হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস

আজ ছত্রপতি শিবাজির অভিষেকের দিন। যাকে হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস হিসাবে পালন করি আমরা।

কিন্তু মজাটা কি জানেন? এই হিন্দু সাম্রাজ্য দিবসের মূল কৃতিত্ব কিন্তু একজন বাঙ্গালীর পাওনা ছিলো। মহারাজা প্রতাপাদিত্যের। একটি স্বাধীন সাম্রাজ্য এবং অবশ্যই হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের সমস্ত মালমশলা মজুত ছিলো তাঁর মধ্যে। তাঁর সাম্রাজ্যের মধ্যে। কিন্তু শুধুমাত্র বাঙ্গালীদের দলাদলি আর জাতপাত নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

শিবাজির জীবনে অনেক বাঁধা বিপত্তি আসলেও একটা বিষয়ে শিবাজি ভাগ্যবান ছিলেন। ইন্টারকাস্ট স্ট্রাগল অর্থাৎ সোজা বাংলায় জাত নিয়ে ঝামেলায় শাসক শিবাজিকে পড়তে হয়নি। হ্যাঁ‚ ব্যক্তি শিবাজিকে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। মারাঠা পুরোহিতরা তাঁর অভিষেক করাতে রাজি হয়নি‚ উত্তর ভারত থেকে পুরোহিত ধরে নিয়ে গিয়ে গাদাগুচ্ছের টাকা দিয়ে অভিষেক করাতে হয়। কিন্তু সেইসব ছিলো ব্যক্তিগত সমস্যা। শাসক শিবাজিকে‚ অর্থাৎ As a ruler শিবাজিকে কিন্তু মারাঠাদের ইন্টারকাস্ট স্ট্রাগল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়নি। আর ঘর সুরক্ষিত থাকলে যা হয় আরকি‚ খুব সহজেই তিনি বাইরের দিকে নজর দিতে পেরেছিলেন।

কিন্তু মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সেই সৌভাগ্য ছিলো না। শিবাজিরও বহু আগে ১৫৮৭ সালে প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরের কাছে ধুমঘাটে তার নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। ধ্বংস হয়ে যাওয়া যশোরেশ্বরী দেবীর মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করেন তিনি। তাঁর কাকা বসন্তরায়ের উদ্যোগ মহাসমরোহে নতুন রাজধানীতে প্রতাপাদিত্যকে অভিষেক প্রদান করা হয়। খরচ হয় সেই সময়ের হিসাবে ১ কোটি টাকা। রাজ্যাভিষেকের সময় বারো ভূঁইয়া অর্থাৎ তৎকালীন স্বাধীন বাঙ্গালী শাসকদের অনেকেই যশোরে এসেছিলেন এবং প্রতাপাদিত্যর কাছে বঙ্গের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি করেছিলেন।

অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি যে একটি স্বাধীন‚ শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্যের ভিত সেদিন গড়ার চেষ্টা হয়েছিল ধূমঘাটে।

কবি ভারতচন্দ্র তার বিদ্যাসুন্দর কাব্যে প্রতাপকে নিয়ে লিখেছিলেন –

যশোর নগর ধাম প্রতাপ আদিত্য নাম

মহারাজা বঙ্গজ কায়স্ত।

নাহি মানে পাতশায়, কেহ নাহি আটে তায়

ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ।

বরপুত্র ভবানীর প্রিয়তম পৃথিবীর

বায়ান্ন হাজার যার পল্লী।

ষোড়শ হলকা হাতি অযুত তুরঙ্গ সাতি

যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।’

কিন্তু প্রতাপের দুর্ভাগ্য‚ বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্য‚ ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য – এই সাম্রাজ্য প্রচেষ্টায় বাংলার উচ্চবর্ণ অর্থাৎ সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী শ্রেণী‚ অর্থাৎ সিভিল পাওয়ারের সবথেকে শক্তিশালী অংশটিই প্রতাপের সাথে সহযোগিতা করেনি।

প্রতাপের পতনের পরে তিন মজুমদারের (সাবর্ণদের পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার‚ কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার আর সপ্তগ্রাম বাঁশবেড়িয়ার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জয়ানন্দ মজুমদার) মধ্যে বাংলা ভাগের কাহিনী থেকে বোঝা যায় উচ্চবর্ণের বৃহদংশই মুঘলদের (মানসিংহের) সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। বাঙ্গালী এখনো ইকির মিকির খেলার সময় যে “চামে কাটে মজুমদার” বলে ছড়া কাটে তা কিন্তু আসলে বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুঘলদের সাহায্য করা ভবানন্দ মজুমদার ও তার সহযোগীদের স্মৃতিচারণ করে অবচেতনে। চামে কাটে শব্দের অর্থ চামড়া কেটে ফেলা। বাঙ্গালীর সম্রাট প্রতাপের বিরোধিতা করে মজুমদাররা যে মনে মনে লিঙ্গের চামড়া কেটে মুস*মান হয়ে গিয়েছিল‚ এই কবিতা সেটাই বোঝাচ্ছে। স্বাধীনতা হারিয়ে একটি পরাধীন জাতির হতাশা আর ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই ছড়াটায়।

