শহর কলকাতা হইতে শুরু করিয়া সুদূর গ্রামাঞ্চলের দারা সিংহ-সম তৃণমূলি নেতৃত্বকে হয় জনরোষের মুখোমুখি হইয়া চড়-থাপ্পড় খাইতে হইতেছে। নয়তো পৃষ্ঠদেশের চামড়া বাঁচাইতে দেশত্যাগী হইতে হইতেছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের এ বড়ো দুঃসময় এবং এই দুঃসময়ের রচয়িতা আপনি স্বয়ং। স্বহস্তে আপনি আপনার নিজস্ব ‘সততার প্রতিমূর্তি’ ইমেজটুকুকে ফিরাইয়া আনিবার তীব্র তাগিদে আপনার কর্মীবাহিনীর জন্য রাজ্য জুড়ে অজস্র কফিন তৈয়ারি করিয়া দিয়াছেন। ইহা কম কথা নহে।
আপনি দিব্যদৃষ্টির অধিকারি নহেন, তাহা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে প্রমাণ হইয়া গিয়াছে। আপনি রাজ্যব্যাপী জনসমাবেশগুলিতে যতগুলি রাজ্যে বিজেপি শূন্য অথবা রসগোল্লা পাইবে বলিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, তাহা ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। আপনি নিজ রাজ্যে ৪২টি আসনের ৪২টিতেই জিতিবেন বলিয়া নয়া নস্ত্রাদামুস সাজিয়া বাজিমাত করিতে চাহিয়াছিলেন। আপনি মাত্র ২২টি আসনে কোনোক্রমে জিতিয়াছেন। অর্থাৎ প্রমাণিত হইয়াছে, আপনি জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞ নহেন। রাজনীতির চাণক্যও নহেন।
তবে, আমরা জনগণ খুশি যে আপনার নিদ্রা বিলম্বে ভাঙিলেও আপনি ঘুমঘোর লাগা চক্ষু মেলিয়া দেখিতে পাইতেছেন, গোটা রাজ্যটি আপনার রাজনৈতিক ঘরানার ফলে রসাতলে গিয়াছে। এখন রাজ্যটিকে বাঁচাইতে হইলে প্রয়োজন ভেন্টিলেশন মেশিন। স্যালাইনে কাজ হইবে না। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মহোদয়া, আপনার স্মৃতির দরজায় একটু টোকা মারিতে চাই আজ। আপনি নিশ্চয় মানিয়া চলেন যে স্মৃতি সততই সুখের। প্রতিটি সজ্জন ব্যক্তিই তাহা বিশ্বাস করেন। কিন্তু আজ আমি স্মৃতির সিন্দুক খুলিয়া আপনাকে যাহা স্মরণ করাইব, তাহা বড়ো দুঃখের। রাজ্য রাজনীতির রানি হইয়া ক্ষমতার তখতে বসিবার অব্যবহিত পরেই যখন আপনার অতি নিকট পার্ষদবর্গ সারদা চিটফান্ড কাণ্ডে অভিযুক্ত হইয়া ফাসিয়া গেল, তখন আপনি সগর্বে বড়ো বড়ো চোখ পাকাইয়া বলিয়াছিলেন— “আমি চোর? মুকুল চোর ? মদন চোর? কুণাল চোর?”অভিযোগের জবাবে আপনার নির্দেশে তৃণমূলি কর্মীরা বিশাল মিছিল বাহির করিয়াছিল। প্রত্যেকের গলায় ঝুলিয়াছিল প্ল্যাকার্ড ‘আমরা চোর ? সেদিন আপনি অভিযোগকারীদের ব্যঙ্গ করিয়াছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস লক্ষ্য করুন— আজ আপনি নিজেই বলিতেছেন— আপনার দলের সবাই চোর। অথবা চোরের চাইতে একটু বেশি— ডাকাত। ছিনতাইবাজ। ঠগবাজ। ৪২০। কারণ। গোটা রাজ্য জুড়িয়া কাটমানির কুটির শিল্প গড়িয়া তুলিয়াছেন আপনার হাতে মানুষ আপনার ভাইসকল। ইহা আপনার অজানা নহে। তাই চুচুড়ায় এক প্রশাসনিক সভায় প্রকাশ্যে আপনি দলীয় কর্মী ও বিধায়কদের কাটমানির ৭৫ ভাগ দলকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেকথা আপনি নিশ্চয়ই ভোলেন নাই।
মাননীয়া, ধৃষ্টতা মাফ করিবেন। সত্যি কথা বলিতে কী— শুধু পাতানো ভাইয়েরাই নয়— এই কুটির শিল্পের সহযোগী হিসেবে অভিযোগ উঠিয়েছে আপনার আপন মায়ের পেটের ভাইসকল— ওই কার্তিক, গণেশ প্রমুখ এবং অবশ্যই আপনার সাধের লাউ, সরি, সাধের ভাইপো অভিষেক যাহাকে আপনি রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অভিষেক পর্ব প্রায় সমাপ্ত করিয়াই রাখিয়াছেন। আপনার দল ত্যাগ করিয়া এবার বিজেপির সাংসদ হইয়াছেন যে সৌমিত্র খাঁ, তিনি তো প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ হুঁড়িয়াছেন যে তিনি প্রমাণ করিবেন, আপনার ভাইপোর কাছে প্রতি মাসে রাজ্যের কয়লা খনি অঞ্চল থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা নজরানা প্রেরণ করা হয়। বালিখাদান আর সিন্ডিকেট রাজগুলির পক্ষ থেকেও কয়েক লক্ষ প্রতিমাসে। এবং তিনি ইহাও বলিয়াছেন—এসব অর্থ পাচার করিতেই অভিষেকবাবুর বিদেশিনী স্ত্রীকে ঘনঘন ব্যাঙ্কক যাইতে হয়—মাসে একুশ বার!
