ভোগের জগৎ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, চৈতন্যের জগৎ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। চৈতন্যবিজ্ঞানের মতো মূল্যবান বিষয়ের স্বরূপসন্ধান পাচ্ছি না। এই যে অচৈতন্য অবস্থা, এই অচেনা ভারতবর্ষের সূচনা বৈদেশিক মুসলমান আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে। তা ভারতীয় সমাজের কোণে কোণে, প্রত্যন্ত অঞ্চলকে আবিষ্ট করে ফেললো। ভারতবর্ষ হয়ে উঠলো মৃতবৎ। তার প্রাণস্পন্দন নেই। একজন রোগী যখন সংজ্ঞাহীন মৃতবৎ হয়ে পড়ে, কোমায় চলে যায়, মেডিক্যাল সায়েন্সে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। একইভাবে স্পিরিচুয়াল হাসপাতাল তৈরি করলেন শ্রীচৈতন্য। ভারতবাসীর মধ্যে সত্যিকারের চৈতন্য-বিকাশ ঘটালেন মহাপ্রভু। প্রায় পাঁচশো বছরের মতো সময়ের অসুস্থতা নিরাময়ের চেষ্টা করলেন তিনি। ১৪৮৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপে আবির্ভূত হলেন সেই ডাক্তার। ১৫১০ সালের ১০ জানুয়ারি তার ডাক্তারি পাশ করা হলো কাটোয়াতে। কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা নিলেন এযুগের ব্রজেন্দ্র নন্দন। নাম হলো ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’। অর্থাৎ তিনি দেশবাসীর চৈতন্য এনে দেবেন। এনে দিলেন তার পরিব্রাজন পর্বে (১৫১০-১৫১৫) এবং নীলাচল পর্বে (১৫১৫-১৫৩৩); তার শুভঙ্করী প্রভাব অব্যাহত রইলো। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের ব্যবধান; আজ থেকে ১৩২ বছর আগে চৈতন্য বিজ্ঞানের আসরে অবতীর্ণ হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তিনি কল্পতরু হলেন, বললেন, “চৈতন্য হোক’, জীবনের পরম-প্রাপ্তি ঘটুক। মনে পড়বে শাক্ত-সংগীত, ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী’।

দৃশ্যজগৎ অতি বিচিত্র, বহুরূপী। ভারতীয় সাধকেরা অব্যক্ত জগতের সীমাহীন রহস্যও দৃষ্টিগোচর করেছেন; বিভিন্নতার মধ্যে যে শাশ্বত সাম্য আছে তা বোধগম্য করেছেন। ১৯১৭, বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভাষণ দিচ্ছেন, ‘ভারতীয় চিন্তাপ্রণালী একতার সন্ধানে ছুটিয়া জড়, উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে সেতু বাঁধিয়াছে।.. বিধাতা যদি বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ তীর্থ ভারতীয় সাধকের জন্য নির্দেশ করিয়া থাকেন, তবে এই চতুর্বেণী (পদার্থবিদ্যা উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ও মনস্তত্ত্ববিদ্যা) সংগমেই সেই মহাতীর্থ।” বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এক অখণ্ড চৈতন্যের পুনরাবিষ্কার করলেন জগদীশচন্দ্র। জগদীশচন্দ্র (১৮৯৪) বলছেন, “এ জগতে অসংখ্য ঘটনাবলীর মূলে তিনটি কারণ বিদ্যমান। প্রথম পদার্থ, দ্বিতীয় শক্তি, তৃতীয় ব্যোম অথবা আকাশ।” ভর-শক্তি-মহাশূন্যতা। পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় যে সমীকরণ— স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটির বিখ্যাত পেপারে আইনস্টাইন দেখালেন—E=mc2 ভর ও শক্তির সাম্যতা; ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র; শক্তির পরিমাণ = বস্তুর ভর X আলোর বেগের বর্গ। শক্তি এবং ভর সমতুল্য এবং পারস্পরিক পরিবর্তনযোগ্য। আপেক্ষিকতাবাদের জনক তিনি, আলবার্ট আইনস্টাইন।

হিন্দুশাস্ত্রে আমরা জেনেছি, আত্মা অবিনশ্বর, তার সৃষ্টি নেই, ধ্বংস নেই, তাকে তরবারিতে খণ্ডন করা যায় না, আগুন তাকে পোড়াতে পারে না, জল তাকে ভেজাতে পারে না, বাতাস তাকে শুষ্ক করতে পারে না।

“নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদন্ত্যায়াপো ন শোষয়তি মারুতঃ।” জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। পরমাত্মার জীবাত্মায় রূপান্তর ঘটে।

পরমাত্মা থেকে জীবাত্মা সৃষ্টি হয়, জীবাত্মা পুনরায় পরমাত্মায় বিলীন হয়। পরমাত্মা ও জীবাত্মার অনুপাত ধ্রুব বা কনস্টান্ট। এই পরমাত্মাকে যে যেভাবে খুশি মানতে পারেন; ‘যত মত তত পথ’। স্বামীজীর মতো বলতে পারেন ‘বড়ো আমি’, রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে পারেন ‘পাকা আমি’, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মমত অনুযায়ী তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। শুদ্ধ আস্বাদন ভগবানই অনন্ত শক্তির অতি প্রকাশ। নির্বিশেষবাদীদের কাছে পরমব্রহ্ম। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম অনুসারে পরমাত্মার প্রতীক শ্রীকৃষ্ণ এবং জীবাত্মার প্রতীক শ্রীরাধিকা। যত লীলা-কীর্তন গ্রন্থ আছে সেখানে রাধাপ্রেমকে বড়ো দেখানো হয়েছে, রাধার প্রেম বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণের প্রেম কমই বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণ হলেন প্রেম দেবার সত্ত্বা, দাতা; রাধা হলেন প্রেম নেবার সত্তা, গ্রহীতা। আইনস্টাইনের সূত্রানুযায়ী E-কে যদি M-এর সমান হতে হয় তবে একটা c2 থাকতে হবে। এই c2-টিই হলো ইমোশন— কোথাও ভগবৎ প্রেম, কোথাও ভগবৎ-সেবা, কোথাও কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ইত্যাদি। জীবাত্মা বা ভর (mass)-এর প্রতীক শ্রীরাধিকায় কৃষ্ণপ্রেমের মতো ইমোশন যুক্ত হলেই তিনি পরমাত্মা বা শ্রীকৃষ্ণে মিলিত হতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন Energy, শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। ভগবান এ বিশ্বের নিয়ন্ত্রক, কোনো ইমোশন নেই। জগদীশচন্দ্র লিখছেন, “প্রকৃতিও কি ক্রূর নয় ?… যাঁহার ইচ্ছায় অনন্ত বারিধি বাত্যতাড়নে ক্ষুব্ধ হয়, কেবল তাহার অজ্ঞাতেই জলধি শান্তিময়ী মূর্তি ধারণ করে।”

যখন শ্রীচৈতন্যদেব প্রকট হলেন—অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ, তিনিও ভর-শক্তিতত্ত্ব, জীবাত্মা-পরমাত্মার তত্ত্ব নিজের জীবনেই অনুশীলন করলেন—এ এক অনুপম চৈতন্য বিজ্ঞানের কথা। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যখন দলে দলে মুসলমান ধর্মগ্রহণে তৎপর হয়েছে, তখন বর্ণহীন এক সমাজ তৈরির জন্য এক ধর্মীয়-সাম্যের বাণী বিতরণ করে, আচণ্ডালে হরিভক্তি প্রচার করে দক্ষ সমাজবিজ্ঞানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.