বিহারে রাজগীর জেলার অভয় কুমার, নেপালের সাপান ঘিমিরে বা শ্রেয়া সোতাং, এঁদের আপনি কাউকে চেনেন না। কারণ, এঁরা না রাজনীতি করেন, না খেলা বা ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত। অথচ আজ ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এঁদের তৈরি গান যা ৯০টি ভাষায় সারা পৃথিবী জুড়ে বাজবে।
আপাতত কবি অভয় কুমার মাডাগাস্কারের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। সাপান হলেন এই গানের সুরকার আর শ্রেয়া হলেন গায়িকা। গানটিকে বলা হয় বসুন্ধরা স্তব Earth Anthem)।
১৯৭২ সালে স্টকহোম সম্মেলনের পর থেকেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তায় ১৯৭৪ সালে তা প্রথম পালিত হয় আমেরিকার স্পোকানে শহরে। তারপর তৃতীয়টি হয় ওন্টারিও, কানাডাতে। দ্বিতীয় এবং চতুর্থ থেকে একাদশতম(১৯৮৪) বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয় বাংলাদেশে। পরে ১৯৮৫ সাল থেকে বিশ্বের ভিন্ন জায়গায় পালিত হয়। ভারতবর্ষে পালিত হয় ২০১১ ও ২০১৮তে।
এবছর হবে পাকিস্তানে। বিষয়ঃ Reimagine-Recreat-Restore। পাকিস্তানের পরিকল্পনা আগামী পাঁচ বছরে ১০ লক্ষ কোটি গাছ রোপন করা। এরমধ্যে অন্যতম হল ম্যানগ্রোভ গাছ। বিশ্বের দশম বৃহত্তম(০.৬ মিলিয়ন হেক্টর)ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, যা আছে সিন্ধ ও বালুচিস্থানের উপকুল বরাবর।
প্রতি তিন সেকেন্ডে একটি করে ফুটবল মাঠের আয়তনের জঙ্গল হারাচ্ছে এই পৃথিবী। ফলে বছরে আমরা হারাচ্ছি ৪.৫ মিলিয়ন হেক্টর জঙ্গল যা প্রায় ডেনমার্কের আয়তনের সমান। গত অর্ধ শতাব্দীতে আমরা ধ্বংস করেছি পঞ্চাশ শতাংশ জলাভুমি। হারিয়ে যাচ্ছে প্রবাল প্রাচীর। বাকি যা পড়ে আছে তার ৯০ শতাংশ হারিয়ে যাবে ২০৫০ সালের মধ্যে। উষ্ণায়নের জেরে বসুন্ধরার তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৫ সেন্টিগ্রেড। ৮০ শতাংশ বর্জ্য জল কোনরকম শোধন ছাড়াই গিয়ে পড়ছে নদীতে। ভাবার বিষয়। কিন্তু ভাববে কে? এই দেশে নির্বাচিত সরকার রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রক রয়েছে। এনজিও রয়েছে। পরিবেশ কর্মীরা রয়েছেন। পরিবেশ আদালত রয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন সুরের অভাব আছে। সবটাই যেন ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার।
চলুন যাই সুন্দরবনে। চারিদিকে ঘন সবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে দুটি পৃথক দেশকে। ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে যার ব্যাপ্তি প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ভারতে রয়েছে কমবেশী চার হাজার বর্গ কিমি আর বাকিটা বাংলাদেশের খুলনা জেলায়। এখানেই আছে ৪৫৩ প্রজাতির বন্য পশুপাখি যার মধ্যে ২৯০ ধরনের পাখি, ১২০ রকমের মাছ, ৪২ রকমের স্তন্যপায়ী সহ আরো কত কী। আর আছে মানুষখেকো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সংখ্যা প্রায় ১৮০। মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র আর গঙ্গার ত্রিধারা বঙ্গোপসাগরে মেশার আগে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ব-দ্বীপ। আই ইউ সি এনের(The International Union For The Conservation Of Nature) কাছে সুন্দরবন ইকোসিস্টেমের লাল তালিকাভুক্ত(Redlist Of Ecosystem)। ১৯৮৭ সালে তাই ইউনেস্কো এই এলাকাকে ঐতিহ্যবাহী তালিকার আওতায় আনে।
কিন্তু পাশাপাশি রয়েছে মানুষের লোভ আর বিধ্বংসী প্রকৃতি যা সুন্দরবনকে ছারখার করে দিয়েছে। ১৯০৭ সাল থেকে আজ অবধি সাইক্লোনিক ঝড় আর চোরা শিকারে এলাকা হয়েছে সংকটময়। সিডার, আয়লা, ফাইলিন, হুদুদ, বুলবুল, ফেনি, আমাফান-এইসব নাম শুনলেই এখানকার মানুষজন ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর রয়েছে বেআইনি অনুপ্রবেশ। বাংলাদেশ থেকে ফ্লাই অ্যাশ নিতে আসা খালি বার্জে প্রতিদিন কত মানুষ ভারতে ঢুকছে, তা কি প্রশাসন জানে না?
এই বিষয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গেছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। ২০১৫ তে আদালত বান্ধব হিসাবে এক রিপোর্ট পেশ করে তিনি জানান যে ১৯৫১ সালে সুন্দরবনে জনসংখ্যা ছিল ১১.৫৩ লক্ষ যা ২০১৮তে পৌছে গেল ৬৭ লক্ষের ওপরে। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ৫৮২%। একের পর এক দ্বীপ তলিয়ে যাচ্ছে বলে এই অঞ্চলের অসহায় মানুষদের পরিবেশ শরণার্থী করার দাবি তুলেছে বিশেষ এক ধরনের মানবাধিকার সংগঠন।
২০১৪ সালের ৯ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সেলা নদীতে সাদার্ন স্টার নামে একটি জাহাজ ডুবে যায়। ৩.৫৮ লক্ষ লিটার ফার্নেস তেলে প্লাবিত হয় সুন্দরবনের ৩৫০ কিলোমিটার নোনা জল। অস্থির হয়ে ওঠে জলের নিচে থাকা সমগ্র জীবজগৎ, ভেসে ওঠে মৃত ডলফিন। রামসার(ইরান) চুক্তি ১৯৭১ অনুযায়ী সুন্দরবন একটি জলাভুমি। কিন্তু ওই চুক্তি লঙ্ঘন করে ভারত-বাংলাদেশ ২০১১ সালে ১৩২০ মেগাওয়াট সম্পন্ন রামপাল কয়লা বিদ্যুৎশক্তি স্টেশন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩৪ একর জমিতে ওই শক্তিকেন্দ্র সংক্রান্ত চুক্তি সাক্ষর হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়ে ২০১৭ সালে দাভোসের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে প্রশ্ন তোলে আমেরিকার তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরে। ১৬০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই শক্তি কেন্দ্র যদি হয়, তবে সুন্দরবন হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
২০০২ সালে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে এই প্রতিবেদক ইন্টারন্যাশানাল ল অ্যাসোসিয়েশনের কমিটি অন দ্য লিগ্যাল আসপেক্টস অফ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের সদস্য ছিল। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ডঃ কামাল হোসেন(বাংলাদেশের প্রধান সংবিধান প্রনেতা)। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সুন্দরবন নিয়ে বাংলাদেশ এত উদাসীন কেন? উত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইনমন্ত্রী মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন ‘…, ভারত নয়?’
স্মরজিত রায় চৌধুরী