আজকাল বাড়ির বাইরে যথেষ্ট সতর্ক হয়ে ঘোরাফেরা করতে হয়। নানারকম দুর্ঘটনায় চোট পাওয়া, চুরি-ডাকাতি বা ভিড়ের থেকেও বেশি দূষণঘটিত কারণে অসুস্থ হবার ভয়। আমরা বাড়ির বাইরের দূষণে আক্রান্ত হচ্ছি এবং প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে তার কুফলও ভোগ করছি। গত কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি যে, রাজধানী দিল্লিসহ দেশের সর্বত্র বায়ুদূষণের মাত্রা ভীষণ রকমের বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন অধ্যয়ন ও গবেষণা থেকে জানা যায় যে পরিবেশ দূষণের জন্য মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রকার অসুখে ভুগছে। বাস্তবে ‘দূষণ’ শব্দটি থেকে আমাদের মনে ভেসে ওঠে যানবাহনের ধোঁয়া, বাড়ি তৈরির সময় বাতাসে ওড়া ধূলিকণা, পাওয়ার প্লান্টের ধুলো ইত্যাদি। এসব থেকে বাঁচার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু বাড়ির ভেতরের দূষণ সম্বন্ধে বেশি আলোচনা হয় না, যা জ্ঞানে-অজ্ঞানে আমাদের শরীরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাইরের দূষণ থেকে বাড়ির ভেতরের দূষণ অনেক বেশি সাংঘাতিক।
সম্প্রতি, বাড়ির ভেতরে বায়ুদূষণের ওপর বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। ইন্ডিয়ান পল্যুউশন কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দিল্লিতে ১৩টি বহুতল বাড়ির সমীক্ষায় জানা গেছে যে, ওই বাড়িগুলির কার্বন-ডাই-অক্সাইডের স্তর নির্ধারিত সীমা থেকে অনেক বেশি, অর্থাৎ সাংঘাতিক বিপজ্জনক। এর মধ্যে বেশ কিছু করপোরেট অফিসও আছে। এছাড়া অফিসগুলির হাওয়ায় বিভিন্ন প্রকারের জীবাণুও অধিক সংখ্যায় পাওয়া গেছে। ইন্ডিয়ান স্টেট লেবেল ডিজিস ওয়ার্ডন-এর একটি গবেষণায় জানা গেছে যে, রান্না ও গরম করার জ্বালানি, যেমন— ঘুঁটে, চারকোল, কাঠ ইত্যাদি দেশের ৫০ ভাগ বায়ুদূষণের মুখ্য কারণ। এর ফলে চোখের নানারকম সমস্যা, ফুসফুসের অসুখ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি অসুখের বোঝা দেশের অর্থব্যবস্থার ওপর পড়ছে। অনেক সময় রান্নাঘরে পি.এম (পারটিকুলেট ম্যাটার) ২.৪ থেকে দশগুণ বেশি হয়ে যায়। ২০১৭ সালে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১.২৪ মিলিয়ন অকাল মৃত্যুর মধ্যে ০.৪৮ মিলিয়ন মৃত্যুর জন্য ঘরের ভেতরের জ্বালানি এবং বাড়ির ভেতরের দূষণ দায়ী। এছাড়া অন্যান্য বেশ কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে নিমোনিয়া অসুখের জন্য ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী বাড়ির ভেতরের দূষণ।
দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ঘরের ভেতরের দূষণের জন্য অনেক রকমের অসুখে আক্রান্ত হলেও আমরা অনেকেই জানি না যে, বাড়ি-অফিসে ব্যবহার্য অনেক জিনিস এই দুষণের মূখ্য কারণ। বাড়ির ভেতরের মেঝে, বাসন ধোঁয়ার সাবান, পেন্ট, নানারকম মেশিন শৌচাগার, আবর্জনা ইত্যাদি থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস এই দূষণকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের কিছু জিনিস যেমন— পারফিউম, কসমেটিক, মশা মারার বিভিন্ন ব্যবস্থা, এয়ার ফ্রেশনার, বিভিন্ন প্রকার ধূপ এর মধ্যে পড়ে। এছাড়া দেওয়াল, আসবাবপত্রের চটকদার রং, পালিশ, পর্দা, কার্পেট, লেপ-কম্বলের মধ্যে যে কতরকমের ধুলো ও জীবাণু থাকে, তার ইয়ত্তা নেই। ড্রাইক্লিন করা জামাকাপড়, জল গরম করার জন্য হিটার, ঘরে অফিসের ব্যবহার্য স্টেশনারি, প্রিন্টার, আঠা আরও কতকিছু নীরবে আমাদের অফিস ও বাড়ির ভেতরের আবহাওয়াকে দূষিত করে চলেছে। পোষ্য যেমন, কুকুর-বেড়াল, নানারকম পাখির মল-মূত্র, চুল, ঝরে পড়া শুকনো চামড়া বাড়ির ভেতরের দূষণের স্তর বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নানান রকম অসুখের সৃষ্টি করেছে। বাড়িতে কেউ টিবি বা জ্বরে আক্রান্ত হলেও দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, আধুনিক নকশায় তৈরি বাড়ি এবং অফিসগুলি যথেষ্ট খোলামেলা এবং প্রাকৃতিক আলোতে ভরপুর না হবার জন্য দূষণ স্তর ভীষণ রকমের খারাপ।
বাইরের দূষণ থেকে বাঁচার জন্য আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ি, অথচ সেখানেও আমরা দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে ফেলেছি। অথচ জীবনের অনেকটা সময় আমরা নিজেদের বাড়ি, অফিস, রেস্টুরেন্টে কাটাই। সেজন্য এই জায়গাগুলিকে দূষণমুক্ত করার দায়িত্ব কেবলমাত্র আমাদের। দিনচর্যার যেসকল জিনিস দূষণের জন্য দায়ী, সেগুলির ব্যবহার কম বা বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রাকৃতিক জিনিসের ব্যবহারের করা একান্ত আবশ্যক। বাইরের দূষণ থেকে বাঁচার জন্য সমাজ, সরকার, সবাই মিলে উদ্যোগ নিতে হবে। পারম্পরিক বাড়িগুলিতে যথেষ্ট জানলা-দরজা থাকে, সেগুলি খুলে রাখলে পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং হাওয়া চলাচল করে। যেসব জিনিস বাড়ির দূষণস্তর বাড়ায়, সেগুলির মধ্যে বেশিরভাগ জিনিসই অত্যাবশ্যক নয়— বিদেশি কোম্পানির আর্থিক লাভ করে দেওয়ার জন্য আমরা সেগুলির লোকদেখানো ব্যবহার করি আর নিজেদের অর্থ এবং স্বাস্থ্য দুটিই নষ্ট করি। এখন আমাদের সচেতন হতে হবে। মহিলারা বাড়িতে অনেকটা সময় কাটান এবং বাড়ির দেখাশুনা করেন। মহিলারা সচেতন হলে অতি সহজেই বাড়ির ভেতরের দূষণ কম হতে পারে। এর ফলে নিজেদের গড় আয়ু আরও সাতমাস বাড়িয়ে নিতে পারা যাবে।
সুতপা বসাক ভড়