দেউলঘাটা : পুরুলিয়ার এক হারানো ইতিহাস

রূপসী পুরুলিয়ার আনাচে-কানাচে রয়েছে অজস্র রহস্যের হাতছানি! পুরুলিয়া জেলার আড়শা ব্লকের অন্তর্গত দেউলঘাটা (Deulghata) হল এক ভগ্নপ্রায় মন্দিরস্থলের কাহিনী, যার চৌকাঠ জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রহস্যময় ইতিহাস। ভারতের সবথেকে পুরোনো যে কয়টি পোড়ামাটির মন্দির এখনও কালের গর্ভে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি, দেউলঘাটা তাদের মধ্যে অন্যতম। পোড়া মাটির মন্দিরের গায়ে শ্যাওলার বসত। আর তাতেই লুকিয়ে রয়েছে ২০০০ বছরেরও অধিক পুরানো ইতিহাস। পুরুলিয়া শহর থেকে সড়কপথে মাত্র ৩৩ কিমি দূরে কাঁসাই/কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত দেউলঘাটা সাম্প্রতিককালে পর্যটন কেন্দ্র রূপেও পরিচিতি লাভ করেছে।

কাঁসাই নদী তীরবর্তী মানভূম-পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ছোটনাগপুর কমিশনার কর্নেল ডালটন। এনিয়ে ১৮৬৪-৬৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তিনি ‘নোটস অন অ্যা ট্যুর ইন মানভূম’ প্রবন্ধ রচনা করেন। ডালটনের এই প্রবন্ধেই সর্বপ্রথম দেউলঘাটা মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ডালটনের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, পুরুলিয়ার জয়পুর গ্রামের চার মাইল দক্ষিণে কাঁসাই নদীর ডান দিকের পাড়ে বড়াম গ্রামের সন্নিকটে অনেক পাথর ও ইঁটের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে তিনটি সুবিশাল ইঁটের তৈরি মন্দিরের কথা। তিনটি ঢিপির উপর মন্দিরগুলি দাঁড়িয়ে ছিল এবং এছাড়াও আরও অনেক ঢিপির উপর একই ধরনের ভগ্নাবশেষ ছিল। তিনি তিনটি মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মন্দিরটির উচ্চতা ৬০ ফুট ধার্য করেন, যেটি ২০০২ সালে ধ্বসে পড়ে। এরপর ১৮৭২-৭৩ সালে তৎকালীন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণে পদাসীন জে. ডি. বেগলারের ‘রিপোর্ট অন অ্যা ট্যুর থ্রু দ্য বেঙ্গল প্রভিন্সেস ইন ১৮৭২-৭৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বড়াম গ্রামের নিকট দেউলঘাটার তিনটি ইঁটের মন্দিরের সবিস্তার উল্লেখ পাওয়া যায়।

বর্তমানে দেউলঘাটায় মাত্র দুটি সুপ্রাচীন মন্দির জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাকি সবই ভগ্নস্তূপ। এখানে রয়েছে পাথরে খোদিত দশভুজা মূর্তি। সেই প্রতিমায় দুর্গা ছাড়াও রয়েছেন মহিষাসুর, সিংহ ও মহিষ। তবে প্রচলিত দুর্গা প্রতিমায় যেমন দেবীর ডান পা সিংহের উপর ও বাঁ পা মহিষের উপর দেখা যায়, এই মূর্তির ক্ষেত্রে তা ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ এখানে দেবীর বাঁ পা সিংহে ও ডান পা মহিষের উপর রয়েছে। সঙ্গে অবশ্য চার পুত্র-কন্যা গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী নেই। শুধু দশভুজা মূর্তি নয়, আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। যেমন — পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে থাকা চার ফুট উচ্চতার চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি ; সিংহের পিঠে দন্ডায়মান চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি ; আট হাতের রণচন্ডী দেবীমূর্তি ; তিন ফুট উচ্চতার গণেশ মূর্তি ; ভগ্ন ধ্যানমগ্ন মূর্তি ; শিবলিঙ্গ ইত্যাদি।

