এত্ত টাকা মাইনে! অবাক চন্দনা ভেবেই পাচ্ছেন না বিধায়ক বেতনে কী কী করবেন

সব অর্থেই নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসার চালান চন্দনা বাউড়ি। এখন তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য। ভোটে জেতার পরে শপথ নিতে এসেছিলেন বিধানসভায়। সেটাই প্রথম বার বিধানসভা দেখা। এখনও পর্যন্ত সেটাই শেষ বার। শপথ নেওয়ার সময় থেকেই তো করোনার বাড়াবাড়ি আর রাজ্যে লকডাউন পরিস্থিতি। তাই আর আসাই হয়নি। ফলে এখনও পর্যন্ত বিধায়ক হিসেবে প্রাপ্য বেতন পাননি। জানেনও না প্রতি মাসে ঠিক কত টাকা বেতন বা ভাতা বাবদ পাবেন। সেই অঙ্কটা শোনার পরে চন্দনার গলায় আবার অন্য ভাবনা। এত টাকা কী করে খরচ করবেন সেটাই ভেবে উঠতে পারছেন না। তবে মনের কথাটা বলেই ফেললেন, ‘‘কী করব এখনও ভাবতে পারছি না। কিন্তু মানুষের জন্য ভাল হয় এমন কিছুই করব প্রথম মাইনের টাকায়। তার পরেও মাইনের টাকা ওই কাজেই লাগাব। অত টাকা তো আমাদের লাগবে না।’’
বাঁকুড়া জেলার শালতোড়া বিধানসভা এলাকার প্রায় গোটাটাই গ্রাম। তার মধ্যে আবার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের যে গ্রামে চন্দনার বাড়ি সেই কেলাইয়ে একেবারেই নিম্নবিত্তদের বাস। কাছাকাছি শহর বলতে বাঁকুড়া, ৩২ কিলোমিটার দূরে। তবে চন্দনার দৌলতেই কেলাই গ্রাম এখন বিখ্যাত। রাজ্যের দরিদ্র বিধায়কদের অন্যতম তিনি। প্রার্থী হওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা তিনি জমা দিয়েছিলেন তাতে ৩২ হাজার টাকার মতো নগদ ছাড়া আর কিছুই সম্পত্তি নেই বলে জানিয়েছিলেন চন্দনা। শপথ নিতে এসে বিধানসভা সচিবালয় থেকে জানতে পেরেছিলেন, ১৫ মে-র পরে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। নিময় অনুযায়ী কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট শাখাতেই বিধায়কদের বেতন-অ্যাকাউন্ট হয়। কিন্তু লকডাউন চালু হয়ে যাওয়ায় চন্দনার আর কলকাতায় আসাই হয়নি।

টেলিফোনে কথার মধ্যেই চন্দনা জানালেন কত টাকা বেতন পাবেন সেটাই তিনি জানেন না। নিজেই প্রশ্ন করলেন, ‘‘কত টাকা মাইনে পাব?’’ সে কী! আপনি এখনও জানেন না? চন্দনার জবাব, ‘‘কোনও দিন এমএলএ হব তা তো ভাবিইনি। মোদীজির স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচিতে প্রথম বিজেপি অফিসে গিয়েছিলাম। তার পর থেকেই পার্টির হয়ে কাজ করছি। আমায় প্রার্থী করা হবে ভাবিইনি। সবাই চেষ্টা করেছে বলে আমি জিতে গেছি।’’ আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছেই তিনি জানলেন, বেতন ও বিভিন্ন ভাতা বাবদ পশ্চিমবঙ্গে এক জন বিধায়ক মাসে মোটামুটি ৮২ হাজার টাকা পান। জুন মাসের মধ্যে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়ে গেলে যে দিন শপথ নিয়েছেন সে দিন থেকে হিসেব করে গোটা টাকাটা জুলাইয়ের শুরুতে পাবেন। সেটা এক লাখ টাকার বেশিই হবে। শুনেই চন্দনার অবাক গলায় প্রশ্ন, ‘‘অত্ত টাকা মাইনে পাব?’’


