লর্ড ম্যাকাওলি একা এমন গর্হিত অপরাধ করেছিলেন তা নয়
আমরা অনেকবার শুনেছি যে এই লর্ড ম্যাকাওলি কীভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছেন, কিন্তু আপনি কি এই একই দোষে দুষ্ট এবং আরও বিপজ্জনক আলেকজান্ডার ডাফ সম্পর্কে জানেন? আক্ষরিক অর্থে, এই খ্রিস্টান মিশনারী বাংলা ও বিহারের শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয়ের জন্য একমাত্র দায়ী।
১৮০৬ সালের এপ্রিল মাসে স্কটল্যান্ডে ডাফ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৩০ সালে চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের প্রথম মিশনারি হিসাবে কলকাতার তীরে পৌঁছেছিলেন।
এখানে এসে তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হ’ল, উচ্চশ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষার টোপ দিয়ে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করা।
এর আগে পর্যন্ত মিশনারিদের মূল নজর ছিল নিম্ন শ্রেণীর দিকে এবং তাঁরা তাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের সময় বাংলা ভাষার ছোঁয়াটুকু পর্যন্ত লাগতে দেননি। ডাফ সমাজের নির্দিষ্ট কিছু অংশকে কেবলমাত্র ইংরেজী এবং শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাতেই শিক্ষিত করার প্রচার শুরু করার আগে পর্যন্ত তাঁরা মূলত আঞ্চলিক ভাষাতেই নিজেদের কাজের নির্দেশনা করতেন।
ডাফ সুচিন্তিতভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার বীজ বপন করে ধীরে ধীরে হিন্দু ও মুসলমানদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন।
তাঁর কাজের সাফল্যের পিছনে এই নিম্নলিখিত প্রভাবগুলি ছিল:
১) শিক্ষাব্যবস্থায় ভারত সরকারের নীতি পরিবর্তন করা।
2) খ্রিস্টান গীর্জার আওতায় থাকা মিশনারি সংস্থার তত্বাবধানে বাড়িতে এই শিক্ষার স্বীকৃতি সুরক্ষিত করা।
৩) উচ্চ-বর্ণের হিন্দুদের মনে খ্রিস্টীধর্মের সুরক্ষার বীজ বপন করা।
আলেকজান্ডার ডাফ একটি তত্ত্বের প্রস্তাবনা করেছিলেন যা তিনি “নিম্নগতির পরিস্রাবণ তত্ত্ব” বা “ডাউনওয়ার্ড ফিলটারেশন পলিসি” নামে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণিগুলিতে খ্রিস্টধর্মের জ্ঞান প্রবেশ করাতে পারলেই তা শেষ পর্যন্ত সামাজিক সিঁড়ি হিসেবে সমাজের সব স্তরের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে। ১৯৩৫ সালের ৭ ই মার্চ এমনই একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল যেখানে ভারতে উচ্চশিক্ষার অগ্ৰগতির জন্য ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য হয়ে উঠলো ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রচার করা এবং শিক্ষার জন্য বরাদ্দ হওয়া সমস্ত তহবিলই সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানো আর সেটাও শুধুমাত্র ইংরেজি শিক্ষার প্রচার এবং প্রসারের জন্য।
১৮৩৪ সালে ডাফ ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ১৮৪০ সালে তিনি চার্চ অব ইংল্যান্ড এবং চার্চ অব স্কটল্যান্ড নামক নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রচুর তহবিল নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাইবেল শিক্ষার প্রচার ও ধর্মান্তরীকরন। ডাফ তাঁর এই ধর্মান্তরীকরনের নিরবচ্ছিন্ন ধারা অব্যাহত রাখতে ফ্রি- চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ১৮৫৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮৪৪ সালে গভর্নর জেনারেল ভিসকাউন্ট হার্ডিং তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, তাঁর প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা সকলেই সরকারী চাকরীর পাওয়ার যোগ্য।
সেইসব সর্বাধিক কুখ্যাত বাঙালি, যাঁরা খ্রিস্টধর্ম গ্ৰহন করেছিলেন
তাঁর অধীনে অনেক প্রভাবশালী বাঙালি যেমন রেভারেন্ড লাল বিহারী দে এবং কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জির মতো মানুষ খ্রীষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
১৮৪৯ সালে, ডাফ ইংল্যান্ড ফিরে যান। তারপর তিনি মার্কিন ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তবে তিনি আবার ১৮৫৬ সালে ভারতে ফিরে আসেন।
১৮৫৭ সালে অর্থাৎ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাকালে ডাফ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নেন। শেষ পর্যন্ত, ১৮৬৩ খ্রীষ্ট্রাব্দে স্বাস্থ্যের অবনতির হলে ডাফ চিরতরে ভারত ছেড়ে চলে যান।
আলেকজান্ডার ডাফ ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ই ফেব্রুয়ারি ডেভনে মারা যান।
বাংলার বাইরে আলেকজান্ডার ডাফের কর্মকাণ্ড
অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে খ্রীষ্টান মিশনারিতে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে ডাফ কলকাতার বুকে নিজেকে এবং নিজের মতাদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। আর তারপর তিনি পাড়ি জমান সিংহলে।
১৮৩২ খ্রীষ্ট্রাব্দে, স্কটল্যান্ড চার্চ জন উইলসন নামক আরেকজন ধর্মপ্রচারককে বোম্বাইয়ে প্রেরণ করা হয়। তিনি ডাফের ধর্মান্তরীকরনের পদ্ধতিগুলির অনুকরণ করেছিলেন।
বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা বলেন যে রাজা রামমোহন রায় গর্বিত হিন্দু ছিলেন, আমি তাঁদের এটাই বলি যে রাজা রামমোহন রায় “হিন্দু অজ্ঞতা” দূর করতে চাওয়ার নাম করে ডাফের পদ্ধতিগুলোকে অনুমোদন করেছিলেন। একটা ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর শিক্ষা গ্ৰহনের মধ্য দিয়ে কীভাবে অজ্ঞতা দূর করা যায়? খ্রীস্টানরা সেই বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে না যা তাঁরা আপনাকে এবং অন্যদের শোনায় বরং তাঁদের বিশ্বাস সম্পূর্ণ বিপরীতে।
না, এটা এখন পুরোপুরি স্পষ্ট যে ডাফের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনে সহায়তা করার জন্য বাধ্য এবং অনুগত খ্রীস্টান সৈন্যদল তৈরী করা।
শেষা পাতাঙ্গী