পরীক্ষার বদলে মূল্যায়নের ‘বিতর্কিত’ পদ্ধতি— কী বলছেন অভিজ্ঞরা

করোনার জন্য এবছর মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হচ্ছে না। পরিবর্তে এর মূল্যায়ন কী ভাবে হবে তা ঘোষণা করেছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চ শিক্ষা সংসদ। ২০২১-এর মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা এই মূল্যায়নের ফলে কত নম্বর পেতে পারেন, তার একটা নমুনাও দিয়েছে পর্ষদ এবং সংসদ। কেউ স্বাগত জানাচ্ছেন এই সিদ্ধান্তকে। কেউ বা মনে করছেন ‘বাংলায় শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতা হল‘।

অভূতপূর্ব এই অবস্থা কতটা সমর্থনযোগ্য, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। প্রবীন শিক্ষাবিদ, ন্যশনাল বোর্ড ফর অ্যাক্রিডিটেশনের বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ নিখিল রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “এই সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য পর্ষদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের বড় ক্ষতি করল। কারণ, পরীক্ষা, পরীক্ষা, একমাত্র পরীক্ষাই মূল্যায়ণের প্রকৃত এবং বিজ্ঞানসম্মত পথ। এর কোনও বিকল্প নেই। হতে পারে না।“ একই মত প্রবীন শিক্ষাবিদ তথা প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ পবিত্র সরকারের। তাঁর মতে, বলতে পারেন বাংলার শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতা হল।

কিন্তু যাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা কী বিষয়টা বোঝেননা? জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা শিবপুরের ‘বেসু‘-র প্রাক্তন উপাচার্য নিখিলবাবুর বক্তব্য, “অনেক সময় হয়ত বুঝেও প্রতিবাদ করতে পারেন না। কারণ, সরকার পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গণিতে ‘ধরা যাক বা ‘গিভন দ্য সারকামস্টেন্সেস’ বলে একটা কথা আছে। সংক্রমণের আশঙ্কায় সুরাহার পথ খুঁজতে গিয়ে কেরল তো পরীক্ষা তুলে দেয়নি। বিহার পরীক্ষা নিয়েছে। সিএসআইআর বা আইআইটি-গেট এর মত সর্বভারতীয় বৃত্তি বা প্রবেশিকাগুলোয় রাজ্যের বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার নম্বর খুব মূল্যবান। কোথায়, কীভাবে, কোন মানে পরীক্ষা হচ্ছে তারা খবর রাখে। এখানকার মূল্যায়ণের ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বরকে তারা গুরুত্ব দেবে না।“

পবিত্র সরকার বলেন, “মুড়িমুড়কির এক দরহয়ে গেল। মেধাবীরা হতাশ এবং বঞ্ছিত হবে। ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়বে। তৃণমূল বরাবরইর জনমোহিনী পথে হেঁটেছে। আমরা দুয়ারে পরীক্ষা চেয়েছিলাম। তার বদলে পাচ্ছি পকেটে নম্বর।“ কিন্তু পরিবর্ত পথ কী হতে পারত? পবিত্রবাবুর জবাব, “কেরল, বিহার কী করে নিল পরীক্ষা? সদিচ্ছাটাই আসল। কমিউনিটি হল, বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া যেত। শিক্ষক-অধ্যপকরা শুভ উদ্যোগে পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত ছিলেন।“ নিখিলবাবুর বক্তব্য, “অন লাইনে অথবা সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব ছিল। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার ডোমিনিক স্যাভিও জানিয়েছেন, ওঁদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি পরীক্ষা হবে।“

সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটি-র সম্পাদক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর এই প্রতিবেদককে জানান, “মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ ২০২১ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যা বলেছেন তার মাধমে মেধার বিচার হবে না।

মাধ্যমিক স্তরে এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ফলে কার্যত প্রচুর নম্বর পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে, তাতে মেধার যাচাই হবে না। কারণ, নবম শ্রেণীর প্রাপ্ত নম্বরের সাথে দশম শ্রেণীর নম্বরের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাযুজ্যপূর্ণ হয় না। ছাত্র-ছাত্রীরা নবম শ্রেণীর থেকে দশম শ্রেণীতে সাধারণত অনেক ভালো ফল করে থাকে। মেধার যথার্থ মূল্য না পাওয়ায় একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ও তাদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।

উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ফলও হবে একইরকম। কারণ, সাধারণত একাদশ শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীরা মাত্র ৮ মাস সময় পেয়ে থাকে, যার মধ্যে প্রথম দুমাস অকার্যকরী থাকে। তাই একাদশ শ্রেণির ফল সাধারণভাবে ভালো হয় না। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সাধারণত একাদশ শ্রেণির থেকে তারা অনেক ভালো ফল করে। উচ্চমাধ্যমিকের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একাদশ শ্রেণিতে প্রাপ্ত নম্বরের ৬০% থাকায় বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীর ফল আশানুরূপ হবে না। যা তাদেরকে হতাশাগ্রস্ত করবে এবং উচ্চশিক্ষায় পছন্দসই বিষয় নিয়ে ইচ্ছানুযায়ী ভর্তির ক্ষেত্রে প্রচন্ড অসুবিধার সম্মুখীন হবে।

পর্ষদ ও সংসদ বলেছে, এই মূল্যায়নে অসন্তোষ থাকলে যেকেউ অবস্থা স্বাভাবিক হলে পরীক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু সেই পরীক্ষায় কেউ ভালো ফল করলেও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেহেতু ভর্তি প্রক্রিয়া ততদিনে বাস্তবে সম্পূর্ণ হয়ে যাবে, তারা তার সুফল নিতে পারবে না। আমরা মনে করি পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পদ্ধতিতে এই মুহূর্তে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আমাদের দাবি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অযথা বিলম্ব না করে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।”

