আজ পুন্যতিথি জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা, কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না, কালীক্ষেত্র কালীঘাটে কলিকাতা অধীস্বরি শ্রী শ্রী দক্ষিনাকালী মাতার ও স্নানযাত্রাও করা হয় আজকের তিথিতেই।।
কালীক্ষেত্র কালীঘাটে সতীর দক্ষিণ পদের চারটি খণ্ডিত অঙ্গুলি পতিত হয়েছিলো। তাই একান্নটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠের মধ্যে কালীঘাট একচল্লিশতম সতীপীঠ। সাবর্ণ গোত্রীয় ২১তম পুরুষ জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় অল্পবয়সেই মহাপণ্ডিত রূপে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৫৩৫ বা ৪৮খ্রিঃ হুগলি জেলার গোহট্ট-গোপালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হালিশহরের চতুষ্পাঠীতে অধ্যায়ন করতেন। তাঁর পাণ্ডিত্য এবং চেষ্টায় বঙ্গদেশে ন্যায়শাস্ত্রের সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-
“কাম-কমল-গঙ্গেশ
তিন নিয়ে বঙ্গদেশ।।”
জীয়ার অপর নাম কামদেব। তাঁর সাধনোত্তর নাম কামদেব ব্রক্ষ্মচারী। পণ্ডিত জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় ‘বিদ্যা বাচস্পতি’ উপাধি দ্বারা ভূষিত হয়েছিলেন। উনিশ বছর বয়সে জীয়ার স্ত্রী পদ্মাবতী কোন সন্তানের জন্ম না দেওয়ায় তারা কালীঘাটে আসেন। তখন কালীক্ষেত্র কালীঘাটে গঙ্গাতীরে কালীমূর্তি এবং নকুলেশ্বর ভৈরবের অনতিদূরে পর্ণকুটীর তৈরী করে তারা বসবাস করেন। কালীঘাটের দেবীর মাহাত্ম্য তখন বিশেষভাবে সর্বত্র প্রচারিত। এস্থান তখন জঙ্গলাকীর্ণ ও জলাভূমি। জীয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের ইষ্টদেবী কালীঘাটের কালীমাতা। প্রধান পুরোহিত আত্মারাম ঠাকুর। তাঁর শিষ্য অানন্দগিরি ও তার সঙ্গে মন্দিরে থাকতেন। জীয়া শাস্ত্রজ্ঞ, ধর্মনিষ্ঠ ও মহাপণ্ডিত। জীয়া ও পদ্মাবতীদেবী উভয়ে কালীমাতার নিকট সাধনায় মগ্ন হলেন। তৃতীয় দিনের পর পদ্মাবতীদেবী শেষরাত্রে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দর্শন করলেন। তিনি স্বামীকে বললেন কালীকুণ্ডে স্নান করলে পুত্রসন্তান সন্তান লাভ করবেন (পরবর্তিকালে পদ্মাবতী পুত্র সন্তানলাভ করে ছিলো)। পরদিন প্রত্যুষে যখন সূর্য ব্রহ্মরূপ ধারন করেছে সেই সময় পদ্মাবতীদেবী কালীকুণ্ডে স্নান করে দেখলেন-কালীকুণ্ডের একটি নির্দিষ্ট স্থানে আলোকজ্যোতির বিদ্যুতের মতো ঝলসে গেল চারিদিক। মনে হচ্ছে ওই আলোকমালা থেকে যেন এক জ্যোতির্ময়ী মূর্তি অস্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মাবতীদেবী দৈববাণী শ্রবণ করলেন-ওি খানেই সতীর দক্ষিণ পদের অংশ নিমজ্জিত আছে। পদ্মাবতীদেবী ও জীয়ার অনুরোধে আত্মারাম ঠাকুর কালীকুণ্ডের সেই নির্দিষ্ট জলতল থেকে সতীর দক্ষিণ পদের চারটি আঙুল সম্বলিত একটি প্রস্তর খণ্ড তুলে আনলেন।
সামনের জ্যৈষ্ঠমাসের স্নানযাত্রার পূর্ণিমা তিথিতে দুই সন্ন্যাসী ভক্তিসহকারে যথাবিধি পূজা করে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে সতীর দক্ষিণ পদের আঙুল চারটি প্রতিষ্ঠা করেন। তারা সুগন্ধি তেল, চন্দন, মধু আর দুধ দিয়ে স্নান করান সতীঅংশকে। স্বপ্নাদেশ মতো অঙ্গুলি চারটিকে কালীমাতার বেদীর অগ্নিকোণে গর্ভগৃহে স্থাপন করলেন। এখনও তা রুপোর বাক্সে কালীঘাটে রক্ষিত আছে।
আজও প্রতি বছর স্নানযাত্রার দিনে মায়ের গোপন ভাবে স্নানযাত্রা পালিত হয় গর্ভগৃহে, কালীঘাট মন্দিরের অন্যতম সেবায়েত জহর চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘নিয়ম মেনে গঙ্গাজল, ডাবের জল, দুধ, দই, সুগন্ধি ও জবাকুসুম তেলের মিশ্রণ দিয়ে কালীমূর্তি এবং ওই অঙ্গ স্নান করানো হয়। ওই অঙ্গটি বেনারসি বস্ত্রে মুড়িয়ে রাখা থাকে। বছরভর প্রতিমার সিঁদুর বদলানো হয়। সেই সঙ্গে প্রতিমাকে শাড়িও পরানো হয়। কিন্তু বছরের ওই দিনই মূর্তিকে স্নান করানো হয়। মন্দিরের নির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরোহিতেরা আচার মেনে স্নানযাত্রা করেন।।’’