ঠাকুমা আদর করে নাম রেখেছিলেন ভজন। আর নামকরণের দিন অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন, তিনিই নাম রাখেন বিধানচন্দ্র।
১৯৬১ সালের আগস্ট মাসের ৬ তারিখ। ভারতবর্ষের এক অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জে এফ কেনেডি এক সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারে বসেছেন। হঠাৎ সেই ব্যক্তি কেনেডির দিকে ভুরু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন, “আমার মনে হয় আপনি আপনার পিঠে অনেকদিন ধরেই একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করছেন।” ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয়ে গেলেও নির্ভুল ডায়াগনসিসের জন্য অচিরেই কেনেডি সেই ব্যক্তির কাছে তাঁর সমস্ত মেডিক্যাল রিপোর্ট তুলে ধরলেন। সেই রিপোর্ট দেখে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি লিখে দিলেন নতুন প্রেসক্রিপশন এবং অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন— এক মাসের মধ্যে যদি কেনেডির এই ব্যথা দূর না হয়, তাহলে তিনি আবার আসবেন তাঁকে দেখতে, সম্পূর্ণ নিজের খরচায়। একপ্রকার বাক্-রুদ্ধ কেনেডি জানতে চেয়েছিলেন, একজন রাজনীতিবিদ হয়ে তিনি একাজ কী করে করতে পারেন? উত্তর এসেছিল, Sir I am doctor by profession and a politician my passion. মিটিং শেষে যখন দু’জনেই করমর্দন করে টেবিল ছেড়ে উঠে আসছেন ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রী নির্দ্বিধায় চেয়ে বসলেন তাঁর ফিজ। ঠিকই তো, বড় ভুল হয়ে গেছে, ঈষৎ লজ্জিত কেনেডি জিজ্ঞাসা করেছিলেন— ফিজ হিসেবে তাঁকে কী দিতে হবে? তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর রাজ্যের উন্নতির জন্য চেয়ে নিয়েছিলেন ৩০০ কোটি টাকা, যা পলকের মধ্যে গ্রান্ট করে দিয়েছিলেন কেনেডি। জানতে ইচ্ছে করছে কে সেই মুখ্যমন্ত্রী! তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন আধুনিক বাংলার রূপকার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তিনি সেই গুটিকয় বিরল ব্যক্তিত্ব যাঁদের একই তারিখে জন্ম ও মৃত্যু ঘটেছে। আর আজ ১ জুলাই। আজ একইসঙ্গে বিধান রায়ে জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী।
তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে বিষয় খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন। কারণ যে বিষয়ে বলতে যাই না কেন, সেই ক্ষেত্রটিই অসীম। ডাক্তারির কথা যখন উঠলই, তখন আর একটা গল্প বলি। সময়টা তিরিশের দশক। আইন অমান্যের ঢেউ আছড়ে পড়ছে ভারতের প্রত্যন্ত প্রান্তরেও। আগেই বলেছি, নেশায় রাজনীতি করতেন বিধান রায়। আর তখন রাজনীতি মানে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। ব্রিটিশের ব্যাপক ধরপাকড়ে বিধান রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। তাঁকে নিয়ে আসা হল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। তাঁর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু বেঁকে বসলেন তিনি। তাঁর দাবি, তাঁকে অন্যান্য সাধারণ অপরাধীদের সঙ্গে রাখতে হবে। সাধারণত জেল কর্তৃপক্ষ এহেন দাবি-দাওয়াতে কর্ণপাত করেন না, কিন্তু এহেন বিশেষ ব্যক্তিত্বকে জেল কর্তৃপক্ষ অগ্রাহ্য করতে পারেননি। অতএব তাঁর থাকার ব্যবস্থা হল জেনারেল সেকশনেই, অর্থাৎ সশ্রম কারাদণ্ড। সময়টা ভালো না, চারিদিকে নিউমোনিয়া এবং টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব। জেলেও প্রায়ই কয়েদিরা মারা যাচ্ছে একপ্রকার বিনা চিকিৎসায়।
