“মই-চড়া” (১/৭/১৯)

একদিন বন্ধুবর গৌতম ব্যানার্জি বললেন “চলুন ক্যানিং এর কাছে একটা গ্রামে ছবি তুলে আসি।” তা এত জায়গা থাকতে ক্যানিংই কেন?

সেখানে নাকি গরু দৌড়বে আর তার ছবি তুলতে অনেক ফটোগ্রাফার আসবেন। আমি বললাম “ওহ সেই তামিলনাড়ুর জাল্লিকাট্টুর মতন জিনিস, তা সেখানে তো গরুগুলোর ওপর অনেক অত্যাচার করা হয়, ওসব জিনিসে আমার সাপোর্ট নেই।” গৌতম বললেন “না ব্যাপারটা একদম একরকম নয়, গেলেই বোঝা যাবে।” তা চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে গিয়ে দেখাই সাব্যস্ত হলো। ড্রেসকোড হল বারমুডা, প্লাস্টিকের পোক্ত চপ্পল আর ক্যামেরার রেইন কভার।

সকাল সকাল দুগ্গা দুগ্গা করে গৌতমের গাড়ি করে রওনা দিলাম। পথে আরো দুই ফটোগ্রাফার বন্ধুকে তুলে নেওয়া হল। আমি সাথে নিয়েছি নিকন D500 আর AF-P 70-300 লেন্স। 200-500 বা 70-200র মতন ভারী লেন্স নিতে সাহসে কুলল না। শুনেছি যখন তখন কাদায় পা পিছলে সাষ্টাঙ্গ দিতে হতে পারে! এতটা রাস্তা যে কখন গল্পে গল্পে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। পৌঁছলাম সাড়ে এগারোটায়, পথে একবার টি-ব্রেক নিয়েছিলাম। রাস্তা কিন্তু বেশ ভালো ছিল।

মেইন রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে গ্রামের মাঝ দিয়ে প্রায় দুশ মিটার মতন হাঁটা পথ। উৎসবের আমেজ, মাইক বাজছে, বেশ সুন্দর করে সামিয়ানা খাটানো চওড়া রাস্তার ওপর, চারদিকে একটা মেলা মেলা ভাব আর… সেটা বেশ সংক্রামক। রাস্তার ডানদিকে একটা বড় ধানক্ষেত আর সেখানে বেশ কিছু গরু-বলদ নিয়ে তাদের পালন কর্তারা। সামিয়ানার নীচে কয়েকশ লোক আর তাঁদের বেশিরভাগই ফটোগ্রাফার। বুঝলাম আমরা বেশ দেরি করেই এসেছি কারন, ভালো ভালো জায়গা অনেক আগে দখল হয়ে গিয়েছে। আমরা বসলাম কাঁচা আলের ওপর পা বিছিয়ে, কাঠফাটা রোদ্দুরে। আমাদের নবীন বন্ধুটি চটি খুলে রেখে সোজা নাক বরাবর নেমে গেল ক্ষেতের মাঝে!

এই দৌড় ব্যাপারটা কম্পিটিটিভ এবং এই খেলার নাম হল “মইচড়া”। সাউথের জাল্লিকাট্টুর সাথে প্রভূত মিল। দুটোই হার্ভেস্টিং সিজনের প্রথমে হয় আর দুটোই ধানচাষ প্রধান এলাকার লোকাচার। তবে একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো যে এখানে গরুদের ওপর কোনো অত্যাচার-টত্যাচার চালানো হয় না আর তাদের বেশি জোর করাও হয়না – অন্তত আমার সেরকম কিছু চোখে পড়েনি। বেশ কয়েকটি ‘ব্যক্তিত্বসম্পন্ন’ গরু ‘জাস্ট দৌড়বোনা’ এরকম একটা মুখ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল এবং তাদের কনফিউজড মালিকেরা ততোধিক কনফিউজড মুখ নিয়ে মিনিট দশেক চেষ্টা করে, আস্তে আস্তে ক্ষেতত্যাগ করলেন, গরুরা তাদের পেছনে সুবোধ বালকের মতন হেটে হেটে বাড়ি ফিরে গেল।

দৌড়োনোর পর কয়েকটি গরুর পিঠের উপর দেখলাম ভেজা তোয়ালে দেয়া হল, জোর করে জল খাওয়ানো হল। গরুর পা ধুইয়ে কাদা পরিষ্কার করিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতেও দেখলাম। এই সব গ্রামে গরুদের পরিবারের সদস্য হিসেবেই গণ্য করা হয়, আর গরুদের হাবভাবও সেরকমই।

অনেক ছবি তুললাম, বেশ লাগছিল। মাঝে দৌড়ন গরুর সামনে এক অতি উৎসাহী ফটোগ্রাফার চলে এলে গরু তাকে একটি ছোট ঢুঁশো মেরে কাদায় ফেলে দেয়। এ ছাড়া সেরকম বিপত্তি কিছু ঘটেনি। তবে মাঝে মাঝেই গরুরা কন্ট্রোল হারিয়ে ফটোগ্রাফারদের লাইনে চলে আসছিল আর তার ফলে প্রাণ ও ক্যামেরা একসাথে বাঁচানোর জন্য এক অদ্ভুত দৌড় প্রত্যক্ষ হল।

বেলা আড়াইটায় মনে হল ভালোই ছবি তোলা হল, দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হল, এবার ফেরা যাক। আমাদের সঙ্গীদের আরো কিছুক্ষন থাকার ইচ্ছে থাকলেও আমরা একসাথেই ফেরত আসার জন্য গাড়িতে উঠে পড়লাম। ফেরার পথে কি হল, তা নিয়ে আরেকদিন লেখা যেতে পারে। ফেরাটাও বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল।

শান্তনু সোম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.