ঘটনা ছিলো এই যে মানসিংহ প্রতাপকে আক্রমন করে বাংলা দখল করতে আসার সময় জলঙ্গী নদী পেরিয়ে আসতে গিয়ে পড়লেন ঝড়ের কবলে। মুঘল সেনাবাহিনীর খাদ্য সব জলে ভেসে গেল। তখন তাকে সাহায্য করলেন তিনজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের প্রত্যেকেরই পদবি ছিল ‘মজুমদার’। তারা হলেন, ভবানন্দ মজুমদার, লক্ষীকান্ত মজুমদার এবং জয়ানন্দ মজুমদার। এঁদের মধ্যে সবথেকে বেশী ভয়ঙ্কর ছিল কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা, হুগলির কানুনগো দপ্তরের মুহুরি ভবানন্দ মজুমদর। ভবানন্দ মানসিংহকে শুধু নৌকো দিয়ে নদী পার হতেই সাহায্য করেনি বরং নিজের বাড়িতে তাঁকে সসৈন্যে নিয়ে আসে ও মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে যোগার করা খাবার দিয়ে মানসিংহের সেনাবাহিনীর খিদে মেটায়। বদলে প্রতাপের পতনের পর তাদের সবাইকে কিছুটা করে জমিজায়গা ভিক্ষা দেয় মুঘলরা। যা দিয়ে তারা নিজেদের নামের সাথে রাজা যোগ করে নিজেদের রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে।

সমাজের উচ্চবর্ণ কেন প্রতাপের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল তা এখনো পরিষ্কার না। প্রতাপকে নিয়ে সেইভাবে গবেষণাই হয়নি কোনো। অবশ্য তাঁর কারণও ছিলো। প্রতাপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বংশধররা ছিলো কলকাতার অন্যতম শক্তিশালী পরিবার ছিলো। তাই হয়তো তাদের চটাতে সাহস করেনি কেউই। এছাড়াও জাতপাতের বিষয়টাও বোধহয় একটা বড় কারণ। নাহলে খোদ রবীন্দ্রনাথ যেভাবে রীতিমতো কাল্পনিক গল্প লিখে প্রতাপকে নিজে দায়িত্ব নিয়ে ভিলেন বানিয়ে গেছে তার অন্ততপক্ষে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ মহান ব্যক্তি সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন মহান ব্যক্তিও সময়ে সময়ে কতটা নীচ হয়ে মিথ্যা কুৎসা করতে পারে তা রবীন্দ্রনাথের ‘বৌ ঠাকুরাণির ঘাট’ না পড়লে বোঝা সম্ভব না।

প্রতাপের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী একশ্রেণীর এই অহেতুক বিরুদ্ধাচরণকেই কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন গুরুদেব রামদাস স্বামী! তিনি লিখেছেন-

বলিলে যে বঙ্গদেশী প্রতাপের কথা,
শুন গুরুত্ব তার। তেজোবীর্য্যগুণে
প্রতাপ প্রস্ত্তত ছিলো স্বাধীনতা লাভে,
কিন্তু তা’র জাতি, দেশ না ছিল প্রস্তুত;
জ্ঞাতিবন্ধু বহু তা’র ছিল প্রতিকূল,
তাই হল ব্যর্থ চেষ্টা। মূঢ় সেই নর,
দেশ, কাল , পাত্র মনে না করি’ বিচার,
একা যে ছুটিতে চায়; চরণস্খলনে
নাহি রহে কেহ ধরি’ উঠাইতে তারে।।

যাইহোক‚ যে কথা বলার জন্যে কথায় কথায় এতকিছু বলা। লেখালেখি একটা আজব জিনিস। একবার হাত চলতে শুরু করে দিলে তাকে বাগে আনা বড্ড মুশকিল।

মূল কথা এই যে জাতপাত ভিত্তিক পরিচয়টা ত্যাগ করাই ভালো। উচ্চবর্ণ – নিম্নবর্ণ সবার জন্যেই এটা সমানভাবে সত্যি। আগে কি হয়েছে তা এখনো মনে করে জাতপাত নামের মিথ্যে বিভেদ আঁকড়ে বসে থাকলে তা দিনের শেষে হিন্দু সমাজকেই দুর্বল করবে। ইতিহাসে এমন বহুবার করেছে। উপরে একটা যেমন উদাহরণ দিলাম। সেদিন যদি কিছু বাঙ্গালী জাতপরিচয় ভুলে বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে পারত তবে হয়তো আজ ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত।

যাকগে। শুভ হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস। 🙂

সৌভিক দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.