কলকাতা, ১৮ জুন (হি স)। গত নভেম্বরে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন তার রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। এই বছর তা সরকারি ভাবে গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের মুখে। এটা নিশ্চিত, পশ্চিমবঙ্গ আরও কম টাকা পাবে কেন্দ্রের কাছ থেকে। ফলে তৈরি হবে রাজনৈতিক বিতর্ক। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বিতর্কের মাত্রা তৈরি করবে জটিলতা। কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তাকানো যাক বিশেষজ্ঞদের মতামতের দিকে।
পশ্চিমবঙ্গে গড়ে মাথাপিছু বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ এক লক্ষ এগারো হাজার টাকার চেয়ে সামান্য কম। অঙ্কটা কতখানি কম? এই প্রশ্ন তুলে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের সুরজিৎ দাস জানিয়েছেন, “হরিয়ানা, কর্নাটক, কেরল, তেলঙ্গানা, গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে মাথাপিছু আয়ের অর্ধেকের চেয়ে কম। মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণও এই রাজ্যগুলির চেয়ে ঢের কম। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯’এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ব্যয় বছরে গড়ে রাজ্যের এসডিডিপি-র ১৬.৬%। সর্বভারতীয় গড় ছিল ১৭%। এই একই সময়কালে গোটা দেশে যখন মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২১৫০০ টাকা, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে অঙ্কটা ছিল ১৬৭০০ টাকা। এই রাজ্যে মাথাপিছু জিএসডিপি-র পরিমাণ কম, সত্যি— এই সময়কালে মাথাপিছু জিএসডিপি-র নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে পিছন দিক থেকে দশম স্থানে ছিল। কিন্তু, মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের নিরিখে ছিল পিছন দিক থেকে তৃতীয় স্থানে। বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ দুটো মাপকাঠিতেই দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দুটো রাজ্য। কিন্তু, এই সময়কালে এমন সাতটা রাজ্যও ছিল, সেখানে মাথাপিছু আয় পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কম হলেও মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ এই রাজ্যের চেয়ে বেশি ছিল।
কেন পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ এমন হতাশাজনক, সেই কারণের সন্ধান করতে হলে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে নিজস্ব কর আদায়ের পরিমাণ সর্বভারতীয় গড়ের সত্তর শতাংশও নয়। কর-বহির্ভূত রাজ্য আদায়ের পরিমাণ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় আরও কম। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ সমেত মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও শোচনীয়— সর্বভারতীয় গড়ের পঁচাত্তর শতাংশের কাছাকাছি। কেন্দ্র থেকে প্রাপ্য বরাদ্দের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় গড় থেকে অনেকখানি পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯’এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মাথাপিছু কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছিল ৭৭৫০ টাকা; সর্বভারতীয় গড় ছিল ৮৩১৭ টাকা। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাই স্বভাবতই প্রচুর প্রশ্ন ছিল।“
বিজেপি-র রাজ্য পরামর্শদান কমিটির চেয়ারম্যান তথা দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি (১৯৯৯-২০০২) অধ্যাপক অসীম কুমার ঘোষের মতে, রাজ্যের এই কেন্দ্রীয় প্রাপ্তি কমার মূলে দায়ী রাজ্য। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সব নাগরিককে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ বৃদ্ধির দাওয়াই দিয়েছেন। কথাটা শুনতে ভাল লাগে। মাননীয়া তাঁর সূত্রে বিশ্বাসী। অপরদিকে এমআইটি ও কেম্ব্রিজে প্রশিক্ষিত পদ্মবিভূষণ অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী প্রশ্ন তুলেছেন, এই টাকাটা আসবে কোথা থেকে? স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সব রকম উপকরণ ছিল। সেগুলোর সদ্ব্যবহার করে সম্পদ সংগ্রহে রাজ্য কোনও সময় কৃতিত্ব বা দক্ষতা দেখাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন টাকা দেবে। তা দিয়ে তো সম্পদ তৈরি করতে হবে!”
