মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আর্জি, অভিজ্ঞরা কী বলছেন

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে অজস্র মতামত এসেছে নবান্নে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে। রবিবার রাজ্যের মানুষের কাছে আপনাদের মতামত দিন—
এই আর্জি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর প্রেক্ষিতে অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাকর্মীদের অনেকে এই প্রতিবেদকের কাছেও জানিয়েছেন তাঁদের প্রাসঙ্গিক মতামত।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ উপাচার্য
সিদ্ধার্থ দত্ত জানিয়েছেন, “মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অবশ্যই নেওয়া উচিত। এটা শুধু ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে নয়, এতদিন ধরে প্রস্তুতি নেওয়ার পর পরীক্ষা না হলে অনেক ছাত্রছাত্রী মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে পারে এবং সে ক্ষেত্রে ক্ষতির প্রভাব সুদূর প্রসারী হতে বাধ্য। তবে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে পরীক্ষা কিছু দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করাটা উচিত কাজ হবে না। দুই/ তিন মাস পরে পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতেই পারে। এই সময় কালের মধ্যে সমস্ত পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের টিকাকরণ কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যেটুকু সময় শিক্ষাবর্ষের ক্ষতি হবে সেটা সমগ্র শিক্ষক সমাজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পূরন করা সম্ভব হবে। সর্বভারতীয় পরীক্ষা পাশ করার পর ভর্তির ক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে ছাত্রছাত্রীরা যাতে ভর্তি হতে পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্ন পত্রের ধরন, পরীক্ষা গ্রহণের সময় ইত্যাদি ব্যাপারে শিক্ষকদের মতামত গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারা যাবে বলে আমার বিশ্বাস।“

অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক তথা প্রাক্তন সাংসদ অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর জানান, “১) পরীক্ষা বাতিল না করে অবশ্যই নিতে হবে। ২) সমস্ত রকম কোভিড প্রোটোকল মেনে হোম সেন্টারে অফলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ৩) একই প্রশ্নপত্রে ৫০% উত্তর করতে হবে, ফলাফল ১০০ শতাংশর ওপর প্রকাশ করতে হবে। হোম সেন্টারে পরীক্ষা হবে।
করোনার কথা ভেবে টিকাকরণ সম্পন্ন করে পরীক্ষা নেওয়া উচিত। পরীক্ষা হলে সমস্ত কোভিড সংক্রান্ত বিধি ও সাবধানতা মানাটা কঠোরভাবে দেখতে হবে।“

পঞ্চ সায়র শিক্ষা নিকেতন সহ প্রধান শিক্ষিকা সুপর্ণা চক্রবর্তী এই প্রতিবেদককে জানান, “অতিমারী পরিস্থিতিতে পর্ষদের পরীক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারা বিশ্ব জুড়ে যে ভয়াবহ অতিমারী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা এক চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি এসে হাজির হয়েছে। এমতাবস্থায় সরকার পরীক্ষা নিয়ে অনেকের সঙ্গে অভিভাবকদেরও মত চেয়েছে। উদ্যোগটি অভিনব। কিন্তু যাঁরা প্রতিনিয়ত এই শিখন ব্যবস্থার সঙ্গে ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে জড়িত সেই শিক্ষক শিক্ষিকাদের মতামত চাওয়া হয় নি। এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সহ প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে আমি মনে করি যে ,বর্তমান পরিস্থিতিতে দশম শ্রেণীর পরীক্ষা (মাধ্যমিক) না নেওয়াই বিধেয়। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে দেড় ঘণ্টার একটি পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতেই পারে।আমরা ডিসেম্বর মাসে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রচুর ছাত্র ছাত্রীর বার্ষিক পরীক্ষা ‘সিট আলোটমেন্ট‘ করে একই সঙ্গে নিয়ে থাকি। সেখানে কেবলমাত্র দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছাত্রী দের ‘কোভিড বিধি’ মেনে প্রতিটি ঘরে স্বল্প সংখ্যক ছাত্র ছাত্রীকে বসিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া খুব অসম্ভব নয়। সি.বি.এস.ই কিংবা আই.এস .সি বোর্ডের সারা বছরের পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যেই একটি অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। আমাদের বোর্ডে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে একেবারে কোনও পরীক্ষা না হওয়াটা ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যতের পক্ষে কতটা ফলবান হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।“

পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু বিষয়ী এই প্রতিবেদককে জানান, “করোনার বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণ লড়াই করছেন। শিক্ষকদেরও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ও আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার এলাকায় কোভিড আক্রান্তদের পাশে খাদ্য নিরাপত্তা ও কোভিড প্রতিরোধী সামগ্রী বন্টন নিশ্চিত করতে এগিয়ে এসেছি। নিজে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে পুনরায় আক্রান্তদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছি। এই পরিস্থতিতে অফলাইন পরীক্ষা নেওয়া কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেটা সবাই বুঝতে পারছেন। যদি কেউ কোভিড আক্রান্ত হয় তবে তার থেকে অনেকের ছড়াবে, সবার বাড়িতে অনেক বয়স্ক সদস্য আছেন তাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে। বিশ্বব্যাপী কোভিডের কারনে স্কুল নির্বিঘ্নে ও নিয়মিতভাবে করানো সম্ভব হয়নি এবং তৃতীয় ওয়েভ আসার সম্ভাবনা নির্মূল করতে পরীক্ষা নেওয়া আদৌ কতটা বিজ্ঞান সম্মতভাবে যুক্তিগ্রাহ্য হবে সে সম্পর্কে মানুষ সন্দিহান। এক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে মতামত জানতে চাওয়া যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছি। আবার অন্যদিকে ২১ লক্ষ পরীক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন সম্পন্ন হয়নি কেন্দ্রের পরিকল্পনাহীনতার জন্য। পরীক্ষার থেকে জীবনের মূল্য অধিকতর বেশি।“

একটি নামী স্কুলের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ সুব্রত সেনের মতে, “এই সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে খাতায়-কলমে পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক। পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য আর করোনার নিরাপত্তা সবার আগে। এখনকার মত মিউটেন্ট স্ট্রেন ১৬/১৭ বছর বয়সটা বিপজ্জনক। তাই ঝুঁকি নেওয়ার কোনও দরকার নেই। নম্বর দেওয়ার বিজ্ঞানসম্মত অনেক পথ আজকাল হয়েছে। যা দিয়ে পড়ুয়াদের মূল্যায়ণ সম্ভব। পার্সেন্টাইল ডিভিশনে ফল প্রকাশ করলে কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে একটা মাপকাঠি থাকবে। পড়ুয়াদের সঠিক মূল্যায়ণের জন্য নম্বর দেওয়ার ব্যাপারটা যথেষ্ঠ সতর্ক ও সঠিকভাবে করতে হবে। সিবিএসই মূল্যায়ণ পদ্ধতি যথেষ্ঠ বিজ্ঞানসম্মত। এ ব্যাপারে রাজ্যের পর্ষদ তাদের সাহায্য নিতে পারে।“

‘শিক্ষাবন্ধু ঐক্য মঞ্চ’-র রাজ‍্য সম্পাদক বিভূতি ভূষণ মন্ডল এই প্রতিবেদককে বলেন, “মাধ‍্যমিক ও উচ্চমাধ‍্যমিক পরীক্ষা অবশ‍্যই হওয়া দরকার। এটা করোনা নিয়ম মেনে এবং ছাত্র ও অভিভাবক উভয়কে দুটি টীকা নিয়ে অবশ‍্যই পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে হবে। এইভাবে হলে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব।“

পশ্চিম বঙ্গ গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতি প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি স্বপন সরকার জানিয়েছেন, “মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দুটি ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত কোন্ পথে যাবে তা নির্বাচন করে দেয়। মাধ্যমিক পাশ করলে তাঁরা কী নিয়ে পড়বে বাবা-মার সাথে আলোচনা করে নির্ধারণ করে। কিন্তু পরীক্ষা না হলে কিসের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হবে? তা নিয়ে কি সকলে সন্তুষ্ট হবে? আর্টস, সায়েন্স ও কমার্স নিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে একটা জটিলতার সৃষ্টি হবে।

উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে জটিলতা আরো বেশি। এই পরীক্ষার পর ছাত্রছাত্রীরা কলেজ সহ বিভিন্ন লাইনে পড়তে চলে যায়। সেক্ষেত্রে পর্ষদের দেওয়া নম্বরে হয়তো দেখা যেতে পারে একটা মেধাবী ছাত্র সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলেছে। এর দায়ভার কে নেবে?
যাইহোক আমার মতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দুটি দেরিতে হলেও নেওয়া উচিৎ। আর সরকারের দুয়ারে রেশন ব্যবস্থার মতো পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিৎ।“

প্রসঙ্গত, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী টুইটে আর্জি জানিয়েছেন, আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ আমাদের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে আমরা এক বিশেষজ্ঞ কমিটিও গড়ে দিয়েছি। দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষার ব্যাপারে ওই কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা অভিভাবক, রাজ্যের মানুষ, বিশেষজ্ঞ, পড়ুয়াদের কাছে থেকে মতামত জানতে চাইছি।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.