গড় শব্দের অর্থ দূর্গ, পঞ্চ মানে পাঁচ,কোট শব্দের অর্থ গোষ্ঠী।অর্থাৎ মানে দাঁড়ালো পাঁচটি গোষ্ঠীর দুর্গ।আবার অন্য অর্থে কূট থেকে কোট অর্থাৎ চূড়া। পাহাড়ের পাঁচটি চূড়া রয়েছে, তাই নাম পঞ্চকোট।গড় পঞ্চকোট হলো শিখর বংশের রাজাদের তৃতীয় রাজধানী। ঝালদা, পাড়া তারপর গড় পঞ্চকোট।এখানে তারা ৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ প্রায় ৮০০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। আমরা এখানে চারটি তোরণের বর্ণনা পাই। খড়িবাড়ী দুয়ার, আখ দুয়ার,দেশ বাঁধ দুয়ার ও দুয়ার বাঁধ।তারমধ্যে দুয়ার বাঁধ তোরণ ছাড়া বাকিগুলি কালের স্রোতে সমাধি লাভ করেছে।এখানে ৫ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে রাজমহল ছিল এবং ১২বর্গমাইল এলাকা কড়া সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে ছিল। যার মধ্যে পাঁচটি পরীখা, ১১০ টি ছোট বড় জলাশয় ও ঘন কাঁটা বাঁশের ঝোঁপ ছিল।পরিখা গুলিতে সুরক্ষার জন্য কুমীর ছিল। গড় পঞ্চকোট মহল সম্বন্ধে আমরা কম বেশী অনেকেই জানি।মহলের অনতিদূরে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গড়পঞ্চকোট গ্রাম। আজ আমরা এই গড় পঞ্চকোট গ্রাম সম্বন্ধে আলোচনা করব।
পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে সুদৃশ্য গ্রামটি।নিতুরিয়া থানার জনার্দনডি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গড় পঞ্চকোট গ্রাম।যার জেএল নম্বর ৬৪। এই গ্রামের জনসংখ্যা আনুমানিক ২০০০ জন এবং তার টোলা ছোলাবেড়িয়ার জনসংখ্যা প্রায় ৫০০ জন।মোট প্রায় আড়াইশো পরিবার বসবাস করেন। কৈবর্ত, বেনে, কুইরি,ব্রাহ্মণ, লোহার,হাঁড়ি, বাউরি ও আদিবাসী সাঁওতাল জাতির বসবাস। প্রাচীন বাসিন্দা আদিবাসী ও কৈবর্তরা।গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি ও মাছ চাষ করেন।গ্রামে একটি প্রাচীন প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর স্থাপনা ১৯৩৪ সাল। ছোলাবেড়িয়ায় সম্প্রতি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।বর্তমানেও গড় পঞ্চকোট গ্রামে অনেক জলাশয় দেখলাম।হরিশচন্দ্র সায়ের, দেশবাঁধ, রাজারবাঁধ,ও দুয়ার বাঁধ জলাশয় গুলি বিশাল। তারমধ্যে হরিশ্চন্দ্র সায়রের আয়তন ও গভীরতায় সুবিশাল। এটি শিখর বংশের ৬৭ তম মহারাজ হরিশ্চন্দ্র শেখর সিংদেও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে খনন করান।যার সুমহান কীর্তির সুফল আজও গ্রামবাসীরা লাভ করে চলেছেন। এখনো প্রচুর কাঁটা বাঁশের ঝোঁপ রয়েছে। হরিশচন্দ্র বাঁধের নিকটে আখড়া গাছের তলায় রয়েছে লৌকিক ঠাকুর ময়শামুড়ার থান।সেখানে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন শিলা মুর্তি।