পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় জনবিন্যাস ও ড. শ্যামাপ্রসাদ

সমগ্র ভারতে এক পরিবর্তনের ঝড় উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গেও সেই ঝড় ঢুকে পড়েছে। কয়েক বছর আগেও ভারতীয় জনতা পার্টি এই রাজ্যে ছিল একেবারে অস্পৃশ্য একটি রাজনৈতিক দল। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনা পশ্চিমবঙ্গের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা, সাময়িকীতে কোনো ভাবেই স্থান পেত না। রাজনৈতিক ঝড়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে হিন্দুত্ববাদ বা বিজেপি অনেকটা জায়গা করে নিতে পারলেও বৌদ্ধিক মহলে এখনো তা বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। এর একটা বড় কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গ গঠনের ইতিহাস এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে কোনো আলোচনা প্রধান পত্রপত্রিকায় এখনো স্থান পায়নি। শ্যামাপ্রসাদের উল্লেখ কখনো করা হলে তাকে এক হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতা ছাড়া আর কোনো বিশেষণে ভূষিত করা হয় না। অতি সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে নামী পাক্ষিক পত্রিকায় আলোচনার বিষয় ছিল নরেন্দ্র মোদীর ভারত জয়। অবশ্যই প্রতিটি প্রবন্ধ এই জয়কে তুচ্ছ প্রমাণে লিপ্ত থেকেছে এবং একটি প্রবন্ধের চিন্তার বিষয় ছিল বাঙ্গালি (অর্থাৎ বাঙ্গালি হিন্দু) কি সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালি যে সাম্প্রদায়িক হয়ে যেতেও পারে তার জন্য প্রবন্ধে অকাট্য যুক্তি ছিল যে যেহেতু একদা বাঙ্গালি শ্যামাপ্রসাদ নামক এক সাম্প্রদায়িকের জন্ম দিয়েছিল ফলে একটা ভয় থেকেই যাচ্ছে। একটি বাক্যে শ্যামাপ্রসাদের এই পরিচয়ের বেশি আর কিছু বলা হয়নি। আজকের বাঙ্গলায় আমাদের এই ‘সাম্প্রদায়িক’ শ্যামাপ্রসাদকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে, অ্যাকাডেমিক শ্যামাপ্রসাদের ভাবমূর্তি সামনে রেখে ইসলামি মৌলবাদ-প্রেমীদের কাছে শ্যামাপ্রসাদকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কোনো দায় আমাদের নেই। এই জুন মাস শ্যামাপ্রসাদের মাস। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গ রূপ পেয়েছিল। আর তার মাত্র ছয় বছর পর ২৩শে জুন সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে ভারতের অন্তভুক্ত করার লড়াইয়ে তিনি আত্মবলিদান করলেন।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের (অসমেরও) একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। আজ থেকে দশ বছর বা কুড়ি বছর পর ভারতের অন্য রাজ্যগুলি খুব একটা পাল্টাবে না। কেউ বেশি উন্নত হবে, কেউ ততটা উন্নতি করতে পারবে না, এইটুকুই। কিন্তু আজ থেকে দশ বছর বা কুড়ি বছর পর পশ্চিমবঙ্গ কেমন থাকবে তা কোনো উন্নয়নের ওপর নির্ভর করবে না। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তার ধর্মীয় জনসংখ্যার ভারসাম্যের উপর। পশ্চিমবঙ্গ পশ্চিমবঙ্গই থাকবে, না পশ্চিম বাংলাদেশ হয়ে যাবে তা সম্পূর্ণ ঠিক করবে এই ধর্মীয় জনসংখ্যার গতি প্রকৃতি। ঠিক এই কথাগুলিই আজ থেকে সাত দশক আগে শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন যার চর্চা আজ খুবই জরুরি।
আমাদের আজ কোনো দ্বিধা না রেখে, কোনো সেকুলারি সুগন্ধ না ছড়িয়ে, একেবারে পরিষ্কার করে বলতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হয়েছিল বাঙ্গালি হিন্দুর হোমল্যান্ড হিসাবে। এই হোমল্যান্ড গড়ার জন্য যে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল তার পুরোভাগে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। পশ্চিমবঙ্গ গড়ে উঠেছিল হিন্দু প্রধান জেলাগুলিকে নিয়ে। কিন্তু শুধু হিন্দুপ্রধান জেলাগুলি নিলেও বাকি পূর্ববঙ্গে থেকে যান অনেক হিন্দু। শ্যামাপ্রসাদ তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন সেই প্রথম দিন থেকেই। ২ মে ১৯৪৭-এ মাউন্টব্যাটেনকে দেশভাগ সম্পর্কিত চিঠিতে তিনি লেখেন, “মি. জিন্না জনসম্প্রদায় ও সম্পত্তির স্থানান্তর চাইছেন। যদি অবিভক্ত বাঙ্গলাকে পাকিস্তানে দেওয়া হয় তবে ২ কোটি ৬০ লক্ষ হিন্দুকে স্থানান্তরিত করতে হবে যা অসম্ভব। অন্যদিকে যদি বাঙ্গলা বিভক্ত হয় তবে এই স্থানান্তর অনেক সহজেই করা যাবে। এতে প্রায় ৯০ লক্ষ মুসলমান ও ৬০ লক্ষ হিন্দু স্থানান্তরিত হবেন।”
খুব পরিষ্কার করে তিনি যে পশ্চিমবঙ্গের ছবি আঁকছেন তাতে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদেরও স্থান দিচ্ছেন। এই কথাটিই বি আর অম্বেদকরও আগেই বলেছিলেন। মনে রাখতে হবে বঙ্গীয় আইন সভায় যখন বাঙ্গলা ভারতে থাকবে না পাকিস্তানে যাবে সেজন্য ২০ জুন প্রথম ভোট নেওয়া হয় তখন ১২৩ জন পাকিস্তানের পক্ষে ও ৯০ জন ভারতে যোগদানের পক্ষে ভোট দেন। একজন মুসলমান সদস্যও ভারতে যোগদানের পক্ষে ভোট দেননি। সুতরাং ভারতে অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের থাকার কোনো নৈতিক অধিকার আছে কিনা তা প্রশ্নযোগ্য।