বিধানবাবু আসার ক’দিনের মধ্যেই জেল কর্তৃপক্ষ লক্ষ করলেন মৃত্যুর হার সেখানে বিশেষভাবে কমতে শুরু করেছে। এতদিন বিশেষ লক্ষ করা হয়নি। হঠাৎ একদিন জেলার সাহেব দেখলেন, গলায় স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সুপুরুষ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইনি কে! ইনি তো জেলের ডাক্তার নন! ভালো করে লক্ষ্য করে বোঝা গেল, তিনি আর কেউ নন তিনি হলেন বিধান রায়। স্বেচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে তিনি জাতি-ধর্ম অপরাধ নির্বিশেষে সেবা করে চলেছেন জেলের কয়েদিদের। শুধু তাই নয়, নিজের পয়সা খরচা করে বাইরে থেকে তাঁর ভাইকে দিয়ে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও নিয়ে আসছেন তিনি। জেলে যেন এক শোরগোল পড়ে গেল। স্বয়ং ধন্বন্তরি যেন জেলে আবির্ভূত হয়েছেন। কেবলমাত্র মুখের দিকে তাকিয়ে এবং পালস দেখে তিনি ডায়াগনসিস করতেন। কথায় বলে অর্ধেক অসুখ সঠিক ডায়াগনোসিসেই ঠিক হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর সঙ্গে ওষুধের নিয়মিত জোগান তো ছিলই। এহেন জ্ঞানী মানুষটির সকল বিষয়ই শেখার আগ্রহ ছিল চরম। জেলে থাকাকালীন তিনি কারুবিদ কানাই গাঙ্গুলীর সঙ্গে পরিচিত হন। যিনি ছিলেন জার্মান ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ। ছ’মাসের কারাবন্দির জীবন শেষে বিধান রায় যখন আলিপুর জেল ছেড়ে যাচ্ছেন, তিনি জার্মান ভাষা প্রাথমিকভাবে রপ্ত করে ফেলেছেন। কারণ একদিনে তাঁর হাজার কাজের মধ্যেও তিনি একদিনের জন্যও কানাইবাবুর কাছে জার্মান ভাষার পাঠ নেওয়া থেকে বিরত থাকেননি। এমনি ছিল তাঁর অধ্যবসায়।
একবার জওহরলাল নেহরু কঠিন পরিস্থিতিতে বিধান রায়কে বলেছিলেন, কেন্দ্রের তরফ থেকে যতটা পরিমাণ চাল বাংলার প্রাপ্য তিনি ততটা দিতে পারবেন না। একদিন বিধান রায় যেন গম দিয়েই কাজ চালিয়ে নেন। নেহরুর কাছে ভাত এবং রুটির পার্থক্য না থাকলেও বিধান রায় জানতেন বাঙালির কাছে ভাতের মর্ম কী। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করলেন এবং আদমশুমারির মতো করে প্রতি বাড়ি গিয়ে তাদের খাদ্যদ্রব্যে ভাত আগে না গম, সেটার একটা লিস্ট করে ফেললেন। তিন মাসের মধ্যে তিনি নেহরুকে একটি চিঠি লিখে জানালেন যে, আমার রাজ্যে রুটি খাওয়া মানুষদের চালের জোগান দিতে আমি পারব না। তাই তাঁদের রুটির ব্যবস্থাটা নেহরুকেই করতে হবে। নেহরু চিঠি সারমর্ম বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আর দেরি না করে বাংলাকে পুনরায় তাঁর প্রাপ্য চাল দিতে শুরু করেন।
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনও তিনি প্রত্যেকদিন সকাল সাতটা থেকে নিজের বাসায় বিনা পারিশ্রমিকে রোগী দেখতেন। শুধু তাই নয় এই কাজের সুবিধার জন্য তিনি নিজের পকেট থেকে খরচা করে দু’জন অতিরিক্ত ডাক্তার রেখেছিলেন। ক্ষমতার চরমতম জায়গায় থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ এক টাকারও তছরুপের অভিযোগ আনতে পারেনি। ৫ টাকা ২৫ পয়সা নিয়ে পটনা থেকে কলকাতায় আসা মানুষটি যখন নিজের বাড়িতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করছেন, বাড়িতে পাওয়া গিয়েছিল ১১ টাকা ২৫ পয়সা। অর্থাৎ সারা জীবনের সঞ্চয় ছয় টাকা। হয়তো অঙ্কের এই সরল হিসেবটাই উত্তর দিয়ে যায় তিনি কে এবং কী ছিলেন এই দুটো প্রশ্নের। আজ তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুদিনে এই লেখাই হোক দেশের ‘জাতীয় ডাক্তার’-এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।