একটি সম্প্রদায়ের নৃত্য পরিবেশনা চলছে। বিভিন্ন বয়সের মানুষ এই ট্রুপের সদস্য। তিন থেকে শুরু করে পঞ্চাশ বা ষাট বছর বয়সীরাও রয়েছেন এই দলে। অনুভূমিক এবং উল্লম্ব রেখা বরাবর একজন সাহসী যুবকের লোকগানের সুরে সুরে চলছিল এই নাচ। এই যুবকের কপালে আঁকা রয়েছে গোল তিলক এবং তিনি একটি সাদা ঘোড়ায় উঠে পলয়কারারকে(বহুবিদ) নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
কঙ্গু অঞ্চলটি বিখ্যাত ছিল তার নমনীয় উপভাষার জন্য এবং এই একই অঞ্চল বয়ে নিয়ে চলছে ধীরন চিন্নামালাই ও তাঁর সৈন্যদলের বীরত্বের কাহিনী।
কঙ্গুনাড়ু অঞ্চলের রবিনহুড (পশ্চিম তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুর, এরোড, করুর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল), থেরথাগিরি সরকারাই গৌন্দর এবং তাঁর যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের নিয়ে সেই বজ্রকঠিন প্রতিরোধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ( যার সম্মুখভাগে ছিলেন হায়দার আলী এবং পিছনে ব্রিটিশরা) লুট করার জন্য, যাঁরা মানুষদের কাছ থেকে ট্যাক্সের টাকা আদায় করে ফিরছিলেন। এই গানগুলির থেকে আমরা জানতে পারি যে তিনি হায়দার আলী’র কর আদায়কারী দিওয়ান মহম্মদ আলীকে বলেছিলেন তিনি যেন এই বার্তাটি হায়দর আলি’কে জানিয়ে দেন—
“সেন্মিমালাই এবং শিবনমালাইয়ের মধ্যে রাজত্ব করছেন চিন্নামালাই”
এবং ধীরন চিন্নামালাই-এর এই ঘোষণাটি তাঁর নাম কালজয়ী করে তুলতে সাহায্য করেছিল। কঙ্গু অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে তাঁর এই বাণী অনুরণিত হয়ে চলেছে সেই সূদূর অতীতের পথ ধরে বর্তমান সময়েও।
সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চিন্নামালাই টিপু সুলতানের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। ১৭৯৯ খ্রীষ্ট্রাব্দে চতুর্থ অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধে টিপুর মৃত্যুর পরেও, ব্রিটিশদের হুমকি দেওয়ার ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন চিন্নামালাই, আর এইভাবেই তামিলনাড়ুর দক্ষিণে ব্রিটিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বাধা পায়। ব্রিটিশরা সারা দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয় রথ অপ্রতিরোধ্য রাখতে পারলেও, তাঁরাও কিন্তু সেই ধীরণ চিন্নামালাইয়ের সেনাবাহিনীর সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, যাঁকে সমস্ত যুদ্ধের বিজেতা হিসাবে অভিহিত করা হয়।
তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠন করেছিলেন যেখানে স্থানীয় শাসকদের পাশাপাশি ছিলেন মারাঠা রাজা এবং পাজাসি রাজাও। সেখানে ছিলেন পলিগার যুদ্ধের অংশীদার মারুধু পান্ডিয়ার ব্রাদার্স এবং বীরা পান্ডিয়া কট্টোবমান যারা ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ধরার পর, মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। তারপরেও, ধীরন চিন্নামালাই তাঁর গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের মাধ্যমে ব্রিটিশ সেনাদের মনে ভয়ের সঞ্চার করার সাথে সাথে তাদের বড় দুঃচিন্তার কারন হয়ে উঠেছিল। কাবেরী নদীর তীরে শিবনামালাই এবং সেন্মিমালাই এবং আরাচালুরের সমতল সমভূমিগুলিতে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধে ব্রিটিশরা বারবার পরাজিত হয়েছিল তাঁর শক্তির কাছে।
কথিত রয়েছে যে ব্রিটিশরা সমস্ত নথি থেকে চিন্নামালাইয়ের ইতিহাস মুছে ফেলেছিল কারণ এই পর্বগুলি ছিল তাঁদের জন্য ভীষণ অস্বস্তিকর – যদিও এই স্থানীয় দলনেতার কাছে নিজেদের পরাজয় মেনে নিতে তারা বাধ্য হয়েছিল। এই কাহিনীগুলির থেকে আমরা জানতে পারি যে লেফটেন্যান্ট ম্যাক্সওয়েলকে চিন্নামালাই হত্যা করে তাঁর মাথা একটি থামবালামে (তামা প্লেটে) রেখে তা ব্রিটিশদের হাতে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, যদিও ম্যাক্সওয়েলের মৃত্যুর কোনো জীবন্ত দলিল পাওয়া যায়নি।
ব্রিটিশরা নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতার ধারাটি সবসময়ই পুনরাবৃত্তি করে গেছে। ধীরন চিন্নামালাইয়ের রাধুনী, নল্লাপ্পানের সাহায্যে, ১৮০৫ খ্রীষ্ট্রাব্দে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ওদানিলাই দুর্গ থেকে তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হয়। ধরা পড়ার পরেও ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে অস্বীকার করেন চিন্নামালাই। ৩১শে জুলাই সঙ্কাগিরি দুর্গে নিয়ে এসে চিন্নামালাইকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ওদানিলাই দুর্গকে ভেঙে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
ওয়িলিত্তম এবং কুম্মি নৃত্যরূপগুলো আসলে সেই ভূমিপুত্রকেই উৎসর্গ করা হয়, যিনি নিজগুণে সসম্মানে দেবতার স্থানটি অর্জন করেছেন। চারণ কবিরা গান শুনিয়ে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে যান— ‘যতদিন মানুষ শ্বাস নিতে পারবে বা চোখ দেখতে পাবে, ততদিন তিনি জীবন বাঁচাবেন এবং জীবন দান করবেন’— তিনি হলেন আমাদের ধীরন চিন্মামালাই। এই গানগুলি শ্রেণী এবং বর্ণের সীমানা অতিক্রম করে কঙ্গু অঞ্চল ছাড়িয়ে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়া উচিত। লক্ষ লক্ষ জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে, ঐক্যবদ্ধ করতে এবং তাদের মনে অখন্ডতার বীজ বপন করার ক্ষমতা আছে এই সৃষ্টিগুলির। একদিন সেই ভোর আসবেই, যে ভোরে আমাদের বাচ্চারা পাঠ্যপুস্তকে লোচিন্বর এবং তাঁর কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে আমাদের জাতীয় বীরদের জয়গান, তাঁদের বীরগাথাগুলি পড়বে।