অযত্নের ফলে সেইসব মূর্তিগুলি নষ্ট হচ্ছে। একটি মূর্তি চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি মনে হল। ময়শামুড়া থানের নিকটে রয়েছে প্রাচীন দুটি শিবলিঙ্গ, যেটিকে ভূতনাথ থান বলে। এই দুটি স্থানের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কাছারি বাড়ি।প্রবীণ চিত্তরঞ্জন কৈবর্ত বলেন এখানে কাছারি বসতো। ব্রিটিশ আমলের তিনটি পাশাপাশি প্রাচীন ভগ্নপ্রায় বাড়ি রয়েছে। যেগুলো বর্তমানে গাছগাছালিতে বাসা বেঁধেছে। দুয়ার বাঁধ তোরণের নিকট রয়েছে দুয়ার বাসনি দেবী ও বসন্তকুমারী দেবী। এখানে আষাঢ় সংক্রান্তি ও আখান দিনে পুজো হয়। তাছাড়া গ্রামের মধ্যখানে রয়েছে সুন্দর ধর্মথান। জাঁকজমক ভাবে এখানে ধর্ম পূজা হয়, এই মন্দিরে বৈশাখ মাসে রক্ষা কালী পূজাও হয়। একটি অদ্ভুত দর্শন হনুমান মূর্তি রাজমহল থেকে এখানে এনে রাখা হয়েছে।তাছাড়া সরস্বতী পূজা, কীর্তন এবং কৈবর্তদের দুটি মনসা পূজা হয় গ্রামে। ২০১৮সাল থেকে দূর্গা পূজাও শুরু হয়েছে।ছোলাবেড়িয়ায় বাঁদনা, করম, জাওয়া ইত্যাদি আদিবাসী লোক উৎসব গুলি পালিত হয়।
গ্রামের অনেকেই জানালেন প্রায় প্রত্যেকের বাড়ীতেই রাজমহলের চিহ্ন স্বরূপ কিছু না কিছু বস্তু পাওয়া যাবে। তারা বলেন আরো পূর্বে মহল সংরক্ষণ করা হলে পঞ্চকোটে বেশি পর্যটক আকৃষ্ট হতেন।বর্গী আক্রমন সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া গেল।কেউ কেউ বর্গী হানার মুখরোচক গল্প শোনালেন।কিন্তু সত্য ঘটনা এটাই যে পারিবারিক বিপর্যয়ে পঞ্চকোট রাজধানীর পতন হয়েছিল। কারণ বর্গীরা পঞ্চকোট রাজ্যের উপর দিয়ে গিয়েছে ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে আর পঞ্চকোটে পারিবারিক অন্তর্ঘাত ঘটেছিল ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ প্রায় ৮ বছর পর এই পারিবারিক বিপর্যয় বর্গী হানা বলে ভুল প্রচার হয়ে আসছে। বেগলার সাহেব, ডঃ সুভাষ রায়, দিলীপ গোস্বামী, স্বপন কুমার রায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যাক্তিগণ তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে পারিবারিক অন্তর্ঘাতের জন্যই যে পঞ্চকোটের পতন হয়েছিল সেকথা বলেন। স্বপন বাবু বলেন “ভুল প্রচার বন্ধ করে আমাদের সঠিক তথ্য পর্যটকদের নিকট তুলে ধরতে হবে। ” তবে সে যুগের বাণিজ্য কেন্দ্র ও ঐতিহাসিক গ্রাম হওয়া সত্বেও রাজধানী পাড়া, ঝালদার মতো গড় পঞ্চকোট গ্রামের সে রকম উন্নয়ন কেন ঘটেনি সে প্রশ্ন বার বার মনে আসছে। কামনা করি,ভাল থাক ঐতিহাসিক’ গ্রাম গড় পঞ্চকোট এবং আমাদের গর্বের পর্যটনকেন্দ্র গড় পঞ্চকোট মহল।
তথ্যসূত্র-
শ্রী স্বপন কুমার রায়
শ্রী মোহন সিং
শ্রী ধীরেন চন্দ্র মুদি
শ্রী সুভাষ কৈবর্ত
শ্রী চিত্তরঞ্জন কৈবর্ত
শ্রী লক্ষ্মণ কৈবর্ত।
কলমে:-সত্যবান তন্তুবায়।