সুরজিৎ দাস জানিয়েছেন, “টাকা বণ্টনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় যে মাপকাঠি, তার নাম পার ক্যাপিটা ইনকাম ডিসট্যান্স— কোনও রাজ্যের মাথাপিছু গড় আয়ের সঙ্গে দেশের ধনীতম রাজ্যের মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান। যে রাজ্যের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান যত বেশি, এই খাতে তার অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ তত বেশি। চতুর্দশ কমিশনে এই মাপকাঠির ওয়েটেজ বা গুরুত্ব ছিল ৫০%; এই দফায় তা পাঁচ শতাংশ কমেছে। জনসংখ্যার গুরুত্বও ২৭.৫% থেকে কমে হয়েছে ১৫%। রাজ্যের আয়তনের গুরুত্ব ১৫ শতাংশে অপরিবর্তিত; রাজ্যে বনাঞ্চলের পরিমাণের গুরুত্ব সামান্য বেড়েছে; যোগ হয়েছে কম জন্মহারের গুরুত্ব, এবং কর আদায়ে রাজ্যের ভূমিকার গুরুত্ব।“
পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সূত্র খতিয়ে দেখতে যখন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল কলকাতায় এসেছিল, পরামর্শ নিয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। বিজেপি-র তরফে ছিলেন দলের তৎকালীন বুদ্ধিজীবী কমিটির আহ্বায়ক ডঃ পঙ্কজ রায়। বর্তমানে যিনি দলের তৎকালীন অর্থনীতি কমিটির আহ্বায়ক। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন সংগৃহিত তহবিলের ৩৪ শতাংশ রাজ্যগুলোকে দিয়েছিল। চতুর্দশ অর্থ কমিশন দিয়েছে ৪২ শতাংশ। পঞ্চদশ কমিশনে সেটা কমে হয়েছে ৪১ শতাংশ। সুতারাং এমনিতেই সবার ভাগে একটু টান পড়বে। এ ছাড়া, বামেরা এ রাজ্যে যখন ক্ষমতায় এসেছিল, উত্তরাধিকার সূত্রে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের দায় নিয়েছিল। ২০১১ সালে যখন তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়, তখন ওই পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এখন ওই পরিমাণ বেড়ে ৪ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এটা রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রশাসনের একটা বড় ব্যর্থতা। এসবের মাপকাঠিতেই তো রাজ্যগুলোকে অর্থ বরাদ্দ করে কেন্দ্র।“
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তথা ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অফ ফরেন ট্রেড’-এর বরিষ্ঠ অধ্যাপক ডঃ বিশ্বজিৎ নাগ এই প্রতিবেদককে বলেন, “কোন রাজ্য কেন্দ্রের অর্থ কমিশনের কাছ থেকে কত পাবে, তা নির্ভর করে কিছু নির্থিষ্ট সূত্রের ওপর। এই নির্ণয়ে রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতিটাই প্রাধান্য পায়। তবে, কিছু বিতর্ক থাকেই। যেমন নব্বইয়ের দশকে নগরায়ণের ওপর কাজ করার জন্য কিছু রাজ্যকে বাড়তি সহায়তা থেওয়া হয়েছিল। আবার কখনও বনসৃজনের জন্য এ রকম আর্থিক সুযোগ দেওয়া হয়। গরিব রাজ্যকে বেশি টাকা দিলে মহারাষ্ট্র-গুজরাটের মত বড়লোক রাজ্যগুলো আপত্তি জানায়। তাদের যুক্তি, আমরাই তো কেন্দ্রীয় ভাঁড়ারে বেশি টাকা দিচ্ছি। তার ভাগ যথেষ্ঠ পরিমাণে আমরা পাব না কেন? আবার ওই যুক্তিতে অর্থ কমিশন অর্থ বরাদ্দ করলে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়ের মত গরিব রাজ্যগুলো রাজনৈতিক বৈষম্যের অভিযোগ আনে।
