রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মাননীয় মোহন ভাগবত সম্প্রতি একটি পুস্তক উন্মোচন কার্যক্রমে গিয়ে মুসলিম সমাজ এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে কিছু বিষয় রাখেন। এই ভাষনের পর দেশের একটা অংশের মানুষের মধ্যে আলোড়ন পড়ে যায়, মিডিয়াতেও আলোচনার ঝড় উঠতে শুরু করে। আমি আমার বৌদ্ধিক স্তর থেকে যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি তা উপস্থাপন করবার চেষ্টা করছি।
কারো মতে সঙ্ঘ বিপথগামী, কারো মতে সঙ্ঘও তোষণমুখী, কারো মতে সঙ্ঘের দর্শনে পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই সঙ্কিত তাহলে সঙ্ঘও বাকিদের পথ ধরল। সঙ্ঘের শাখা বা মিলনে যারা নিয়মিত যাতায়াত করে, বৌদ্ধিক শোনে এবং অধ্যয়ণ করে তাদের কাছে কিন্তু এই কথা নতুন বা অপ্রত্যাশিত নয়। আসলে সঙ্ঘ সম্পর্কে যেমন মুসলিমদের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, তেমনি হিন্দুদের মধ্যেও ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।
সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ সঙ্ঘ নিয়ে যে সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে তার কয়েকটা নমুনা দেই। মুসলিমদের হত্যা করার জন্যই RSS এর জন্ম, হিন্দুদের মনে মুসলিম সম্পর্কে বিদ্বেষ তৈরি করাই RSS এর কাজ, মুসলিমদের দেশ থেকে বিতারণ করতে চায় RSS, হিন্দু সমাজকে অন্য কোন ধর্মাবলম্বী মানুষ আক্রমণ করলে RSS বাঁচাবে, RSS এর নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে যারা কিনা সময়ে সময়ে কাজে নামে।
সঙ্ঘ রাষ্ট্রহিতে সংস্কারিত মানব নির্মাণের কাজ করে। এই স্বয়ংসেবকেরা “রাষ্ট্র সর্বপরি” – এই ভাবনাকে পাথেয় করে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাতে করে ভারতবর্ষকে পুনরায় জগৎ সভার শ্রেষ্ঠ আসনে বসান যায়। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কতগুলি উপলক্ষ্যকে সামনে রাখা হয়। আপাতদৃষ্টিতে যা অতি নগন্য বা স্থুল মনে হলেও সঙ্ঘ মনে করে এই সাধারণ কাজের মাধ্যমেই অসাধারন কাজ করা সম্ভব। দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্ত সংস্কার স্বয়ংসেবকদের দেওয়া হয় তার কয়েকটা নমুনা দেই — দিনের শুরুতে ভারতবর্ষের মহান ব্যক্তিত্বদের একবার স্মরণ করা, মাতৃভূমির জয়ধ্বনি করা, যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে দিনের সূচনা করা, ভোজনের আগে ভোজনমন্ত্র পড়া যে মন্ত্রের অর্থ রান্না করার উপাদান, রাঁধুনি এবং রান্না করা খাদ্যসামগ্রী সকলেই ব্রহ্ম, তাই খাবারের একটি কণাও নষ্ট না করে ব্রহ্ম জ্ঞানেই খাবার গ্রহণ করা উচিত, খাবারের পর নিজের থালা নিজের ধোঁয়া উচিত, নিদেনপক্ষে থালায় জল দেওয়া উচিত যাতে করে যিনি থালা ধোবেন তার কোন খারাপ অনুভূতি না হয়। বাড়ির অব্যবহৃত প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ প্লাস্টিকের বোতলের মধ্যে ভরে ইকোব্রিক বানানোর সংস্কার দেওয়া হয়। এমন আরও অজস্র সংস্কার সেখান হয় যা সঙ্ঘের বাইরের মানুষের কল্পনাও করতে পারে না।
