পুত্র রথীন্দ্রনাথের ওপর পিতার চাপটা অন্য সে চাপ প্রত্যাশার

সুদর্শন, সুগায়ক, সুকবি, সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথের পুত্র কেমন হবেন, কী করবেন, তা নিয়ে রথীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই ঠাকুর পরিবারে আলাপ আলোচনার শেষ নেই।

রথীন্দ্রনাথ তা জানতেন। তাঁর ইংরেজি স্মৃতিকথার গোড়াতেই আছে সে প্রসঙ্গ।

রবিকার সন্তান কেমন হবে ছেলে না মেয়ে, হাসিখুশি না সিরিয়াস টাইপ, সমাজ সংস্কারক না ঘরকুনো, হিতেন্দ্রনাথ তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। বলেন্দ্রনাথ রবিকার সঙ্গে এই ‘আসছে’ সন্তানের মিল-বেমিল নিয়ে ফুট কাটছেন।

আর এই সব পারিবারিক কৌতুকের দাপটে রথীর মনে হচ্ছে, সে দেখতে ভাল নয়, তার গায়ের রং কালো।

লিখছেন রথীন্দ্র, ‘My life thus started with a handicap which gave me a complex that has been difficult to overcome even at a mature age.’

বিখ্যাত বাবার ছেলে হওয়ার, সুখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়ার কী জ্বালা! সহজাত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স।

অথচ অনেক গুণ ছিল তাঁর। বাংলা ইংরেজি দু’ভাষাতেই চমকার লিখতেন, ছবি আঁকতেন, কাঠের কাজ আর উদ্যানচর্চায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কৃষিবিজ্ঞানের ভাল ছাত্র, খেলাধুলোয় উৎসাহী, সংগঠনী ক্ষমতা যথেষ্ট। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় কসমোপলিটান ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই ক্লাবের বেসবল টিমের তিনি উৎসাহী উদ্যোক্তা।

অসামান্য ছবি আঁকতেন রথী ঠাকুর। Stella Kramrisch, লিখছেন:

“The flowers he paints in various media, in a technique his own where colour is structural and the background of the picture pulsates with their vibrations.

Rathindranath Tagore knows flowers by his love for them and by science. He is a biologist by training. He is also the architect of the garden in Santiniketan.

To the luxuriant harmony he has brought plants from many parts of the earth and from the undergrowth of the Indian jungle; he has made them all thrive together, each in the soil is required. He cares for them, knows and paints them.

With loving science, he draws the firm logic of their patterns and gives them space and ground on which they breathe their fragrance.”

আবার পিতা রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা আর আনুগত্য কিছু কম ছিল না। বিশ্বভারতীর জন্য কত কিছু করেছেন। বিদেশে গবেষক জীবনের ভবিষ্যত্ ফেলে দেশে ফিরে পিতার কাজে যোগ দিয়েছেন।

চিত্তরঞ্জন দাশ রথীন্দ্রনাথকে ভারতীয় লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য করতে উদ্যোগী হন, রথীন্দ্রনাথ নারাজ। তাঁর সমস্ত উদ্যম ও সময় নাকি বিশ্বভারতীর জন্য নির্দিষ্ট।

রথীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন পরিণত বয়সে। অন দি এজেস অব টাইম (ওরিয়েন্ট লংম্যান) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে। রথীন্দ্র স্মৃতিকথায় পরিবারের বর্ণময় গুরুজনদের নিরপেক্ষ ভাবে নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করছেন।

রবীন্দ্রনাথ দ্বারকানাথ সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত, রথীন্দ্রনাথ নন। তাঁর কলমে দ্বারকানাথ ‘romantic figure’.

আর মহর্ষি?

পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন কান্ট আর বেদান্ত পড়া, আপনভোলা দ্বিজেন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথ জানাতে ভোলেননি, দ্বিজেন্দ্রনাথ পার্থিব বিষয়-আশয়ে শিশুর মতো বেখেয়ালি হলেও মহর্ষি মোটেই তেমন নন। রোমান্টিক দ্বারকানাথ, বাবার জটিল চরিত্র, বিষয়ী মহর্ষি, এ-সবই রথীন্দ্র ইংরেজি ভাষায় নিচু স্বরে লিখে ফেলেছিলেন।

এ যেন নিজস্ব প্রতিবাদ।

বিখ্যাত বাবা আর সুখ্যাত পরিবারের যে অনিবার্য ছায়া তাঁকে ধাওয়া করত, তা থেকে বাইরে আসার চেষ্টা।

জীবনের শেষ পর্বে রথীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছিলেন, বলা ভাল, চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, দেহরাদূনে। জীবনের শেষ আট বছর তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের রসগুঞ্জনের অবিসংবাদিত খলনায়ক। জীবন-সায়াহ্নে নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে-ছুড়ে, সুদূর দেহরাদূনে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি। বন্ধুপত্নীর সঙ্গে।

সেখানে নিজের মতো সময় যাপনের অবসর হয়েছিল তাঁর। শান্তিনিকেতনের জোব্বা ছেড়ে পরতেন শার্ট শর্টস।

তবে বাবাকে, বাবার কর্মসাধনাকে ভুলতে চাননি শান্তিনিকেতনের এই ছাত্র।

১৯৬১। পিতার জন্মশতবর্ষ। রথীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য, শতবর্ষ পালনের উৎসবে ডাক পাননি প্রতিষ্ঠান থেকে। এ বড় আঘাত।

৩ জুন ১৯৬১। দেহরাদুনের ‘মিতালি’তে, চলে গেলেন রথীন্দ্রনাথ।

নির্বিবাদী, সিংহরাশি, ‘সেবক রথী’র বিষণ্ণ জন্মপত্রীতে তখন শুধু জেগে: ‘অমিত নবমী পূর্ব্বফল্গুনী’।

প্রয়াণদিবসে শ্রদ্ধা জানাই।

ঋণ: ১) ‘নিঃসঙ্গ মহা-রথী’ – রানা চক্রবর্তী; ২) আপনি তুমি রইলে দূরে, সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ – নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং; ৩) পিতৃস্মৃতি – রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ৪) চিঠিপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ৫) রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন – সমীর সেনগুপ্ত;

প্রীতম চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.