আজ থেকে ২৯ বছর আগে এক উৎকণ্ঠা দীর্ণ উত্তরপ্রদেশে কর্মসূত্রে গিয়ে তরুণদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি স্লোগানের কথা শুনেছিলাম। সে সময় ফোন উঠিয়ে কেউ হ্যালো বললে তারা সঙ্গে সঙ্গে মনে করিয়ে দিত হ্যালো নয় ‘জয় শ্রীরাম বলুন, কথাটা অনেকেরই মনে ধরেছিল তারা প্রত্যুত্তরে ‘জয় শ্রীরাম’ বলাই শুরু করেছিল।
হতে পারে এমন ধ্বনি হয়তো নেহাতই সময়ের হুজুকে উঠেছিল বা সত্যিই এক প্রবাদ পুরুষের স্মরণে চালু করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তদানীন্তন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ বিষয়টাকে অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাবে নিয়েছিলেন। তিনি এই ধ্বনির বিরুদ্ধে মানুষকে একত্রিত করে এক তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিস্পর্ধী শক্তি খাড়া করার চেষ্টা করলেন। জয় শ্রীরাম আওয়াজ তোলা লোকেরা ইতিমধ্যে অযোধ্যায় ‘করসেবা করার কর্মসূচি নিতে শুরু করেছিল। চিরকালীন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা মুলায়মের এই অবস্থানকে তৎক্ষণাৎ তারিফ জানিয়ে বলেছিলেন নীচু জাতের বিরুদ্ধে অর্থাৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে কমণ্ডল অর্থাৎ উচ্চবর্ণকে আটকাতে মুলায়ম সঠিক অবস্থান নিয়েছেন। সেকুলারবাদীরা তাদের স্বপক্ষে যুক্তি সাজিয়ে এতদূর পর্যন্ত বলেছিলেন যে হিন্দুত্ববাদীদের বারাণসী, মথুরাকে ছেড়ে একেবারে অযোধ্যাকে বেছে নেওয়ার কারণ রাম ছিলেন একজন উচ্চ বর্ণের ক্ষত্রিয়, সেই জায়গায় মহাদেব ছিলেন উপজাতি সম্প্রদায়ের আর কৃষ্ণ তো পিছিয়ে পড়া যাদব পরিবারের।
এই বৌদ্ধিক ব্যাখ্যার সঙ্গে মুলায়মের জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতি দুয়ে মিলে। উত্তরপ্রদেশে এক ধরনের চাপা নির্যাতনের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। মন্দির নির্মাণের পক্ষে থাকা নাগরিকদের নাগাড়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, একই সঙ্গে জয় শ্রীরাম ধ্বনিও সরকারি অসন্তোষের মুখে পড়ে। এর ফলে বরাবরের লোকায়ত বিশেষ করে হিন্দিভাষী বৃহত্তর ভারতে পরস্পর দেখা হলেই ‘রাম রাম’ বলার মতো পরম্পরাটিই একটি নতুন বা উচ্চতায় চলে যায়। এই প্রীতি সৌহারে ধ্বনিটি হঠাৎ একটি রাজনৈতিক স্লোগানে পর্যবসিত হয়। জয় শ্রীরাম ধ্বনি তখন সরকার বিরোধী নানান পর্যায় চলে যায় এই কারণে যে সরকার নাগরিকদের চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার ওপর তখন হস্তক্ষেপ শুরু করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মুলায়মের বিভিন্ন জেলা সফরের সময় তিনি প্রায়শই সেই জেলায় ডাকা বন্ধের মুখে পড়তেন একই সঙ্গে তাঁর গাড়ির কনভয় দেখলেই বিপুল জনতা তীব্র আবেগেরামের জয় ঘোষণা করে ধ্বনি দিত। এর পরে পরেই মুলায়মের নাম হয়েছিল ‘মোল্লা মুলায়ম’।
অনেকেরই স্মরণে আছে ১৯৯০ সালে জোর কদমে এগিয়ে যাওয়া বিজেপিকে রুখতে মুলায়ম কড়া ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে জাতপাতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। মুলায়মের করসেবকদের ওপর নির্যাতন ও হিংস্রতার পরিণতিতে ১৯৯১-এর রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির যে জয় সূচিত হয়েছিল তা সুদূর প্রসারী। পরবর্তীকালে এই উত্তর প্রদেশ জয়ই ভবিষ্যৎ ভারতে বিজেপিকে কংগ্রেসের প্রধান বিকল্প দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে উত্তরপ্রদেশের এই রাজনৈতিক ইতিহাস তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৯০-এর অযোধ্যা আন্দোলনের সময় পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু সেই বিপুল হিংস্র আবেগজনিত অস্থিরতার তেমন আঁচ লাগেনি। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসনে বিজেপি’র জয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তবিকই হতভম্ব হয়ে পড়েছেন। পরিণতিতে তিনি ১৯৯০ সালের মুলায়মের মতো আচরণ করছেন। প্রাথমিকভাবে তার বদলা নেওয়ার লাইন মেনে তার দলীয় মস্তানরা বিজেপি সমর্থকদের হিংস্র আক্রমণ করছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে বিজেপি কর্মীদের নারকীয় পদ্ধতিতে খুন করা হচ্ছে। বিজেপির বিজয় মিছিল করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। গত সপ্তাহে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলের কর্মীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের ওপর সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভাবে পুলিশ ব্যাপক কাদানে গ্যাস ছুঁড়েছে।