আসলে সঙ্ঘকে একশ্রেণীর সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দল মুসলিম বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। সঙ্ঘ সেই সমস্ত লোকের বিরোধী যারা রাষ্ট্রবিরোধী, তা সে হিন্দু হোক বা মুসলিম। আমাদের দেশের মুসলিমরা যে সকলেই ধর্মান্তরিত তা সর্বজনবিদিত। এদের সকলের পূর্বপুরুষ হিন্দু। হিন্দু বা সনাতনী সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য হল সকলের মতামতকে মান্যতা দেওয়া, সকলের উপাসনা পদ্ধতিকে শ্রদ্ধা করা, সকলের কল্যান চাওয়া। সনাতনী আদর্শের আচার পদ্ধতির মধ্যে এই কারনেই এত স্বাধীনতা এবং বিভিন্নতা দেওয়া আছে। এই জন্যেই কেউ শৈব, কেউ শাক্ত, কেউ অদ্বৈতবাদী, তো কেউ নিরাকার ব্রক্ষ্মের উপাসক, আবার কেউ হয়তো নাস্তিক। যতমত ততপথের হাত ধরেই কেউ রামকৃষ্ণ এর ভক্ত, কেউ ইস্কনের, কেউ অনুকূল ঠাকুরের, কেউ শীতলা মায়ের। অর্থাৎ তুমি কার মধ্যে ইশ্বর খুঁজে পাবে, কার মধ্যে শান্তি খুঁজে পাবে তা একান্তই তোমার ব্যপার। এমনকি জীবজন্তু বা জল, মাটি, আগুনের মতন প্রকৃতিকেও ইশ্বর মানে অনেকেই। তার মানে এই নয় যে আমার মত, পথ বা উপাস্যকে না মানলেই তুমি শত্রু, তুমি পাপীষ্ঠ, তুমি নরাধম বা তোমার ক্ষতি হবে।
মূল কথাটি হল বাকিদের ক্ষেত্রে ধর্ম বলতে যা বোঝায় তা হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। হিন্দু একটি জীবন যাত্রা পদ্ধতি। এতে কোন কোড অফ কন্ডাক্ট নেই যেমনটা বাকি ধর্মে দেখা যায়। আপনি খ্রিষ্টান বা মুসলিম হলে আপনাকে নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতেই হবে যেগুলি না করলে আপনি ঐ ধর্মাবলম্বী মানুষ কোন ভাবেই হতে পারবেন না। কোন হিন্দু শাস্ত্রে এমনটা বলা নেই যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের শত্রু হিসেবে দেখতে হবে, তাদের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিয়ে করতে হবে, তাদের ধর্ম পরিবর্তন করে নিজ ধর্মে আনতে হবে। মোহন ভাগবত খুব সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যারা ভারতবর্ষকে মাতৃভূমি মনে করে তাদের আমরা হিন্দু বলে মনে করি। এই মাতৃভূমি মনে করাটা শুধু মুখে করলে হবে না। কাজে এবং আচরণে তা হওয়া চাই। এবার কেউ যদি মনে করে আমরা অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তার করে দেশ দখল করব বা দেশের ওপরে অকারণ চাপ সৃষ্টি করব, তাহলে তা কোন ভাবেই দেশহীতে কাজ হবে না। তেমনি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যেভাবে হিন্দুদের ওপর জেহাদি আক্রমণ চালানো হয়েছে তা কোন ভাবেই রাষ্ট্রহীতের পরিচায়ক নয়।
তাই মোহন ভাগবতের কথা নতুন কিছু নয়। সকলের কল্যান চাওয়া হিন্দুদের মতাদর্শের প্রতীক। জনসংখ্যার একটা নির্দিষ্ট অংশকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রহীত সম্ভব না। সকলের সমষ্টিগত প্রয়াসেই রাষ্ট্রের কল্যান সম্ভব। তবে এই বার্তাকে কেউ দুর্বলতা ভাবলে, তথাকথিত সম্প্রতির বার্তা ভাবলে ভুল করবে। রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চ রাষ্ট্রবাদী মুসলিমদের একত্রিত করার কাজ করে। অনেকেই তা জানেন না এবং অনেকেই ভাগবত এর পুরো ভাষণ না শুনেই লম্ফঝম্পও করে সমালোচনা করতে শুরু করেছেন। তাতে অবশ্য ক্ষতি নেই, কারণ দেশটার নাম ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্তান। দেশটার নাম ইরান বা চিন হলে হয়তো আপনাকে পাথর ছুড়ে মারা হতো, না হলে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাড় করিয়ে দেওয়া হতো।
জয় হিন্দ
বন্দেমাতরম
ভারত মাতা কি জয়
সুমন কর্মকার