এই জনবিনিময়ের প্রশ্নটি বারবার উঠে এসেছে। আমরা জানি যে দেশভাগের সময় পঞ্জাব প্রদেশও বিভক্ত হয়। দেশভাগের সময়ে ও তার পরে কিছু সময়ের মধ্যেই দুই পঞ্জাবের মধ্যে জনবিনিময় সম্পন্ন হয়ে যায়। সেজন্য ১৯৪১ সালে ভারতের পঞ্জাবে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৩১% যা ১৯৫১ সালের জনগণনায় কমে গিয়ে হয় ১.৮%। বাঙ্গলার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই বিষয়টি নিয়ে ভাবলেও তা করা হলো না। বরং হলো উল্টোটাই। স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হলো হিন্দুদের উপর অত্যাচার। হিন্দুরা চলে আসতে থাকলেন। ১৯৫০ সালে বিরাট দাঙ্গা হলো পূর্ব পাকিস্তানে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে এলেন। এই সময় ভারতীয় সংসদে দাবি উঠলো জনবিনিময়ের। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের মূল ভিত্তিটাকেই ধ্বংস করতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খানের সঙ্গে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি করলেন। এতে জন। বিনিময়ের উল্টোটাই চুক্তি হলো, হিন্দুরা ফিরে যাবেন পাকিস্তানে আর মুসলমানরা চলে আসবেন পশ্চিমবঙ্গে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জওহরলালের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখলেন, “ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দুরা আসতেই থাকবেন আর যাঁরা আসবেন তারা ফিরে যাবার কথা ভাবতেই পারেন না। অন্যদিকে যে সমস্ত মুসলমান চলে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসবেন এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে চুক্তিটির একতরফা রূপায়ণে মুসলমানেরা ভারত ছেড়ে যাবেন না। শ্যামাপ্রসাদের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা দিনে দিনে কমতে থাকল, ২২% হিন্দু কমে হল ১৪%, কিন্তু এত হিন্দু আগমন সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত বাড়লো না, মুসলমান আগমনের জন্য মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত কিছুটা বেড়ে গেল। এই মুসলমানরা আইনি পথেই পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, ফলে এঁরা ভারতের নাগরিক হয়ে গেছেন।
১৯৫৩ সালে রহস্যজনক মৃত্যু হলো ড. শ্যামাপ্রসাদের ফলে শ্যামাপ্রসাদের পক্ষে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম দেখে যাওয়া হয়নি। শ্যামাপ্রসাদ জন বিনিময় করে যে হিন্দু হোমল্যান্ডের কথা ভেবেছিলেন তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে বসেছে বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশের দৌরাত্ম্যে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ হবার পর, বিশেষত ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর বাংলাদেশ ক্রমশ আবার পাকিস্তানে পরিণত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু আবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন ও আসছেন। কিন্তু এবার যত হিন্দু এসেছেন তার দ্বিগুণ বাংলাদেশি মুসলিম প্রবেশ করেছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় জন ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। জন বিনিময় করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য রাখা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হলো তার উল্টোটাই। বাংলাদেশে যখন হিন্দু জনসংখ্যা ৮%-এর কমে নেমে গেছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে ৩০% হতে চলেছে। ড. শ্যামাপ্রসাদের স্বপ্ন চুরমার হতে আর দেরি নেই।
পশ্চিমবঙ্গ যদি শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ না হয় তাহলে তা পশ্চিমবঙ্গ নয়। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক বা আগামী দিনে আসুক না কেন পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় জনসংখ্যার ভারসাম্য ঠিক না করতে পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর এজন্যই আমাদের প্রয়োজন নাগরিকপঞ্জী নবীকরণ বা এন আর সি-র দাবিকে আরোও জোরদার করা। এন আর সি করে ১ কোটি বাংলাদেশি মুসলমান। অনুপ্রবেশকারীকে ভোটার তালিকা থেকে বিতাড়ন দিয়ে শুরু করে, পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে বিতাড়ন করে ধর্মীয় জন ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ড. শ্যামাপ্রসাদের ঋণ মেটানোর বাঙালির কাছে এই শেষ সুযোগ।
মোহিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.