শুধু তাহাই নহে—- কালীঘাট অঞ্চলে প্রোমোটারির সেলামি বাবদ আপনার সহোদরবর্গ ও ভাইপোর আয় Leaps & Bounds সংস্থার মতোই লাফাইয়া লাফাইয়া বাড়িয়াছে, গোটা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে যে তারা দখলীস্বত্ব জারি করিয়াছে তাহাও আপনার অজানা নহে। কিন্তু আপনি সেগুলি দেখিতে পাইতেছেন না। আপনার চামচা সাংবাদিক বাহিনীর অন্যতম এক সদস্য ‘আনন্দ’-এর সহিত টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রশ্নটি আমতা আমতা করিয়া তুলিলেও, আপনি বলিয়াছেন— ওসব ব্যক্তিগত বিষয়ে আপনি নাক গলাইতে চাহেন না। যুক্তিটি রাজ্যের মানুষের বোধগম্য হয় নাই। কাটমানি খাইয়া যদিরাজ্যের কোনো এক গ্রামের গ্রামসভা সদস্য পুলিশি হেফাজতে যাইতে পারে, যদি তৃণমূলি কর্মীর ঘর বাড়ি জ্বলিতে পারে, যদি তৃণমূলি কাউন্সিলিদের পিঠের চামড়া গুটাইয়া দিবার জন্য সশস্ত্র জনগণ তাহার বাড়িতে হাজির হইয়া যান, তাহলে আপনার নিজস্ব ভাই-ভাইপোদের বিরুদ্ধে কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ কেন হইবে? এ প্রশ্নের জবাব তো আপনাকেই দিতে হইবে।
মোদ্দা কথা হইল, আপনি পুনরায় নাটক করিতেছেন। ভোটে প্রায় রাজ্যপাট যাইবার মুখে আপনি এখন পুনরায় ‘সততার প্রতিমূর্তি’র ছৌ মুখোশ পরিয়া সৎসাজিতে চাহিতেছেন যাহাতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মানুষ আপনার প্রতি ভক্তিতে গদগদ হইয়া পুনরায় ভোট দেয়। যাহাতে জনগণ পুনরায় আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় এবং আপনার শিয়রে শমন সম বিজেপির রাজনৈতিক নিঃশ্বাস দূরীভূত হইয়া যায়। তাহা যদি না হয় তাহলে পাতানো ভাইয়ের কাছে কাটমানি ফেরতের নির্দেশ জারি করিতে পারেন, নিজের সহোদর ও ভাইপোকে কেন বলিতে পারেন না? কেন একবারও ঘাড় পাতিয়া স্বীকার করেন না যে আগে যাহা বলিয়াছিলাম, “আমি চোর? মুকুল চোর? মদন চোর? কুণাল চোর?’, তাহা ভুল বলিয়াছিলাম। কেন একবারও স্বীকার করেন না, আপনার দলের রমরমা সাদা পথের উপার্জনে নয়। সাধারণ মানুষের ঘাম-রক্ত অশ্রু মেশানো চিটফান্ডের টাকায় ? ইহার পরেও কোন মুখে কহিতেছেন, দলের ৯৯.৯৯ শতাংশ নেতা-কর্মীই সৎ? ইহাই কি আপনার সততা?
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মহোদয়া, আপনার ফোলানো ফাপানো রাজনৈতিক বেলুন ফুটো হইয়া গিয়াছে। এখন আপনি যতই তাপ্পি মারিয়া তাহাকে ফোলাইতে চাহেন, পারিবেন না। একদিন দেখিবেন, আপনার প্রিয় ফিরহাদ হাকিম, শুভেন্দু অধিকারী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ সকলেই আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছে যেমন আজ রাজ্যের দিকে দিকে বিদ্রোহ চলিতেছে পুলিশের নেতৃত্বে। আপনার পাশে আজ অধ্যাপকরা নেই, সরকারি কর্মচারীরা নেই, বেকাররা নেই, শিক্ষকরা নেই, ছাত্ররা নেই, অভিভাবকরা নেই, আইনজীবীরা নেই, ব্যবসায়ীরা নেই, কৃষক নেই, সর্বোপরি গরিব খেটে খাওয়া মানুষ নেই। আর কদিন বাদে, আপনার দলীয় কর্মীরাও পাততাড়ি গুটাইবেন। কারণ সকলেই কাটমানি খাইয়াছেন পেট ভরিয়া এবং টানা ৮ বছর ধরিয়া, ইহারা দেখিবেন— সকলেই প্রস্তুত হইতেছেন ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলিয়া আপনার ‘কাটমানি’র তথ্য ফাস করিয়া দিতে দিন। সমাগত। তৈরি হউন। শেষের সেদিন ভয়ংকর। মুষলপর্ব শুরু হইয়া গিয়াছে। রাজবংশের পতন অবশ্যম্ভাবী।
সুজিত রায়
2019-07-06