ভুয়ো ভ্যাকসিনকাণ্ড নিয়ে একদিকে যেমন উত্তাল রাজ্যরাজনীতি, তখন টাকা দিয়ে টিকাকরণ করার অভিযোগ উঠল। বিনামূল্য রাজ্যবাসীকে করোনা টিকা দেওয়া হবে এ কথা আগেই ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, শিলিগুড়িতে উঠে এল সম্পূর্ণ উল্টো ছবি। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ‘স্বেচ্ছায়’ টাকা দিলে তবেই মিলছে টিকা। অভিযোগ, ঘুরপথে টিকাকরণে (COVID Vaccination) অর্থ আদায় করা হচ্ছে।
শিলিগুড়িতে বণিকসভা, পর্যটন ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্প-সহ বিভিন্ন সংস্থার অভিযোগ রাজ্যের তরফে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে হকার, শ্রমিক, পরিবহন কর্মীদের টিকাকরণে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু টিকা নিতে গেলে তার জন্য টিকা পিছু ৩১৫ টাকা জমা দিতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, টিকা নিতে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দিতে হবে। সাধারণত, ত্রাণ তহবিলে নিজের ইচ্ছায় টাকা দিতে পারেন মানুষ। সেই টাকা জনস্বার্থেই ব্যবহৃত হওয়ার কথা। কিন্তু, অভিযোগ, ত্রাণ তহবিলে টাকা ফেললেই টিকা মিলছে। নয়ত, টিকা পাওয়া যাচ্ছে না। আরও অভিযোগ, টাকা দিয়ে রসিদ দেখালে তবেই মিলছে টিকা।
নর্থ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিস আস্যোশিয়েশন নামের একটি ব্যবসায়ী সংগঠনের সম্পাদক সুরজিৎ পাল বলেন, “আমাদের স্বেচ্ছায় টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। টিকা পিছু ৩১৫টাকা ধরে মোট পাঁচশ জন কর্মীর জন্য টাকা জমা দিয়েছি। তারপরেই রাজগঞ্জে কারখানার শ্রমিকদের টিকা দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ বলেই আমরা খুশি মনে ওই টাকা দিয়েছি।”
ইস্টার্ন হিমালয়া ট্রাভেল আন্ড ট্যুর অপারেটর আস্যোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক সন্দীপন ঘোষ বলেন, “টাকা স্বেচ্ছায় জমা দিতে বলা হলেও টাকার অঙ্ক বলে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের পর্যটন দফতরের আধিকারিকরা ফোন করে জানিয়েছেন ওই টিকা পিছু ৩১৫ টাকা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এটাই সরকারের নীতি। টাকা না দিলে টিকাও মিলছে না। বেসরকারি সংস্থা গড়ে ৮০০ টাকা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজ্যের ত্রাণ তহবিলে তিনশো পনেরো টাকা দিয়ে আমরা টিকা নিচ্ছি। গতকাল শিলিগুড়িতে আমাদের টিকার শিবিরে ২২০ জন টিকা নেন। আমরা রাজ্যে ত্রাণ তহবিলে ৬৯৩০০ টাকা দিয়ে টিকাকরণ করিয়েছি।”
মুখ্যমন্ত্রী খোদ যেখানে ঘোষণা করেছেন বিনামূল্যে রাজ্যে টিকাকরণ (COVID Vaccination) হবে, এমনকী কেন্দ্রের তরফে টিকা মিলছে না বলেও অভিযোগ করেছিলেন মমতা, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কেন টাকা দিলে টিকা মিলছে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। তাহলে, বিনামূল্যে টিকাকরণের নামে ঘুরপথে অর্থ আয় করছে রাজ্য সরকার?
সূত্রের খবর, সম্প্রতি, রাজ্য সরকারের তরফে সকল জেলাশাসকদের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই চিঠিতে কীভাবে টিকাকরণ হবে তা যেমন সবিস্তারে বলা আছে, তেমনই চিঠির শেষে দুটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস সহকারে বলা হয়েছে কেউ যদি টাকা দিতে ইচ্ছুক থাকেন তবে কোভিড কেয়ার ফান্ডের জন্য টাকা দিতে পারেন। সেই টাকা যাবে মুখ্য়মন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে।
কিন্তু, শিলিগুড়িতে টিকা দিতে গেলে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে টাকার অঙ্ক। বেসরকারি হাসপাতালে টিকা নিতে গেলে গড়ে যেখানে ৮০০টাকা নেওয়া হচ্ছে, সেখানে সরকারি খাতে নেওয়া হচ্ছে টিকা পিছু ৩১৫ টাকা। প্রশ্ন উঠছে, কোভিড কেয়ার ফান্ডে কেউ চাইলে টাকা দিতেও পারেন আবার নাও পারেন, তাহলে কেন বেঁধে দেওয়া হচ্ছে টাকার অঙ্ক কেনই বা টিকা নিতে গেলে তহবিলে টাকা দিতে হবে এই নির্দেশ জারি হচ্ছে? তাহলে কি ‘সর্ষের মধ্য়েই ভূত?’ পাশাপাশি, রাজ্য সরকারের টিকা কি ঘুরপথে বাইরে বিক্রি হচ্ছে এমন প্রশ্নও উঠে আসছে।
সম্প্রতি, করোনা মোকাবিলা ও টিকাকরণ নিয়ে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে টিকাকরণ নিয়ে বণিকসভার কাছে টিকা কেনার আবেদন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী, বেসরকারি হাসপাতালগুলিকেও রাজ্যের থেকে টিকা কেনার আবেদন করেছিলেন মুখ্য়মন্ত্রী। সেই মতো প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল বণিকসভা। কিন্তু, শিলিগুড়িতে কীভাবে টিকাকরণের ক্ষেত্রে কীভাবে এই টিকার দাম বেঁধে দেওয়া হল, কে-ই বা এই দাম বেঁধে দিল তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এতদিন পর্যন্ত বিনামূল্যে যেখানে টিকা প্রদানের কথা ঘোষণা করে এসেছে সরকার, সেখানে কি তবে এভাবেই ত্রাণ তহবিলে ‘স্বেচ্ছায়’ টাকা দেওয়ার নামে টিকা বিক্রি হয়ে চলেছে? এমন প্রশ্নও তুলেছেন অভিযোগকারীরা।
তবে এ বিষয়ে শিলিগুড়ি প্রশাসনের তরফে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। শিলিগুড়ির পুর প্রশাসক গৌতম দেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এই ঘটনায়, শিলিগুড়ির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তৃণমূল নানা বেআইনি কর্মকাণ্ড করে চলেছে। এইভাবে ত্রাণ তহবিলে টাকা দিয়ে টিকাকরণ করানো যায় না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। আমরা এ বিষয়ে উপযুক্ত জায়গায় বলব।” অন্যদিকে, বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি অনিন্দ্য ওরফে রাজু বন্দ্যোপাধ্য়ায় বলেন, “রাজ্য়ে কিছু পেতে গেলেই কাটমানি দিতে হয়। টিকা নিতে গেলেও দিতে হচ্ছে। এ আর নতুন কী! ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তৃণমূল নেতারা চিরকূট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা পেয়ে যান। সাধারণ মানুষ টিকা পান না। তৃণমূলের থেকে এই আচরণই স্বাভাবিক।”
তথ্যঃ tv9