দেউলঘাটা নামটি এসেছে দুটি শব্দ ‘দেউল’ অর্থাৎ মন্দির এবং ‘ঘাট’ অর্থাৎ কাঁসাই নদীঘাট থেকে। জনশ্রুতি, প্রাচীন সময়ে তাম্রলিপ্ত (বর্তমান তমলুক) -এর বণিকরা ঝাড়খণ্ডে যেতেন বাণিজ্য করতে। তখন কংসাবতী নদীর ঘাটে নৌকা রেখে তাঁরা এই মন্দিরে পুজো দিতেন। আজও পুরুলিয়ার আড়শার দেউলঘাটায় দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তির পুজো হয়, যা আনুমানিক দু’হাজার বছরের পুরানো। পুরুলিয়া জেলার লোকসংস্কৃতির গবেষক দিলীপ গোস্বামী বলেন, ‘দেউলঘাটার দুর্গামূর্তি প্রমাণ করে, বাংলায় দুর্গাপুজো অত্যন্ত প্রাচীন। জৌলুসে নয়, দেউলঘাটার মহিমা তার ইতিহাসের গৌরবে।’

কিন্তু প্রশ্ন হল, দেউলঘাটার মন্দির কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল? এনিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে, দশভুজা মূর্তিটি বৌদ্ধ যুগের। মূর্তির গঠন-কারুকাজ দেখেই তা স্পষ্ট। মাথার উপর চক্রস্তম্ভ এবং তলায় পরীদের মূর্তি রয়েছে। মায়ের দু’পাশে অষ্টমাতৃকা রূপ। দেউলের দরজাগুলিও ত্রিভুজাকৃতি। এই সবই বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছাপ। আবার ভিন্নমতে, এসবই জৈন সংস্কৃতির। লোকসংস্কৃতির গবেষক সুভাষ রায় বলেন, ‘পুরুলিয়া জুড়ে জৈন সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে। এটা জৈন প্রত্নস্থল ছিল। পরে ব্রাহ্মণদের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।’ অনুমান, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এখানে। তখন থেকেই সম্ভবত এই দূর্গামূর্তির পুজো শুরু হয়েছিল। দেউলঘাটার মন্দির এবং মূর্তি কত পুরানো তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে বাংলায় সুপ্রাচীন কাল থেকে দুর্গার উপাসনা হত। এখনও এই মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। প্রতিদিন ভক্তদেরও সমাগম ঘটে। আর প্রতিবছর দুর্গাপুজোর চারদিন এখানে উৎসবের মেজাজ থাকে। স্থানীয় রাজপুত সম্প্রদায় এই পুজোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

একদা বেশ কয়েকটি মন্দির নিয়ে যে মন্দির প্রাঙ্গণ গড়ে উঠেছিল, সংরক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে টিকে রয়েছে কেবলমাত্র দুটি দেউল, যেগুলির অবস্থাও ভালো নয়। ২০০০ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া মন্দির সংস্কার শুরু করলেও, তিন বছর পর আচমকাই কাজ বন্ধ করে দেয়। সরকারি উদাসীনতায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চারিদিকে আগাছায় ভর্তি, মন্দিরের গায়েও গজিয়ে উঠেছে গাছ। অনেক নিদর্শনই আজ ঢাকা পড়েছে শ্যাওলা আর বুনো ঝোপঝাড়ে। তবুও রহস্যময় ইতিহাসের খোঁজে পর্যটকরা আসেন দেউলঘাটায়। যথাযথ সংরক্ষণ করলে, সুপ্রাচীন ইতিহাসের গন্ধমাখা দেউলঘাটায় হয়তো পর্যটনের আরও শ্রীবৃদ্ধি হত।

পথনির্দেশঃ- পুরুলিয়া > জয়পুর > দেউলঘাটা

লেখিকাঃ- চৈতালী মাহাত (বিশপুরিয়া, হুড়া, পুরুলিয়া)
ছবি:-উমাশ্রী বক্সী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.