ইউজিসি-র প্রাক্তন ‘টিচার্স ফেলো’ তথা মহারাজা শ্রীশচন্দ্র কলেজের বিভাগীয় প্রধান অসীম কুমার ঘোষের মতে, “উৎপাদন আর বিপননের মধ্যে তো যুক্তিগ্রাহ্য সমন্বয় রাখতে হবে! গত পাঁচ দশক ধরে জোর দেওয়া হয়েছে বিপননের ওপর। উৎপাদন ছাড়া বিপনন কখনও সম্ভব? আর গত এক দশকে তো মাননীয়া সম্পদ সংগ্রহে কোনও নজর না দিয়ে জনমোহিনী পথে হেঁটেছেন। এতে রাজ্যের স্বাস্থ্য যা হওয়ার তাই হয়েছে? এই পরিস্থিতি বিচার করে সূত্র মেনে যদি অর্থ কমিশন যদি পশ্চিমবঙ্গকে কম বরাদ্দ করে, কেন্দ্রের কী দোষ?“
সুরজিৎ দাসের কথায়, কেন্দ্রীয় বরাদ্দ-সহ রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গ দেশে শেষ থেকে তৃতীয়— বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের পরেই। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের বণ্টন-সূত্র এই রাজ্যগুলোর বরাদ্দের পরিমাণ আরও কমাবে। এখানে একটা কথা উঠে থাকে— যে রাজ্যগুলিতে মাথাপিছু আয় কম, সেখানে জনপরিষেবা প্রদানের গড় খরচও কম। অর্থাৎ, কেরলে কোনও জনপরিষেবা দিতে সরকারকে যে টাকা খরচ করতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে খরচ হয় তার চেয়ে কম। কথাটি যদি সত্যিও হয়, তবু এই ফারাক কতখানি? চতুর্দশ অর্থ কমিশন যে বণ্টন করেছিল, তাতে কেরলে মাথাপিছু কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি। জনপরিষেবা প্রদানের খরচ নিশ্চয়ই এতটা বেশি হতে পারে না।
দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজের অধ্যক্ষ পঙ্কজ রায় বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ তো চলছে কেন্দ্রের টাকায়! এ বারের রাজ্য বাজেটের হিসেব দেখাচ্ছে নিজস্ব সংগৃহিত অর্থের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সেখানে জিএসটি-সহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর-বাবদ কেন্দ্র রাজ্যকে দিচ্ছে ১ লক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার আইন বাম সরকার রূপায়ণ করতে না পারলেও তার মান্যতা দিয়েছিল। তৃণমূল সরকার তো এর ধার ধারেনি। মূলধন সৃষ্টি এবং রাজস্ব আদায়ের ভারসাম্য রক্ষায় এ রাজ্যের চরম ব্যর্থতা স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চিত করবে রাজ্যের প্রাপ্তিকে। এটা সর্বভারতীয় সূত্র। এর মধ্যে রাজনীতি কোথায়?“
ডঃ বিশ্বজিৎ নাগ বলেন, “আমার মনে হয়, অর্থ কমিশনের বরাদ্দের ব্যাপারে গরিব রাজ্যগুলোকে একটু সুযোগ দেওয়া উচিত। পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, আয় কম। ভারতের কম আয়ের রাজ্যগুলোর অন্যতম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের বাজেট সেভাবেই করার চেষ্টা করছেন। আয়ব্যায়ের ঘাটতির পরিমাণটাকেও অর্থ কমিশনের মূল্যায়ণের অন্যতম মাপকাঠি করা উচিত। এর সঙ্গে ২০০৩ সালের ফিনান্সিয়াল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) আইনের রূপায়ণটাও দেখা দরকার। এই আইনে আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, রাজস্ব ঘাটতি হ্রাস, ম্যাক্রোইকোনমিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রভৃতির দিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে। রাজ্যগুলোকে কেবল রাজনৈতিক বৈষম্যের অভিযোগ না এনে এদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে।“
অশোক সেনগুপ্ত