মুন্ডা প্রথা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার জন্ম হওয়ায় বাবা-মা ছেলের নাম রাখলেন বিরসা। চরম দারিদ্র পরিবারটির চিরসঙ্গী। কাজ আর বর্গা জমির পিছনে ঘুরুতে ঘুরতে তাঁরা অধুনা ঝাড়খন্ডের উলিহাটু থেকে কুরুম্বা, ফের নড়ন তারপর বোম্বা…গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়াত। পরবর্তীতে হত দরিদ্র পরিবারটি থিতু হয় চাকলাদ গ্রামে। তবে বাবা-মার দারিদ্র্যের বোঝা একটু হালকা করতে বিরসাকে ছোটবেলাতেই যেতে হয় মামারবাড়ি আইয়ুভাতি গ্রামে।
আর পাঁচটা মুন্ডা ছেলের মতোই বিরসাও সকাল বেলা বেড়িয়ে পড়ত ছাগল-ভেড়ার দল নিয়ে। বনে জঙ্গলে তাদের চড়িয়ে আর দস্যিপনা করেই দিন কাটত। এভাবেই চলল বেশ কিছুদিন। একটা সময় সুর ভড় করল বিরসাকে। কখনো একতারা, কখনো মোহন বাঁশি নিয়ে সুর ধরার চেষ্টা চালায় সে। কিন্তু দরিদ্র বালক খুব বেশি আর এগোতে পারে না।
কয়েকদিন লেখাপড়ার টানে দেশি স্কুলে যাতায়াত শুরু করে বিরসা। তারপর একদিন ভর্তি হয় জার্মান মিশনারি স্কুলে। তবে স্কুল শর্ত দিয়েছিল বিরসাকে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হবে। এই ফাঁদ তখন পাতাই থাকত। আরও অনেকের মতো বিরসাকেও সেই ফাঁদে পড়তে হয়। বিরসা একা হলে হবে না গোটা পরিবারকেই খ্রিষ্টধর্মে ধরমান্তরিত হতে হয়। বিরসা মুন্ডা হয়ে যান বিরসা ডেভিড বিরসা দাউদ। তবে নিজের জাত কিংবা ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা অন্তরে যে রয়েই গেছিল তা বোঝা গেল যেদিন মিশনারি স্কুলের এক শিক্ষক যেদিন মুন্ডাদের নিয়ে একনাগাড়ে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছিলেন বিরসা সেদিন মুখে কিছু বলতে না পারলেও প্রতিবাদে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে চলে যান।
বিরসার মতো একজন সাধারণ মানুষের ভিতরে একজন অসাধারণ বোধসম্পন্ন মানুষ ছিল যে বিরসাকে তাড়া করত। যে কোনও অন্যায়-অবিচার-অসাম্যের বিরুদ্ধে বিরসা অস্থির হয়ে উঠত। স্কুলে পড়ার সময়েই বিরসা সরদারি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে সরদারদের আন্দোলনের প্রতি মিশনারিদের মৃদু সমর্থন ছিল কিন্তু পরবর্তীতে আর সেই সহানুভূতিটুকুও ছিল না। তাছাড়া বিরাট সংখ্যক অ-খ্রিস্টান মুন্ডা সরদারি আন্দোলনে যুক্ত থাকায় মিশনারিদের মধ্যেও বিদ্বেষ তৈরি হয়।
মিশনারিরা প্রথমে বিরসাকে সরদারদের আন্দোলন থেকে সরে আসার কথা জানায়। এরপর তারা প্রবল চাপ দিতে থাকলে বিরসা বোঝে মিশনারিদের সঙ্গে আর কোনওরকম সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। ফলে বিরসা নিজে মশনারি স্কুল ছাড়েন এবং সপরিবারে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করেন। তবে সরদারি আন্দোলন থেকে বিরসা একদিন সরে আসেন। ব্যক্তিগত অভিঙ্গতা দিয়ে বিরসা বুঝেছিলেন শুধুমাত্র দিকুরাই আদিবাসী মানুষের দুর্দশার একমাত্র কারণ নয়। একদিকে বিদেশি সরকার তথা প্রশাসন অন্যদিকে মিশনারি আর তাদের সঙ্গে দিকুরা আদিবাসী মানুষোদের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে।
যে বন আর ভূমির ওপর আদিবাসী মানুষদের জন্মগত অধিকার বিদেশি সরকার তা কেড়ে নিয়ে তাদের নিঃস্ব করেছে। অন্যদিকে আদবাসীদের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে মিশনারিরা তাদের ধর্মান্তরিত করে। এর ওপর আছে দিকুদের অত্যাচার। নিজদের বনভূমে পরবাসী আদিবাসীরা যে তাদের হাজার বছরের ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন; এ কথা মাত্র ২০ বছরের তরুণ বিরসা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। কেবল তাই নয় তিনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন।
বিরসার ধর্ম, হাজার হাজার মুন্ডাদের মুখে ধরতি আবা বা জগত পিতা বিরসার জয়ধ্বনি শুনে ব্রিটিশরা আগে ভাগেই বিদ্রোহের আঁচ অনুভব করল। তাঁরা বুঝতে পারল; যেভাবেই হোক বিরসাকে জব্দ করতে হবে। তাঁর নেতৃত্বেই আদিবাসী মানুষদের মধ্যে নতুন করে বন আর ভূমি নিয়ে অধিকার বোধ দানা বাঁধছে। কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার পুরনো বন আইঙ্কে ছোটনাগপুর জঙ্গলে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিল।
এই খবর মুন্ডাদের মধ্যে ছড়িয়ে যেতেই তাঁরা বিরসার নেতৃত্বে ফুঁসে ওঠে। পাহাড় আর জঙ্গলের ওঁরাও, মুন্ডা-সহ আদিবাসীরা বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। এরকমই একটা সময়ের অপেক্ষা করছিল ব্রিটিশ সরকার। উসকানি আর বিদ্রোহে মদত দেওয়ার অভিযোগে তাঁরা বিরসাকে বন্দি করে দু’বছর আটকে রাখে। তবে থিতিয়ে যায় না সেই বিদ্রোহ। জেল থেকে বেরিয়ে বিরসা ফের মুন্ডা ও অন্যান্য আদিবাসীদের নিয়ে ঝাপিয়ে পরে উলগুলান বা স্বাধীনতা যুদ্ধে। ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে বিরসার যুদ্ধ সেদিন পরাজিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আদিবাসীদের মনে বিরসাই বন আর ভূমির অধিকার বোধ জাগিয়ে দিয়েছিল। সেই অধিকার কি তাঁরা স্বাধীন দেশেও পেয়েছে? এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এখনও খাদ্য আর শিক্ষা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়।