ধর্ম এবং সমাজ সংস্কারক ও বঙ্গসাহিত্যের প্রাণদাতা শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু (জন্মঃ- ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৪৮৬ – তিরোধানঃ- ১৪ জুন, ১৫৩৩)

এখনও অবধি প্রচলিত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী শ্রীচৈতন্যের মৃত্যু রহস্যাবৃত। তাঁর জীবনচরিতাবলীর মধ্যে জয়ানন্দর ” চৈতন্যমঙ্গল” ছাড়া আর কোথাও তাঁর মৃত্যুর বাস্তবানুগ বর্ণনা নেই। সেই হিসাবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে দু ধরনের যে বিবরণ আমরা পাই তা হল:
১) অলৌকিক ও আবেগজাত বর্ণনা যেখানে বাস্তবতার ধার না ধেরে বলা হল, তিনি নামসংকীর্তন করতে করতে সমুদ্রে বা জগন্নাথ বিগ্রহে লীন হয়ে গিয়েছিলেন,
২) ১৫৩৩ সালে রথযাত্রার দিন নামকীর্তনে বিভোর শ্রীচৈতন্য পথ চলাকালীন বাঁ পায়ে ইঁটের আঘাত পান এবং পরবর্তীতে সেই ঘা বিষাক্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটায়। এই দ্বিতীয় মতটি ছিল জয়ানন্দর। এক দিব্যপুরুষের এমন মানবোচিত মৃত্যু বৈষ্ণবসমাজ মেনে নিতে না পারায় তার গ্রন্থখানি নিন্দিত তথা অপাঠ্য বলে দেগে দেওয়া হয়।

১৯৯০-এ ভুবনেশ্বরবাসী বিষ্ণুপদ পাণ্ডার ভূমিকা ও অনুবাদে ” শ্রীচৈতন্যের দিব্যজীবন ও অজ্ঞাত তিরোধানপর্ব “-নামে একটি অমূল্য গ্রন্থ নজরে আসে। সেখানে জানা যায়, ভুবনেশ্বরের পুঁথিশালায় চৈতন্যজীবনীর দুটি পুঁথির খোঁজ মিলেছে। একটি ” চৈতন্যবিলাস ” ও অপরটি ” বৈষ্ণব লীলামৃত “। ওড়িয়া ভাষায় রচিত এর রচনাকার বৈষ্ণব ভক্ত কবি মাধব পট্টনায়ক। –এই বই থেকেই জানা যায়, শুধু জয়ানন্দ নয়, ইঁটের আঘাতজনিত চৈতন্যর মৃত্যুসম্পর্কিত বিবরণ মাধব পট্টনায়কের বইতেও আছে। আরও কৌতূহলের বিষয় হল, শ্রী পট্টনায়ক এখানেই থামেননি। অর্থাৎ আঘাতজনিত ক্ষতসৃষ্টি, তা বিষাক্ত হওয়া, সে কারণে তাঁর শরীরের তাপবৃদ্ধি ও ফলস্বরূপ মৃত্যুবরণ এবং এরও পরে জগন্নাথদেবের মন্দিরের উত্তরদিকের প্রবেশপথের বাঁদিকে এক গর্ভগৃহে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল–এ সমস্ত বর্ণনাই সেখানে আছে।
মাধব পট্টনায়ক তার বর্ণনায় বলছেন, ১৫৩৩ সালের অক্ষয় তৃতীয়ার দুদিন আগে নৃত্যরত অবস্থায় কীর্তন করাকালীন শ্রীচৈতন্য আঘাত পেয়ে মূর্ছা যান। সঙ্গীরা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে জগন্নাথ মন্দিরের উত্তরদিকের মণ্ডপে শুইয়ে দেন। সেখানে সর্বদা তাঁর সেবায় নিযুক্ত ছিলেন জগন্নাথ দাস। মন্দিরের মধ্যেই এই শুশ্রূষা কাজ চললেও তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন না আর, অক্ষয়তৃতীয়ার দিনেই দেহত্যাগ করেন।

এই খবর পেয়ে যিনি প্রথমে আসেন তিনি রায় রামানন্দ এবং তিনি এসেই মন্দিরের সমস্ত দরজা বন্ধ করতে হুকুম দেন, পূজাকাজ স্থগিত রাখতে নির্দেশ দেন আর একটি চিঠি লিখে অশ্বারোহী মারফত রাজা প্রতাপ রুদ্রের কাছে খবর পাঠান। রাজা সম্ভবত তখন কটকে ছিলেন এবং অক্ষয়তৃতীয়ার চন্দনযাত্রা দর্শনের জন্য পুরী অভিমুখে আসছিলেন। পথমাঝেই তিনি এই চিঠি পান আর সোজা মন্দিরে চলে আসেন।