টাকাটা ‘অত্ত’টাই বটে চন্দনার কাছে। রাজমিস্ত্রি স্বামী শ্রবণ দৈনিক ৪০০ টাকার মজুরিতে কাজ করেন। চন্দনাও স্বামীর সঙ্গে জোগাড়ের কাজ করেছেন এত দিন। তাঁর দৈনিক মজুরি ২৫০ টাকার মতো। সরকারি ১০০ দিনের কাজও করেছেন। বিধায়ক হিসেবে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে কী করবেন? প্রশ্ন শুনে অনেক ক্ষণ চুপ করে রইলেন চন্দনা। উত্তরের বদলে পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কী করা যায় বলুন তো?’’ আপনার তো গাড়ি নেই একটা কিনবেন নাকি! ‘‘না, তার অনেক দাম। আর আমার দরকারও নেই। যেখানে যাই আমার স্বামী মোটর সাইকেলে করে নিয়ে যান। আমার নিরাপত্তারক্ষীরা কার্যকর্তাদের বাইকে যান।’’


সদ্যই চার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান পেয়েছেন চন্দনা। সেই সঙ্গে এক জন রাজ্য পুলিশের কর্মী তিনি প্রার্থী হওয়ার সময় থেকেই রয়েছেন। তাঁদের নিয়ে সংসার এখন বেশ বড়। কাছেই একটি নির্মীয়মাণ বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। সেই বাড়িটায় আবার জানলা, দরজা ছিল না। তবে তার ব্যবস্থাও হয়ে যায়। ভোটের আগেই নিজেদের জন্য দুটো জানলা আর একটা দরজা কিনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকায় পাওয়া বাড়িতে লাগাবেন বলে। কিন্তু আচমকা দরকার পড়ায় সেগুলোই সিমেন্ট বালি দিয়ে জওয়ানদের ঘরে লাগিয়ে দিয়েছেন চন্দনার রাজমিস্ত্রি স্বামী। চন্দনাও তো প্রথম ক’দিন শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে রেঁধে খাইয়েছেন জওয়ানদের। এখন অবশ্য ওঁরাই নিজেদেরটুকু রেঁধে নেন।


বাড়িতে টিভি নেই। তিনি যে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন সেটা তাই লোকমুখে শুনতে হয়েছিল। এর পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বক্তৃতায় তাঁর নাম বলেছেন। এ বার একটা টিভি কিনবেন তো? আপনাকে যখন টিভিতে দেখায়, বাড়ির সবার সঙ্গে বসে দেখতে ইচ্ছে করে না? একটুও না ভেবে চন্দনার জবাব, ‘‘ভোটের আগে একটা মোবাইল ফোন কিনেছি। তাতেই তো টিভি দেখা যায়। ওতেই খবর দেখি।’’ এ বার পাল্টা প্রশ্ন চন্দনার— ‘‘আচ্ছা, মানুষের জন্য যদি ভাল কিছু করতে চাই, তবে কী কী করা যায় বলুন না।’’ একটা অ্যাম্বুল্যান্স কিনতে পারেন। গরিব মানুষের কাজে লাগবে। চন্দনার প্রশ্ন, ‘‘সে তো অনেক দাম। এখনই কি কেনা যাবে?’’ হ্যাঁ, ‘কার লোন’ নিয়ে কিনে নিতে পারেন। মাসে মাসে ‘ইএমআই’ দিয়ে দেবেন। চুপ চন্দনা। বোঝা গেল একসঙ্গে অনেকগুলো অচেনা শব্দ শুনেই মৌন তিনি। তার পরে বললেন, ‘‘আমাদের এমপি ডাক্তারবাবুকে (সুভাষ সরকার) বরং জিজ্ঞেস করব।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.