কাজী মাসুম আখতার: ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধ লড়াইয়ে জ্বলে ওঠা এক অগ্নিশিখা..

কাজী মাসুম আখতার: ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধ লড়াইয়ে জ্বলে ওঠা এক অগ্নিশিখা..
সুষ্ঠ সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অতুলনীয়। কিন্তু বর্তমান যুগে ক-জনই বা সে-কথা মনে রাখেন…? ক-জনই বা পালন করেন নীতিমূলক কর্তব্যরীতি ? কিন্তু আজ এক ভিন্ন লড়াইয়ের গল্প শোনাব…। নাহ! বেশি হেঁয়ালি না করে বরং শুরুই করা যাক,

পড়াশোনা শেষে ১৯৯১ সালে রায়পুর নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ। তবে, এ কিন্তু কোন আরামদায়ক সফর ছিল না, সেই ছিল লড়াইয়ের শুরু…। স্কুলটি লক্ষীকান্তপুর এলাকার আওতায়। সেইসময় সে-এলাকা বিখ্যাত ছিল চোলাই মদের রমরমায়। প্রথমিককাবে যা সামাজিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়। দিনের পর দিন নানা ধরণের কু-কর্মে জড়িয়ে পড়ে সেখানখান মানুষেরা। এই ব্যাপারটা প্রচন্ড আঘাত দিত মাসুম সাহেবের মনে। স্কুলে ঢুকেই সামাজিক উন্নতিতে মাসুম আখতারবাবু স্থানীয় মহিলাদের সাথে নিয়ে একেরপর এক চোলাইয়ের ঠেক ভাঙতে থাকেন। শুরু হয় অপশক্তির বিরুদ্ধে দুরহ লড়াই। শেষমেশ সাহসী লড়াইয়ের মুখে দুর্বৃত্তের দল পরাজিত হয়ে সে-এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জয় হয় মাসুম সাহেবের, জয় হয় মনুষ্যত্বের…। এখানেই শেষ…? একদম নয়, সবে তো শুরু…।
এরপর ২০১২ সালের জুলাইয়ে তিনি তালপুকুর আড়া হাই মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সম্মুখে যে এক ভয়ংকর লড়াই তা তিনি প্রথমেই টের পাননি। সেই স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ তো ছিলই না, এমনকি বাইরের লোক যখন তখন সেখানে ঢুকে হল্লা জমাত। ছাত্ররা মোবাইল নিয়ে স্কুলে আসত। আর একদল শিক্ষক তো সময়ের কোন তোয়াক্কাই করতেন না। এরকম কার্যকলাপ নিয়মবিরুদ্ধ, আর নিয়ম, অনুশাসনই ছিল মাসুম সাহেবের একমাত্র লক্ষ্য। তাই কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। সুশানের আওতায় এনে একসময় তিনি এ ঘটনার অবসান ঘটান। কিন্তু নিভু আগুনে ঘি পড়ে কিছুদিন পরে…। কিছুদিন পরে পড়ুয়াদের সংস্কৃতিমনস্ক করার লক্ষ্যে স্কুলের মধ্যেই তিনি শুরু করেন গান, নাচ, আবৃত্তি চর্চা। আর গোলযোগটা বাধে সেখানেই। বলা হয়, এর মধ্যে অনেকগুলি ‘ইসলামবিরোধী’। আবার বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালন করতেও সমস্যা, কেন না ওঁরা হিন্দু। তাই কমিটি থেকে জানান হয় এসব এখানে চলবে না মোটেই! এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই চালাচ্ছিলেন মাসুম আখতার সাহেব, কিন্তু ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল তখন, যখন জাতীয়সংগীত চালু করায় সবাই বললে সেটা নাকি হিন্দুত্ববাদী গান! তাই এ প্রার্থনা স্কুল চত্ত্বরে কোনভাবেই গাওয়া চলবে না। সেই বিষয়ে উচ্চঃস্বরে জাতীয় সংগীত গেয়ে প্রতিবাদ করায় মাসুম সাহেদেব মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয়। রক্তাক্ত হন তিনি, রক্তাক্ত হয় সভ্যতা, সংস্কার। পরে বুঝেছিলেন, ‘মৌচাকে ঢিল পড়লে কামড় তো