ভারত সরকারের নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘প্রাচীন ভারতে সনাতন ধর্ম যেমন ছিল, তেমনই লোকায়ত বা চার্বাকের পরম্পরাও ছিল। তার মধ্যে ঈশ্বরহীনতা, ধর্মহীনতা বা ধর্মবিরোধীতা এবং সম্পূর্ণ যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণও গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে মুসলিম প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ’।
যে কথাটা আপামর ভারতবাসী জানে, সেই কথাটাই কেন এক বিদগ্ধ বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদকে এমন ঘটা করে আয়োজিত ওয়েবিনারে ঘোষণা করতে হয়? তবু কয়েকটা প্রশ্ন থেকেই যায়।
এক) ‘ঈশ্বরহীনতা’ ও ‘যুক্তি’ বলতে কেন শুধু চার্বাকের কথাই স্মরণে আসে? গৌতম বুদ্ধ বা মহাবীর জৈন তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে নীরব থেকেছেন, তাঁদের কথা কেন মনে পড়ে না? যেহেতু তাঁরা ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাধনা, করুণা, নির্বাণের কথা বলেছেন? সেখানে একটু ধর্মের গন্ধ থেকে গেছে ব’লে? বেদান্ত বিচারের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মহান যুক্তি চর্চা কোথায় হয়েছে? কেন আদি শংকরাচার্য’কে যুক্তির শিরোমণি ভাবতে কষ্ট হয়? যিনি নিখুঁত বিতর্কের শক্তিতে অবক্ষয়মুথী প্রাতিষ্ঠানিক বৌদ্ধ ধর্ম’কে ভারত থেকে প্রায় নির্বাসিত করে দিলেন? সেখানেও সনাতন ব্রাহ্মণ্যধর্ম’কে কিছুটা নাম-রূপ আঙ্গিক পাল্টে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হোল বলে? অর্থাৎ, সেই একই ধর্মের কটু গন্ধ? বিশেষ করে সেই ধর্মের উৎস যদি ভারত হয় তবে শ্রী সেনের বিরক্তি কি বাড়ে? সত্যসন্ধানী দার্শনিক ব’লে চার্বাককে কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে ‘ঋষি’ বলা হয়। কিন্তু আধুনিক চার্বাকপন্থীরা তাঁকে ঋষি বলতে কুন্ঠিত হন কেন? ‘ঋষি’ শব্দেও কি ‘হিন্দু’ত্বের জুজু?
দুই) বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব তো গুরুত্বপূর্ণ বটেই। সু এবং কু দুটো দিকই নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছেন অমর্ত্যবাবু। শান্তির ধর্ম কেমন শান্তির তরবারি নিয়ে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছে, পুঁথিপত্র পাণ্ডুলিপি পুড়িয়েছে, সেই আগুনে পরম শান্তিতে খিলজির সৈন্যবাহিনী কেমন দেড় মাস ধরে রুটি সেঁকেছে, কেমন করে প্রায় ৪৮ হাজার মন্দির ভেঙে তার উপরে মসজিদ স্থাপন করেছে, কেমন নিহত হিন্দুদের খুলি দিয়ে সেই মসজিদের সিঁড়ি গেঁথেছে, কেমন অবলীলায় বহু কাফের নারী ধর্ষণ করেছে, কেমন জবরদস্তি হিন্দু শিশুদের খোজা করে পরে মহান সম্রাট ও মনসবদারদের হারেমের রক্ষী নিয়োগ করেছে, কেমন জিজিয়া কর চাপিয়ে গোটা হিন্দুস্তানে ‘শান্তি’ ও সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই দিকটাও নিশ্চয়ই তুলে ধরার কথা বলতে চাইছেন তিনি?
তিন) আটশো বছর মহাশান্তির পর কৃপা আরও বাড়ল। এবার সমুদ্রপথে একের পর এক আছড়ে পড়তে লাগল প্রেম ধর্মের ঢেউ, বণিকের বেশে। ভালবাসার আতিশয্যে তারা আমাদের উৎপাদন-শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্যের কঙ্কাল বার করে নিজেরা হয়ে উঠল বিশ্বের এক নম্বর ধনী রাষ্ট্র। আদর করে তারা মুছে দিল আমাদের স্মৃতি, আমাদের ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি। নিজেদের ভাষা আংশিক জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে এক উচ্চশিক্ষিত সমাজকে নিরক্ষর বানিয়ে ছাড়ল, যাতে এই মধুর সম্পর্কের বন্ধন কোনদিন ছিন্ন না হয় এবং স্থানীয়দের মধ্যে অনেক রকম বিভাজন ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। কিছু অকৃতজ্ঞ ভারতীয়দের কত উপদ্রব তারা হাসিমুখে তাও সহ্য করেছে। ‘স্বাধীনতা চাই’ বলে আমাদের ছেলেমানুষি আবদার মেটাতে তারাই প্রশিক্ষণ দিতে তৈরি করে দিয়েছে আধা-দেশি নেতা আমলা, ছদ্মবেশী বিরোধী প্রতিপক্ষ, কৌশল, নীতি, আমাদের পাঠ্যক্রম, প্রশাসনিক পরিকাঠামো, শিক্ষানীতি, পোশাক পরিচ্ছদ, চাকরি, ভদ্রতা, দাসত্ব। কিন্তু ভারত সেই প্রেমের মূল্য বুঝলো কোথায়? আবার নতুন করে সেই আদিম ‘বর্বর’ সনাতনের ডমরু বাজছে। স্বাভাবিকভাবেই অধ্যাপকের কপালে বলিরেখা আরও গভীর হয়ে উঠছে।
চার) ডঃ সেনের বোধহয় বেশ গর্ব হয় ভাবতে যে ভারতই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে এক হাজার বছর ধরে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপরে শাসন করেছে। আজ চিত্রটা পাল্টাচ্ছে বলে আমাদের হয়ত লজ্জিত ও অপ্রস্তুত থাকা কর্তব্য।
পাঁচ) আপনি হয়ত কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন অমর্ত্যবাবু, যদি স্কুল কলেজে গীতার ক্লাস শুরু হয়? যদি ব্রহ্মচর্য ও যোগাসনের অনুশীলন শুরু হয়ে যায়? যদি রামায়ণ ও মহাভারতের মত মহাকাব্য নিয়ে নিয়মিত চর্চা শুরু হয়ে যায় ছাত্রদের মধ্যে? যদি আধুনিক ভারত এতকালের লালিত বৈদেশিক ‘শান্তি’, ‘প্রেম’ ও ‘সাম্যবাদের’ কারাগার থেকে মুক্ত হতে চায়?
- জয়দীপ