এরপর রায় রামানন্দ প্রস্তাব দেন, শ্রীচৈতন্যর মৃতদেহ মন্দিরের বাইরে না নিয়ে গিয়ে ‘ কোইলী বৈকুণ্ঠে ‘ সমাধিস্থ করতে। এর কারণস্বরূপ তিনি রাজাকে যা বলেছিলেন তা নিম্নরূপ :

১) শ্রীচৈতন্যর মৃত্যুর কারণ জানাজানি হলে বঙ্গীয় ভক্তরা সত্যমিথ্যা নানা প্রচার চালাতে পারে।
২) সেইসব ভক্তরা তাদের মহাপ্রভুর হত্যার কথা বলে বাংলার মুসলমান শাসককে উত্তেজিত করে ওডিশা আক্রমণে প্ররোচিত করতে পারে।
৩) তা ছাড়া প্রভু যখন মন্দিরেই দেহরক্ষা করেছেন তখন যেখানে দেববিগ্রহসমূহের জীর্ণমূর্তি সমাহিত করা হয়, সেখানেই প্রভুর মরদেহ সমাধিস্থ করে ” তিনি জগন্নাথ দেববিগ্রহে লীন হয়ে গিয়েছেন ” – এই ঘোষণা দিয়ে মৃত্যুর আসল কারণ তথা সমাধিস্থান গোপন রাখা হবে।
৪) আর আগামী রথযাত্রার সময় রাজা প্রতাপ রুদ্রও জনসমক্ষে ঘোষণা করবেন, প্রভু শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীজগন্নাথদেবের দারুবিগ্রহে লীন হয়ে গিয়েছেন।
এমন যুক্তিজালে আটকে পড়ে শোকার্ত জগন্নাথ দাস চুপ থাকতে বাধ্য হন আর রাজা অধোবদনে সম্মতি জানান। এরপর কথামতো দুজন উপস্থিত সেবকের সাহায্যে গোপন কাজ সমাধা হয়।
……….

……….

শ্রীচৈতন্যদেবের পিতা জগন্নাথ মিশ্রর জন্ম হয়েছিল সিলেটে। তরুন বয়েসে নদীয়ায় পড়তে এলেন জগন্নাথ মিশ্র। সে কালে নদীয়াই ছিল অন্যতম জ্ঞানতীর্থ। সম্ভবত কোনও পন্ডিতের মেয়ে ছিলেন শচীদেবী। বিয়ে হল। চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার রাত্রে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার নবদ্বীপে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম। চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশার জাজপুরের আদি বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন।

চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত। তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি ছিল অবিসংবাদিত। জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছেলেবেলা থেকেই বজায় ছিল, তা জানা যায় তাঁর জীবনের নানা কাহিনি থেকে। কিন্তু তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ ও জ্ঞানার্জন। পিতার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ডদান করতে গিয়ে নিমাই তাঁর গুরু ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বর পুরীর নিকট তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর পণ্ডিত থেকে ভক্ত রূপে তাঁর অপ্রত্যাশিত মন পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্য হয়ে যান। অনতিবিলম্বে নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।
কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর নিমাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। এই সময় তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে। ওড়িশার সূর্যবংশীয় হিন্দু সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্য মহাপ্রভুকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। ভক্তদের মতে, জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।

গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ছিলেন ভাগবত পুরাণ ও ভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করেন এবং হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন। সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাষ্টক নামক প্রসিদ্ধ স্তোত্রটিও তাঁরই রচনা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুসারে, ভাগবত পুরাণের শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে রাধারানির ভাবকান্তি সংবলিত শ্রীকৃষ্ণের চৈতন্য রূপে অবতার গ্রহণের কথা বর্ণিত হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী সাহিত্য বাংলা সন্তজীবনী ধারায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল। সেযুগে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্য চরিতামৃত, বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের চৈতন্য ভাগবত, এবং লোচন দাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল ।
……….

লালনের গান-

তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে ।।
একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে
ধূলার মাঝে ।।
একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি
বুঝবি শেষে ।।
পাগলের নামটি এমন
বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে
চৈতে নিতে অদ্বৈ পাগল
নাম ধরে সে ।।
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে….. !!
……………………
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা (https://www.facebook.com/pratapcsaha)। ধন্যবাদ।
……….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.