খেতেই হবে’। কারণ বহু লোকের স্বার্থসিদ্ধির জায়গা তিনি নিজ হাতে নষ্ট করেছিলেন যে। তবে নিজের জন্য নয়। পড়ুয়াদের জন্য। অনেক অভিভাবকের সমর্থন পেয়েছিলেন। স্থানীয় মানুষেরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এটাই তো বড় পাওনা। এইসময় তিনি মাঝে মাঝেই হুমকি চিঠি পেতেন। এমনকি, খুন করার চেষ্টাও চলে এক দু-বার। তবু, অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি কদাপি পিছপা হননি।
তাঁর মতে, “জাতীয় সংগীত গাওয়া বা বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন যদি অপরাধ হয়, তবে সে অপরাধ আমি বারবার করব।” একটি পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন— ‘‌যদি কোনও মাদ্রাসা সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে মুসলিমদের উচিত সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়া’।‌ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বলা হল, তিনি বলেছেন মাদ্রাসা গুঁড়িয়ে দিতে। সেদিন রাত্রেই তাঁর বাড়িতে চড়াও হয় উত্তেজিত জনতা। আসলে কিছু অপশক্তিপ্রবণ মানুষ এইসব অল্পপ্রশিক্ষিত মানুষকে ভুল পথে চালনা করেছিল। সবাই এককথায় স্বীকার করেছিল, স্কুলে পড়াশোনা খুব ভাল হচ্ছে, কিন্তু এই জাতীয় সংগীত বা জন্মদিন পালন এসব নাকি বন্ধ করতে হবে। শেষমেশ পুলিশ এসে সেই বিপদ থেকে মাসুম সাহেবকে রক্ষা করে।
নিরাপত্তার কারণে সরকার থেকে তাঁর বদলির ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৬ সালের মে মাসে তিনি যোগ দেন কাটজুনগর স্বর্ণময়ী বিদ্যাপীঠে। তখন সেই স্কুলের পড়ুয়ার সংখ্যা ১৬০। স্কুলে ঢুকেই তিনি দূরদূরান্ত থেকে পড়ুয়া এনে ভর্তি করানোর উদ্যোগ নেন। ফলে পড়াশোনার মানোন্নয়ন হয়েছে। পাশাপাশি বসেছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল, টাইল্‌স, মার্বেল। হয়েছে জিম, ফুলের বাগান। খেলাধুলোয় অগ্রগণ্য সেই স্কুল। সমানতালে চলছে সংস্কৃতিচর্চাও। স্বচ্ছ বিদ্যালয় প্রকল্পে তারিফ কুড়িয়েছি। নির্মল বিদ্যালয়ের পুরস্কারও পেয়েছে।
এবার একটা চমৎকার তথ্য দিই…
তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল আসার পিছনে তাঁর ভূমিকা কিন্তু একদম ফেলে দেওয়ার মতন নয়। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধ করার জন্য অনেক লেখালেখি করেছেন। ২০১৭ সালে জনমত সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। ১ লক্ষ সই সংগ্রহ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। সেই কারণে এবার বহুবার তাঁর পরিবার পড়ে হুমকির মুখে। শাসানো হল, বাড়িতে ঢুকলে মারবে। সেই রাগে, লজ্জায়, অভিমানে, প্রতিবাদে আড়াই বছর বাড়ি যাননি তিনি। এই হল প্রতিবাদী মুখ, বাংলা মায়ের বিশ্ববরেণ্য দামাল ছেলে কাজী মাসুম আখতারের লড়াইয়ের গল্প, যা আজও অব্যাহত নিরন্তরভাবেই…।
একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “শিক্ষার উন্নয়নের জন্য যা করার করব। রক্ত দিয়েছি। আবার দেব। জাতি গঠনের জন্য জান যায়, যাক।” ২০২০ সালে তিনি ভারত সরকার প্রদত্ত সম্মানীয় পদ্মশ্রী পুরস্কারে বরণীয় হন।

©কলমে – অভীক পোদ্দার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.