চন্দননগর কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান সঙ্গীতা ত্রিপাঠী মিত্র জানান, অতিমারীর অস্বাভাবিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে মাধ‍্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মূল‍্যায়ণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর প্রয়োজনীয় অংশের সঙ্গে বিগত শ্রেণীতে প্রাপ্ত নম্বরের ওপর নির্ভর করে এই মূল‍্যায়ণ। কোনও পরীক্ষার্থী সন্তুষ্ট না হলে সে পরীক্ষা দিতে পারবে পরিস্থিতি অনুকূল হলে। এ তো সঠিক সিদ্ধান্ত। এমন অনিশ্চয়তায় ভরা আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে মানসিক ভাবে ছাত্রদের পাশে থাকার এই উদ‍্যোগ সাধুবাদ যোগ‍্য। তবে এখানেই শেষ নয়। উচ্চ মাধ‍্যমিকে সফল পরীক্ষর্থীরা আরো বৃহত্তর জগতে প্রবেশ করবে। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলি বেশিরভাগই ভর্তির জন‍্য পরীক্ষা নেয়। কাজেই উচ্চ মাধ‍্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরই শেষ কথা নয়। এই সময়টায় আগামীর জন‍্য পড়াশোনা করে নিজেকে প্রস্তুত করাটাই এখন প্রধান লক্ষ‍্য হতে হবে।“

পঞ্চ সায়র শিক্ষা নিকেতনের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা সুপর্ণা চক্রবর্তী এই প্রতিবেদককে জানান, “সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সংসদের পক্ষ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি জানানো হয়েছে। অতিমারিতে পরীক্ষা হবে কি হবে না সেই নিয়ে পড়ুয়ারা খুবই মানসিক চাপের মধ্যে ছিল। সেই চাপ নিরসন হয়েছে বটে কিন্তু পরীক্ষার ফল তৈরীর যে পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে অন্তত মাধ্যমিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে তা কিছু সংশয়ের অবকাশ রেখে যায়।
মাধ্যমিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে ক্লাস নাইনের নম্বরের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বোর্ডের পরীক্ষা যেহেতু কেবল দশম শ্রেণীর সিলেবাসের ওপরই হয়, আমার সুদীর্ঘ শিক্ষক জীবনে দেখেছি যে ,ছাত্র ছাত্রীরা দশম শ্রেণীর মত গুরুত্ব দিয়ে সেই সিলেবাস পড়ে না। অন্যান্য বোর্ডের (আইসিএসসি /সিবিএসই) একদম ছোট ক্লাস থেকেই প্রতিটি বাচ্চার একটি আভ্যন্তরিন বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকে।আমাদের বোর্ডে সেই অবকাশ খুব কম।
তাছাড়া একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েও প্রচুর সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী নাইন থেকে টেনে ওঠে। সেটা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ক্লাস নাইনকে ততটা গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে ক্লাস নাইনের নম্বরের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া সাধারণ মানের ছাত্র ছাত্রী দের ক্ষেত্রে, যারা ততটা গুরুত্ব ক্লাস নাইনকে দেয় নি, যেটা তারা ক্লাস টেনের ক্ষেত্রে দিত— যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে।

দ্বাদশ শ্রেণীর ক্ষেত্রে একাদশ শ্রেণীর নম্বরের ক্ষেত্রেও একই অভিক্ষেপ পড়বে বলে আমার মনে হয়। দশম শ্রেণীর সিলেবাসের সঙ্গে একাদশ /দ্বাদশ শ্রেণীর সিলেবাসের আকাশ পাতাল পার্থক্য। ফলে ছাত্র ছাত্রীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একাদশ শ্রেণীতে হাবুডুবু খায়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে তাদের একাদশ শ্রেণীর রেজাল্টে। তারপর ধীরে ধীরে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং দ্বাদশ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। যেহেতু দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষার ফলের ওপরেই তাদের ভবিষ্যত জীবনের বুনিয়াদ দাঁড়িয়ে থাকে, তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে থাকে। সেখানেও একাদশ শ্রেণীর নম্বর তাদের বেশ কিছুটা পিছিয়ে দেবে।

শিক্ষাবন্ধু ঐক্য মঞ্চের রাজ‍্য সম্পাদক বিভূতিভূষণ মন্ডল এই প্রতিবেদককে জানান, “এই মূল‍্যায়ণ পদ্ধতিটা কোনও বিজ্ঞান বা শিক্ষাভিত্তিক নয়। বেশিরভাগ ছাত্রর ভবিষ্যৎ এই মূল‍্যায়নের উপর নির্ভর করে। তারা চায় তাদের পরীক্ষার মাধ্যমে মূল‍্যায়ন হোক। ৯০% ছাত্র পরীক্ষার জন‍্য প্রস্তুতি ছিল এবং তাদের পড়াশুনার মানটা পরীক্ষার খাতায় প্রতিফলিত করতে চায়। এই মূল‍্যায়নের ফলে নিন্মমানের ছাত্ররা ৬০% নম্বর পেয়ে যাবে। ভালো ছাত্ররা ভালো নম্বর পেলেও তাদের আরও ভালো নম্বর পাওয়ার আশা নির্মূল হয়ে যাবে। আর ‘নিট’ ও জয়েন্ট তাহলে পরীক্ষার মাধ্যমে হবে কেন?“

অশোক সেনগুপ্ত

http://bengali.hindusthansamachar.in/NewsDetail?q=bcb70658209fdd25c990da4e2a2b4ca9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.