দ্বিতীয়ত, বরাবরের মতোই পরিস্থিতি বিচার করে মমতা মুসলমানদের ওপর তাঁর রাজনৈতিক নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে নজরে পড়ার মতো ধর্মীয় মেরক্করণের সৃষ্টি হয়েছে। সন্দেশখালিতে যে রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে তাতেও মুসলমান অপরাধীদের প্রকাশ্য যোগসাজস রয়েছে যারা আবার তৃণমূলের মদতপুষ্ট বলেই জানা গেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাম্প্রতিক জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে যে বিক্ষোভ আন্দোলন ঘটল তার মধ্যেও হিন্দু মুসলমান রং দেওয়া বাদ থাকেনি।
এছাড়া শহরে ও গ্রামাঞ্চলে তার দলপতিদের জনগণের কাছ থেকে নিত্য বিপুল পরিমাণ তোলা আদায় ও নানা ধরনের অত্যাচারের প্রসঙ্গ থেকে নজর ঘোরাতে মমতা ব্যানার্জি অতি সম্প্রতি এক বাঙ্গালি উপজাতীয়তাবাদের (Sub nationalism) আমদানির মাধ্যমে প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করছেন।
বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্বের ভোটে পর্যাপ্ত রাজনৈতিক লাভ ওঠানোর পর তিনি বর্তমানে বিজেপিকে বাঙ্গলার কৃষ্টি সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ একটি বহিরাগতের দল বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিশেষ করে তার আক্রোশ গিয়ে পড়েছে সেই সমস্ত লোকেদের ওপর যাঁরা তাঁকে দেখে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে বিদ্রুপ করেছে। তার এক দল কর্তা আবার বিধান দিয়েছেন ‘জয় শ্রীরাম’ বাঙ্গালির সঙ্গে বেখাপ্পা। এর অন্তর্নিহিত বৌদ্ধিক ব্যাখ্যাটি আবার এরকম যে যেহেতু বাঙ্গলা ঊনবিংশ শতাব্দীর গৌরবময় যুক্তিবাদিতা ও রেনেসার অগ্রপথিক আবার উত্তর ভারতীয়রা আদৌ বোঝে না। বিচিত্র নানান সামজিক সংজ্ঞায় যতই চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হোক না কেন আদতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধবনিটি মমতা ব্যানার্জির লাগাতার কুশাসন ও মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া হিংসার বিরদ্ধে একটি সহজ প্রতিবাদেরই রূপ।
তথাকথিত বাঙ্গালি ভদ্রলোকের কাছে জয় শ্রীরাম ধ্বনি এখনও হয়তো অপরিচিত ঠেকছে। কারণ এঁদের মধ্যে আজও অনেকেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখিত ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে রাম ও লক্ষ্মণকে মর্যাদাহীন ভাবে চিত্রিত করায় এক ধরনের বৌদ্ধিক চিত্তপ্রসাদ লাভ করে থাকেন।
এই সূত্রে, ২০১৯ সালের নির্বাচনী সাফল্যকে আরও পাকাপোক্ত করতে গেলে বিজেপিকে বাঙ্গলার জাতীয়তাবাদী উত্তরাধিকারের ঐতিহাসিক বন্ধনের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে মিশে যাওয়ার প্রকল্পের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
একই সঙ্গে এই ভদ্রজনোচিত উত্তরাধিকারের যথার্থ বিশ্লেষণ দরকার। নির্বাচনোত্তর যে তথ্য ও পরিসংখ্যান হাতে আসছে তা অবাক হওয়ার মতো। নির্বাচন পরবর্তী হিংসায় যারা বলি বয়েছে তাদের সামাজিক অবস্থান বিচার করলে দেখা যায় এই সমস্ত বিজেপি সমর্থকদের অধিকাংশই পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের, তথাকথিত দলিত ও জনজাতিদের সমষ্টি। হ্যা, স্বাভাবিকভাবেই এই সম্প্রদায়ের মানুষজনেরা তথাকথিত ভদ্রলোকেদের। থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ভদ্রলোক অর্থে যাঁরা সেই নিজস্ব বৌদ্ধিক স্তর থেকে সব কিছুর সংজ্ঞা দিয়ে চলেছেন। কিন্তু অতীতের মতো নয় আজকের বিজেপিতে এতদিন অনালোচিত মানুষেরই এই নতুন রাজনীতির গতিপথ ঠিক করে দিচ্ছেন।
উল্লেখিত ১৯৯০ সালে উত্তরপ্রদেশে জয়ের সময় জয় শ্রীরাম ধ্বনি বিজেপিকে উচ্চবর্ণ ও বানিয়াদের দলের তকমা ভেঙ্গে উত্তর ভারতের নিম্নবর্গীয় ও দলিতদের কাছে। ও মধ্য ভারতের জনজাতিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। একের পর এক রাজ্যে বিজেপি নির্বাচনী জয় পায়। মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে সেই একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।
স্বপন দাশগুপ্ত
(লেখক সাংবাদিক এবং সাংসদ)
2019-06-28